কলঙ্ক ও পাপমোচনের ১২ নভেম্বর

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

কেবল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেলপ্রাপ্তি (১৯১৩), অস্ট্রিয়ার প্রজাতন্ত্র ঘোষণা (১৯১৮), মরক্কো-সুদান-তিউনিশিয়ার জাতিসংঘের সদস্যপ্রাপ্তি (১৯৫৬) বা পৃথিবীর প্রাচীনতম দুই হাজার ৬০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্রের সিংহাসনে জাপানের সম্রাট আকিহিতোর অভিষেক (১৯৯০)-এর জন্য নয়, বাংলাদেশে এক কলঙ্কমোচনের ঘটনায় বিশ্ব ইতিহাসে উদ্ভাসিত দিন ১২ নভেম্বর। রাজনৈতিক বা কোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার করা যাবে না—এমন কলঙ্ক থেকে বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে ১৯৯৬ সালের এই দিনটিতে। যা দেশের ক্যালেন্ডারেই নয়, আন্তর্জাতিক দিনপঞ্জিতেও স্বস্তিময় একটি তারিখ। বাঙালি জাতির কাছে একটি অনন্য স্বস্তি ও অনুভূতির দিন।

হত্যার বিচার রহিত রাখার পাপের বোঝা বাঙালি ও বাংলাদেশকে এখন আর বহন করতে হচ্ছে না। হত্যার বিচার না হওয়ার ঘটনা রয়েছে বহু দেশেই। কিন্তু আইন করে হত্যার বিচার নিষিদ্ধের কালো নজির বাংলাদেশ ছাড়া দুনিয়ার কোথাও নেই। তা-ও আবার যিনি দেশটি স্বাধীন করেছেন তাঁকেই সপরিবারে হত্যার বিচার না করার আইন! পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দিনই রাষ্ট্রপতি হয়ে যান তাঁরই বিশ্বস্ত সহচর খন্দকার মোশতাক আহমদ। ১৫ই আগস্টের সরাসরি খুনি সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যরা একে একে দেশত্যাগে বড় দাগে স্বস্তি আসে তাঁর। হত্যাকাণ্ডের এক মাস ১০ দিনের মাথায় ২৬ সেপ্টেম্বর জারি হয় এই হত্যার বিচার করা যাবে না মর্মে কলঙ্কিত-বর্বর অধ্যাদেশটি। ‘ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স’ নামে অধ্যাদেশটিকে সংসদে আইনে রূপ দেওয়া হয় ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই।

রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন জেনারেল জিয়াউর রহমান। মোশতাক করলেন অর্ডিন্যান্স, আর জিয়া একে রূপ দিলেন আইনে। সেই আইনেরও কী জঘন্য ভাষা, কী নোংরা চাতুরি! কী নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা! ‘পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট ভোরে আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, খুনিদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা বা অভিযোগও করা যাবে না। ’ আইয়ামে জাহিলিয়াত বা আফ্রিকান কোনো রাজ্যেও এমন লিখিত আইন বা বিধানের কথা ভাবা যায়?

মোশতাকের সময় এটি অভিহিত ছিল ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নম্বর ৫০ নামে। পরে ১৯৭৯ সালে সংসদে এটি হয়ে যায় একটি আনুষ্ঠানিক আইন। ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর আইনটি অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায় দেশের সংবিধানে। আইনের এমন বীভৎসতা, ক্ষমতার আস্ফাালন কি নির্দয়ভাবে হজম করানো হয়েছে জাতিকে। নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞের পর খুনিদের যাতে বিচার করা না যায় এবং হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যারা ছিল তাদের নামও প্রকাশ না করার নির্দেশনামূলক অধ্যাদেশে মোশতাকের সই থাকলেও তিনি একাই ছিলেন এর আয়োজক?

বলার অপেক্ষা রাখে না, অঘটনঘটনপটীয়সী বা কুশীলব ছিল অনেক। সংসদে আইনটি করার দিন টেবিল থাপড়ানো হয়েছিল তালে তালে। অট্টহাসি চলেছে সুরে-বেসুরে। সেই ঝংকারে চাপা পড়ে গিয়েছিল অধিবেশনে মিজানুর রহমান চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ তখনকার বিরোধী মতের কয়েকজনের মৃদুস্বরের আপত্তি। মিজান চৌধুরী সেদিন আক্ষেপ করে বলেছিলেন, মেজরিটির এত আস্ফাালন ভালো নয়। যে ২০৭ জন আজ উল্লাস করছেন, এমনও দিন আসতে পারে যেদিন তাঁদের আসন সাতজনেও নেমে আসতে পারে। প্রকৃতির বাস্তবতা কী নির্মম! কয়েক দফায় ক্ষমতাভোগী বিএনপি নামের বিশাল দলটির সংসদে সদস্যসংখ্যা এখন সেই অঙ্কের তলানিতেই ঠেকেছে।

তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছে আওয়ামী লীগের বাইরেও অনেকের আবদার ছিল এ নিষ্ঠুরতায় না যেতে। বিচার করতে না পারলেও অন্তত খন্দকার মোশতাকের পাপের বোঝা নিজের কাঁধে না নিয়ে বরং খুনির জারীকৃত অধ্যাদেশটি বাতিল করতে। বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল, এ দায় মাথায় নিলে তিনিও পাপী ও কলঙ্কিত হবেন। তাঁরা তাঁকে টলাতে পারেননি। নিষ্ঠুর নিয়তিতে জেনারেল জিয়াকেও বরণ করতে হয় হত্যার রাজনীতির বেদনার কাব্য। প্রাণ দিয়েও তাঁর ললাট থেকে মোচেনি পঁচাত্তরের ঘাতকদের সঙ্গে সংযোগ বা আন্ত যোগাযোগের অভিযোগ। বিচার না করেন অন্তত আইন করে বিচারের পথ বন্ধের কর্মে না গেলে ওই কলঙ্ক মোচার চেষ্টা করলেও করতে পারত তাঁর দল।

১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরেই ইনডেমটি বাতিল এবং আগস্ট ট্র্যাজেডির বিচারের দাবি তোলেন। জিয়া-সাত্তারের পর এরশাদ আমলেও এ নিয়ে কত দুয়ারে মাথা ঠুকেছেন তিনি। তা অব্যাহত রেখেছেন রাজনীতির পালাবদলে ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসা খালেদা জিয়ার সময় দেশে একটি নতুন রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তনের সময়ও। সুযোগ পেয়েও ‘হত্যার রাজনীতির বিচার না করার আইনটি’ বাতিলের হাতছাড়া করে বিএনপি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তখন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের জন্য আনা একটি বিলেও আমল দেয়নি বিএনপি সরকার। বরং তৎকালীন আইনমন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ বলেছিলেন, ইনডেমনিটি আইনটি এতই জটিল তা প্রত্যাহারের কোনো ফাঁক নেই।

টানা ২১ বছর ক্ষমতাহীন থাকা আওয়ামী লীগকে ১৯৯৬ সালে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরিয়ে এনে শেখ হাসিনা প্রতিজ্ঞা নেন বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের। তবে বিচারবহির্ভূত হত্যার বিচারবহির্ভূতভাবে নয়। একজন সাধারণ মানুষের হত্যার বিচার যেভাবে হয়, সেভাবেই। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি আইন বাতিলের পর ধানমণ্ডি থানায় মামলা হয় ওই বছরের ২ অক্টোবর। মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরে আপিলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল এবং তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়। ওই পর্যায়ে ২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট। এতে থেমে যায় মামলাটির যাবতীয় কার্যক্রম। এর আগে পঁচাত্তরের খুনিদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি বাতিলকে চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৭ সালে এক আসামি শাহরিয়ার রশিদের উচ্চ আদালতে রিটের আইনজীবী ছিলেন বিএনপি ঘরানার অ্যাডভোকেট কোরবান আলী। এ মামলায় আদালত বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমদকে নিরপেক্ষ পরামর্শ দিতে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দিয়েছিলেন। কিন্তু নিরপেক্ষতার নামে তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধ আইন হিসেবে যুক্তি দাঁড় করিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকে বৈধ মনে করেছিলেন।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ নিয়ে খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, এইচ এম এরশাদ, খালেদা জিয়া সরকারের ছিল একই নীতি। ১২ নভেম্বর তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ‘দ্য ইনডেমনিটি রিপিল অ্যাক্ট-১৯৯৬’ চূড়ান্তভাবে উত্থাপনের পর তা রুখে দেওয়ার চেষ্টার মধ্য দিয়ে বিএনপি আবারও ১৫ই আগস্টের দায়ভার নেয়। দিনটিতে তারা হরতাল করেছে। বিলটির বিরোধিতা করে সংসদে অনুপস্থিত থেকেছেন বিএনপির ১১৬ এবং জামায়াতের তিন সদস্য। সমর্থন দেন জাতীয় পার্টির ৩২, জাসদের এক ও স্বতন্ত্র সদস্য একজন। বিলটি পাসে দরকার ছিল ১৫০টি ভোটের। এতে সেটি অনায়াসেই হয়ে যাওয়ায় বিএনপি-জামায়াতের বিরোধিতা, হরতাল বা সংসদে গড়হাজিরে আইনটি পাস করতে কোনো সমস্যা হয়নি। সেই আইনবলেই বিচারপ্রক্রিয়া শেষে কয়েক ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। কয়েক খুনি বিদেশে ফেরারি। মৃত্যু হয়েছে কয়েকজনের।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ণাঙ্গ বিচার আক্ষরিক অর্থে শেষ হয়নি। হয়েছে খণ্ডিত বিচার। এই হত্যাযজ্ঞের কুশীলব, আয়োজক তথা ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার হয়নি। পরিকল্পনায় জড়িতরাও অধরা। হত্যার ষড়যন্ত্রকারী, পরিকল্পনাকারী, সুবিধাভোগীদের পাশাপাশি তখন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থরাও বিচারের বাইরে। তা নিরূপণে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন তদন্ত কমিশনের তাগিদ ও দাবি রয়েছে। তাদের স্বরূপ উন্মোচন করা দরকার।

 

লেখক : মোস্তফা কামাল
বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
কালের কণ্ঠ ১২ নভেম্বর, ২০২২

আরও পড়ুন