বাঙালির মুক্তিদূত বঙ্গবন্ধু

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

ড. এএসএম মাকসুদ কামাল:
মুক্তি কথাটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৭ মার্চের ভাষণে জোর দিয়ে বলেছিলেন। সেই ভাষণে তিনি বাঙালির স্বাধীনতার কথাও বলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, কিন্তু মুক্তি দেওয়ার আগেই দেশি-বিদেশি চক্রান্তের শিকার হয়ে তাকে শাহাদাত বরণ করতে হয়। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে; কিন্তু তিনি রেখে গেছেন তার লড়াকু জীবনেতিহাস, সংগ্রামী আদর্শ, সোনালি কর্মের পথরেখা এবং যোগ্য উত্তরাধিকারী-নেতৃত্ব।

বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রামের মূল চেতনাই ছিল একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে পূর্ণাঙ্গতা দিতে সক্ষম- বঙ্গবন্ধু তার এই অন্তর্জাত উপলব্ধি থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন ধ্বংসস্তূপ থেকে দেশ বিনির্মাণে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭২-৭৩ সালের বাজেটে শিক্ষা, পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন, গৃহনির্মাণ এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতে তিনি তুলনামূলক বেশি অর্থ বরাদ্দ করেন। কৃষি ও শিল্প খাতের উন্নয়নের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা প্রণয়ন করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই ঘুণেধরা ইংরেজ আমলের, পাকিস্তানি আমলের যে শাসনব্যবস্থা, তা চলতে পারে না। একে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলে দেশের মঙ্গল আসতে পারে, না হলে আসতে পারে না।’

দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সৃষ্টি করা কৃত্রিম সংকট, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, প্রকৃতির বৈরী আচরণ আর সম্পদের স্বল্পতা- এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে থেকেও বঙ্গবন্ধু এ দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রেখে অগ্রগমনের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন দেশের স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র সক্রিয় ছিল। তাদের দুর্নীতি আর অসহযোগ যখন চরমে, বঙ্গবন্ধু তখন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে বেতার-টেলিভিশন ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের এবারের সংগ্রাম অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সংগ্রাম। আমি যে সুখী ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, সংগ্রাম করেছি এবং দুঃখ-নির্যাতন বরণ করেছি, সেই বাংলাদেশ এখনও আমার স্বপ্নই রয়ে গেছে। গরিব কৃষক ও শ্রমিকের মুখে যতদিন হাসি না ফুটবে ততদিন আমার মনে শান্তি নাই। এই স্বাধীনতা তখনই আমার কাছে প্রকৃত স্বাধীনতা হয়ে উঠবে, যেদিন বাংলাদেশের কৃষক, মজুর ও দুঃখী মানুষের সকল দুঃখের অবসান হবে।’

বঙ্গবন্ধু কৃষকের উন্নয়ন ও কৃষিবিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন। কৃষি ও কৃষকের অবস্থার উন্নয়নে তাদের নিজস্ব জমি ও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থা এবং কৃষি গবেষণা কেন্দ্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করেন বঙ্গবন্ধু। ফলে স্বাধীনতার দুই বছরের মধ্যে দেশের বিধ্বস্ত কৃষি খাত নবযৌবন লাভ করে। পাকিস্তানি শাসনামলের ঋণে জর্জরিত ১০ লাখ ভূমিহীন কৃষকের সুদসহ ঋণ মওকুফ করে জাতির পিতা এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। কৃষকের অধিকার ও সম্মানের কথা সর্বদা চিন্তা করতেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনি চাকরি করেন, আপনার মাইনে দেয় গরিব কৃষক, আপনার মাইনে দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়। আমরা গাড়ি চড়ি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন। ইজ্জত করে কথা বলুন। ওরাই মালিক, ওদের দ্বারাই আপনার সংসার চলে।’

