শাহাব উদ্দিন মাহমুদ: ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে বঙ্গবন্ধু খুব মর্মাহত হন। দুর্ভিক্ষপরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি হিমশিম খাচ্ছিলেন। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল অভ্যন্তরীণ নাশকতামূলক কর্মকান্ড। সারাদেশ যখন দুর্ভিক্ষের ছোবলে একদম মৃতপ্রায়, তখন কর্নেল তাহের গড়ে তোলেন তার গোপন সশস্ত্র বিপ্লবী গণবাহিনী। দেশের এই চরম দুর্দিনে জাসদ প্রতিটি সেনানিবাসে গড়ে তোলেন তাদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। জাসদ ১৯৭৩ সালে তাদের প্রথম জাতীয় অধিবেশনেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও-এর চিন্তাধারাকে তাদের আদর্শ এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে লক্ষ্য স্থির করে বঙ্গবন্ধু সরকারকে বুর্জোয়া শোষক শ্রেণীর সরকার আখ্যায়িত করে এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে লিপ্ত হয়। সঙ্কটাপন্ন পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর নিজ দলের অনেক গণপরিষদ সদস্য ও এমসিএকে বহিষ্কার করেন। প্রায় সাড়ে তিন বছরের প্রতিটি দিন এমন বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে করতে তিনি ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করেন দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করতে। কাউকেই তিনি আর ভরসা করতে পারছিলেন না। দুর্ভিক্ষে এত মানুষের মৃত্যু তাঁকে বিমর্ষ ও ডেসপারেট করে তোলে। এত নাশকতা, এত বৈরিতা, এত দুর্নীতি একসময় তাঁকে বাধ্য করেছে নিজের হাতে ক্ষমতা নিয়ে নিতে, বাকশাল গঠন করতে। বাকশালকে তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর এটি ছিল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লব। তবে বাকশালের মতো বিপ্লবী উদ্যোগ পৃথিবীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব নয়। এর আগেও অনেক দেশে হয়েছে। কিন্তু এর আগে যেটি কখনই হয়নি সেটিই করে দেখালেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেটি করলেন দেশের বিদ্যমান আইন ও সংবিধানের বিধি মেনে। শেষের দিনগুলোতে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে বঙ্গবন্ধু তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচী চূড়ান্তকরণে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছিলেন।
১৯৭৫ সাল। ১৩ আগস্ট। দিনটি ছিল বুধবার। সকাল ১১টায় রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন যুক্তরাষ্ট্রে নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এম আর সিদ্দিকী। সন্ধ্যা ছয়টায় ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং সাড়ে ছয়টায় সাক্ষাত করেন চাঁদপুরের এম এ রব। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট চুং হি পার্কের বিশেষ দূত সো ইয়ং চুং ঢাকা এসে পৌঁছেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য তার দেশের প্রেসিডেন্টের একটি বার্তা নিয়ে এসেছেন। তিনি আজ ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কৃষিমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে সাক্ষাত করেছেন। শুক্রবার রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন। এ উপলক্ষে কর্মসূচী চূড়ান্ত করা হয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সাহায্য বণ্টন পরিস্থিতি, রেলওয়ে, নৌপরিবহন, বিমান, সড়ক যোগাযোগের বিভিন্ন প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হয়। শ্রমমন্ত্রী ও শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইউসুফ আলী বলেছেন, দেশের নতুন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সহিত সামঞ্জস্য রেখে নতুন শ্রম নীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের পর ইহা প্রকাশ করা হবে। তিনি বঙ্গভবনে জেলা গবর্নর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের উদ্দেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। বাকশাল সম্পাদক জিল্লুর রহমান জেলা গবর্নর ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রশিক্ষণ ক্লাসে বলেছেন প্রভু নয় জনগণের সেবক হিসেবে কাজ করবেন। তিনি বলেন, মুখ্য স্থানীয় সংস্থা হিসেবে জেলা প্রশাসনকে সামগ্রিকভাবে পল্লী উন্নয়ন, কৃষি আধুনিকীকরণ, শিল্পের প্রসার ও উৎপাদন বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন এবং পরিকল্পিত জনশক্তির মাধ্যমে বেকার সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব দেয়া হবে। তিনি বলেন, কায়েমি স্বার্থবাদী মহল এ নয়া কর্মসূচী বানচালে লিপ্ত হতে পারে। এদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তিনি যৌথ নেতৃত্ব গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