১৯৭৪ সালের ১৮ আগস্ট জাতির উদ্দেশে বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘জনগণের দুর্দশাকে মূলধন করে যারা মুনাফা লোটে; সেই ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, মজুদদার ও চোরা ব্যবসায়ীদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ক্ষুধার্ত মানুষের খাবার যারা কেড়ে নেয় তারা মানুষ নয়, মানুষরূপী পশু। আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন, আমি এ পশুদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে চাই।’ একজন বিপ্লবী নেতা না হলে এই ভাষায় কেউ কথা বলেন না। জনগণের ওপর চূড়ান্ত আস্থা না থাকলে এই সাহসও কেউ পান না। কিন্তু ঘাতকচক্রের ষড়যন্ত্র আর বর্বরতম হত্যাকাণ্ড বঙ্গবন্ধুকে সেই কাজ করার সময় দেয়নি।

স্থলসীমানা নিস্কণ্টক করার জন্য ১৯৭৪ সালের ১৬ মে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লিতে স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশের ভেতরে ছিটমহলবাসী যারা, তারা বাংলাদেশের নাগরিক। আর পশ্চিমবঙ্গের ভেতরে ছিটমহলবাসীগণ ভারতের নাগরিক। চুক্তি অনুযায়ী বেরুবাড়ী ভারতকে দেওয়া হয় এবং কুচলিবাড়ীর তিন বিঘা বাংলাদেশকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ভূমি বিনিময়ের জন্য ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হওয়ায় এই সমস্যা দশকের পর দশক ঝুলে ছিল। ২০১৫ সালের মে মাসে ভারতের পার্লামেন্টে সংবিধানের ১০০তম সংশোধনী বিল পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে ছিটমহল বিনিময়ের সুযোগটি আবার চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজটি সম্পাদন করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ‘মুজিব-ইন্দিরা’ চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে ভারতের ১০ হাজার একরেরও বেশি ভূমি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অতিরিক্ত যুক্ত হয়। অথচ এই চুক্তিকে ‘গোলামির চুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল স্বাধীনতাবিরোধীরা। হীন স্বার্থে এবং বিদেশি প্রভুদের খুশি করতে তারা প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছে। বঙ্গবন্ধু স্থলসীমানার মতো সমুদ্রসীমানা সংক্রান্ত ‘দ্য টেরিটোরিয়াল ওয়াটারস্‌ অ্যান্ড মেরিটাইম জোনস্‌ অ্যাক্ট, ১৯৭৪’ প্রণয়ন করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর দীর্ঘ ৩৮ বছর ঝুলে থাকা ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য শেখ হাসিনার সরকার আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা মামলায় আমরা ২০১২ ও ‘১৪ সালে বিজয়ী হই। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পূর্ণাঙ্গ স্বত্বাধিকার লাভ করে।

বঙ্গবন্ধু সারাজীবন দুঃখী মানুষের জন্য লড়েছেন। সপরিবারে জীবন দিয়েছেন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট। দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা ভেবেছিল, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়কে উপনীত বলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। ব্রিটিশ পত্রিকা ‘স্পেক্টেটর ইনডেক্স’-এর তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ মাথাপিছু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গত পাঁচ বছরে চীন ও ভারতের সমানতালে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ক্রয় সক্ষমতা ছিল ৪৫ শতাংশ, যা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও চীনের সমান। বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে যে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করে চলেছে, যার গোড়াপত্তন করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখন মুজিবকন্যা বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও মুক্তির লক্ষ্যে নিরন্তর লড়ছেন। বাংলাদেশ বিশ্ব-অর্থনীতির আকার বিবেচনায় বর্তমানে ৪১তম অবস্থানে। অগ্রগতির এ ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৬তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।

বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন আর দেখিয়ে গেছেন মুক্তির সোনালি পথ। তার নির্মোহ জীবন আর সীমাহীন ত্যাগের দৃষ্টান্ত বিশ্ব-ইতিহাসে বিরল। কর্ম ও পরিকল্পনায় সাড়ে তিন বছরের তার দেশ পরিচালনা সময়টুকু আজ গবেষণার বিষয়। একজন মানুষের মধ্যে কোন শক্তি থাকলে এসব একসঙ্গে করা সম্ভব, এটা সত্যি বিস্ময়ের! তিনি নিশ্চয়ই বাঙালির মুক্তিদূত, বাঙালির পরিত্রাতা।

ড. এএসএম মাকসুদ কামাল, উপ-উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: দৈনিক সমকাল

আরও পড়ুন