জেলা গবর্নরদের প্রশিক্ষণে বাকশাল সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি বলেছেন, শ্রমজীবী মানুষকে উজ্জীবিত করে জাতীয় অগ্রগতি অর্জনের বস্তুনিষ্ঠ পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব বাকশালের। এ অধিবেশনে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটরাও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থেই নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। তাই বর্তমান প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উচিত তাদের আশা-আকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করা। তিনি বলেন, মধ্যবিত্ত সমাজকে শ্রমিক শ্রেণীর সঙ্গে একাত্ম হতে হবে। বঙ্গভবনে জেলা গবর্নরদের প্রশিক্ষণে বাকশাল সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য নিজেদের গড়ে তোলার জন্য তিনি ছাত্র ও যুব সমাজের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি গবর্নরদের যুবলীগের ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। ছাত্রলীগের ভূমিকা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে তিনি বলেন, তাদের প্রধান কাজ হলো লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করা এবং ভবিষ্যত নেতৃত্বের জন্য নিজেদের গড়ে তোলা। তিনি গবর্নরদের নিজ নিজ এলাকার যুব সমাজ এবং ছাত্রদের সংগঠিত করার আহ্বান জানান। বাকশাল জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ ক্লাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, জাতীয় স্বার্থের খাতিরে বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা বজায় রাখা এবং অন্য দেশের সঙ্গে মূল্যবান সহযোগিতা গড়ে তোলার খাতিরে এ ধরনের নীতি সবচেয়ে উপযোগী। বাকশাল জেলা সম্পাদকদের প্রশিক্ষণ ক্লাসে তথ্যমন্ত্রী কোরবান আলী গবর্নরদের ব্যক্তি স্বার্থ এবং দুর্নীতির উর্ধে থেকে সকলকে বাংলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের মাধ্যমে স্বাধীনতার সুফল বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, জাতীয় দলের লক্ষ্য হলো দেশে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। দলীয় কর্মীরা যদি দুর্নীতি মুক্ত হন তবেই জাতীয় দলের এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। গবর্নরদের প্রশিক্ষণে আজ ক্লাস নেন বাকশাল কেন্দ্রীয় সদস্য মহিউদ্দিন আহমেদ, বাকশাল কেন্দ্রীয় সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী দেওয়ান ফরিদ গাজী, জাতীয় মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক ও বাকশাল কেন্দ্রীয় সদস্য সাজেদা চৌধুরী। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আব্দুল মান্নান বলেছেন, বন্যার জন্য কর্মসূচী ব্যাহত হওয়ায় পরবর্তী কয়েক মাসের মধ্যেই দেশ থেকে বসন্ত নির্মূল হবে। ঢাকায় গভীর রাতে ভিক্ষুক উচ্ছেদ শুরু হয়েছে, তবে বেশিরভাগ স্থানে তারা প্রতিরোধের চেষ্টা করেছেন। প্রথম দিনে ৫০০০ ভিক্ষুক ধরা হয়েছে। সমাজকল্যাণ দফতর পুলিশের সহযোগিতা নিয়ে এ অভিযান চালাচ্ছে। তাদের পুবাইল এবং অপর একটিসহ দুটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে নেয়া হচ্ছে। সেখানে তাদের কর্মমুখী শিক্ষা দেয়া হবে এবং জীবন ধারণের জন্য রেশন দেয়া হবে। ভিক্ষুকরা সরকারের এ পদক্ষেপে সন্তুষ্ট নয়, কারণ ভিক্ষায় লাভ বেশি। গত জানুয়ারিতে তাদের টঙ্গীর দত্তপারা এবং ডেমরার চনপারায় পাঠানো হয়েছিল। এদের অধিকাংশই আবার ফিরে এসেছে, সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্রাম থেকে আসা কিছু নতুন মুখ। জানুয়ারি মাসে ৫১,০০০ ভিক্ষুক ঢাকা থেকে সরিয়ে পুনর্বাসন করা হয়েছিল। গতকাল মার্কিন রাষ্ট্রদূত বোস্টার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামারুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন। মার্কিন দূতাবাসের কাউন্সিলর ডিএম কুহরান দেখা করেন বাকশাল সেক্রেটারি জিল্লুর রহমানের সঙ্গে। যুক্তরাষ্ট্র্রের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, কোন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের হত্যার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। বিচিত্রা সম্পাদক বেবী মওদুদ তার এক নিবন্ধে লেখেন, ব্রাসেলসে বেড়াতে গিয়ে বাবার (বঙ্গবন্ধুর) সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন শেখ রেহানা। বলেন, ঢাকায় ফিরতে চান। বঙ্গবন্ধু তাকে বলেছিলেন, দেশে ফেরার বিষয়ে রাষ্ট্রদূতকে সব ব্যবস্থা নিতে বলবেন তিনি।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক