সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য জানি না জেল হত্যাকাণ্ডের সময়ে আমিও ছিলাম জেলের ভেতরে। ইতিহাসের সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বীভৎস রূপ জেলের ভেতরে বসেই টের পেয়েছি। এখনো শরীর শিউরে ওঠে সেই বেদনার স্মৃতি মনে পড়লে। ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমি একেক দিন একেক আত্মীয়ের বাসা পাল্টাতে থাকলাম। আমাকে এসবির লোকজন ফলো করছিল। ৭ সেপ্টেম্বর আমার এক ভগ্নিপতির বাসা থেকে রাতে গ্রেপ্তার করা হয়।
নিয়ে যাওয়া হয় রেডিও স্টেশনে। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসে না। দোয়া দরুদ পড়তে থাকলাম। ছয়জন যেখানে বসা আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। একজন বলল কে আনতে বলেছে তাকে? শাহরিয়ার বলল আমি। তার কাছে অনেক খবর থাকতে পারে। ডালিম বলল, ওনাকে ওই রুমে নিয়ে বসাও। এরপর আমাকে একটি কাচের গ্লাসের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। বাইরে থেকে লোকজন হাঁটাচলা করলে দেখা যায়। সেখানে দেখতে পেলাম সংগীতজ্ঞ আলতাফ মাহমুদ কাইয়ুমকে।
ইশারা পেয়ে আমার কাছে এলে তাকে আমার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ফোন নম্বর দেই এবং সে যোগাযোগ করে। পরেরদিন আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় রেসকোর্সের কন্ট্রোল রুমে। সেখানে আমাকে পৌঁছে দেয় ক্যাপ্টেন আলম। কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে ছিলেন ইন্সপেক্টর রশিদ। তিনি আমাকে দেখে চিনেছিলেন। কারণ তার বাড়ি ছিল পটুয়াখালী। তিনি আমাকে বললেন, ‘আমার রিস্ক আছে’। তার পরেও আপনাকে ফোনটা দিলাম।
আপনার যেখানে-যেখানে প্রয়োজন যোগাযোগ করতে পারেন। কারণ আপনার সময় মাত্র সন্ধ্যা পর্যন্ত। ওনারা যে এন্ট্রি করছে তাতে ফেরত যাওয়ার কথা না। ঘাবড়ে গেলাম আমি। তখন বরিশালের আমার বন্ধু এসপি মামুন সাহেবকে ফোন দিলাম। তিনি জানালেন আমাদের কাছে রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে, আমরা পাঠিয়েছি। পরবর্তী সময়ে কিছু আসলে জানাব।
তখন আইজি ছিলেন নুরুল ইসলাম। আর এসএস-১ ছিলেন মোরশেদ সাহেব। মোরশেদ সাহেব ফোনে জানান আমরা একটি মিটিং করেছি। আপনাকে জয়েন্ট ইন্টারগেশন সেলে নিয়ে আসার। এছাড়া বাঁচানোর আর কোনো পথ নেই। আমরা আপনাকে এরেস্ট করে নিয়ে যাব। কিন্তু ছাড়া পেতে অনেকদিন লাগবে।
এরেস্ট করে আমাকে যে রুমে নিয়ে আসা হলো, সেই রুমের প্রতিটি দেয়ালে রক্তের ছাপ। ছিল ইলেকট্রিক চেয়ার। মৃত্যুর আগে ভয় দেখানোর নানা সরঞ্জাম। মনে অনেক ধরনের আশঙ্কা। সেদিন ছিল প্রথম রোজা। আমি এক নাগারে জোহর ও আছর নামাজ পড়ে যখন সেজদায়, তখন খসখস শব্দ- স্যার ওঠেন, স্যার ওঠেন সময় নেই। আমি আবার ঘাবড়ে গেলাম। চেয়ে দেখি রমনা থানার ওসি আনোয়ার।
তিনি আমাকে জিপে করে রমনা থানায় নিয়ে এসে ডিটেনশনের কাগজপত্র তৈরি করে নিয়ে সেন্ট্রাল জেলের উদ্দেশে রওনা দিলেন। পথে তাকে বললাম, জেলে অনেক নকশাল থাকে। আমাকে যেন আমাদের নেতৃবৃন্দ যেখানে আছেন, সেখানে রাখা হয়। তিনি সেন্ট্রাল জেলে পৌঁছে আমাদের যে সব মন্ত্রী-এমপি আছেন তাদের সঙ্গেই রাখতে বলে চলে যান।
এরপর নিউজেলে ঢুকলাম। সেখানে রুম ছিল ৪টি। ৩টি একসঙ্গে।
আর একটা ছিল বাম পাশে সোজা হলরুমের মতো। সেল রুমের ১নং সেলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ২নং সেলে কামরুজ্জামান সাহেব আর ৩নং সেলে ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদ ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি সৈয়দ হোসেন সাহেব। ডিভিশন পাওয়ার কারণে আমিও খাট পেলাম। আমার খাট ছিল ঠিক মনসুর আলী সাহেবের উল্টোপাশে। দোয়া দরুদ আর নামাজ পড়ে আমাদের দিন কাটত।
মাঝে মাঝে আমরা বসে সিদ্ধান্তও নিতাম। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে ২ নভেম্বর সেদিন ছিল রবিবার। মনসুর আলী সাহেব এশার নামাজ পড়ে বললেন, শরীরটা জ্বর জ্বর লাগছে। আজ নিচে নামব না। ওপরে বসেই মোনাজাত করব। তখন তার মাথায় টুপি, পরনে ছিল লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। আমরা রাতের খাওয়া শেষ করে ১টার পরে ঘুমাতে গেলাম। এর আগে সাত/আট দিন ধরে জেলখানায় একটা গুজব ছিল জাতীয় চার নেতার সঙ্গে সরকারের সমঝোতা বা আলোচনা হতে পারে।
ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, রাশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামসুল হক সাহেব রাশিয়ায় যাওয়ার আগে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে দেখা করতে এসেও এমন কথা জানিয়ে ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ সাহেব বিষয়টি আমাদের বলেছেন ঠিকই, কিন্তু তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না, বরং মুখটা ছিল অন্ধকার।
ওইদিন রাত পৌনে দুইটার দিকে চারদিকে পায়ের আওয়াজ, আর খটখট শব্দ। প্রথমে ২ নম্বর রুমের গেট খোলার আওয়াজ পেলাম। আমরা জেলে প্রায় না ঘুমিয়ে কাটাতাম।
এরপর আমাদের গেট খুলে মনসুর আলী সাহেবকে বলল স্যার যেতে হবে। আলোচনা আছে। ওনারাও থাকবেন। আমি বললাম, সরকারের সঙ্গে যদি আলোচনাই হয় তবে এত রাতে কেন? অনেকে আবার ভাবলেন, আলোচনার নামে বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে চোখ বেঁধে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসেবে, তাদেরকেও হয়তো সেভাবেই সরিয়ে দেওয়া হতে পারে।
ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নিয়ে যাওয়ার পর রাত ২.২০ মিনিটে প্রথম ব্রাশফায়ারের আওয়াজ পেলাম। এর ১০ মিনিট পর আবারো ব্রাশফায়ারের শব্দ। আমরা হতভম্ব হয়ে পড়লাম। বুঝতে পারলাম আমাদের নেতাদের কোনো অঘটন ঘটেছে। সকালে নিশ্চিত হলাম জাতীয় চার নেতার কেউ আর বেঁচে নেই।
জানতে পারলাম, প্রথম ব্রাশফায়ারে মনসুর আলী সাহেব মরেননি। তিনি গোঙানি দিচ্ছিলেন। পরে ঘাতকরা আবার ফিরে এসে তাকে গুলি করে এবং বেয়োনেট চার্জ করে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। অনেকে বলেন তাজউদ্দীন আহমদকেও এভাবে হত্যা নিশ্চিত করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- যে স্বাধীনতাবিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের প্রতি বিপ্লব ছিল, তার দ্বিতীয় ধাপ তারা পূরণ করে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে। জাতীয় চার নেতাকে হারানোর একদিন পরে আমাদের কাছে আরেকটি ক্যু এর খবর এলো,। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেছেন। যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করতে পারে, তাদের কাছে জাতীয় চার নেতা কোনো বিষয় নয়, কিন্তু জাতির কাছে তারা অনেক কিছু। বাঙালি জাতির জীবনে তাদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়।
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে তারা মূলত বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে হত্যা করতে চেয়েছিল। বাংলাদেশকে তারা নব্য পাকিস্তান বানানোর ষড়যন্ত্র করেছিল। মহান স্রষ্টার অশেষ কৃপায় তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসা ও আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
শেখ হাসিনা যেহেতু ১৫ আগস্ট দেশে ছিলেন না, তাই তাকে হত্যার বারবার চেষ্টা করে খুনি চক্র। বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে থাকার কারণেই ঘাতক চক্রের পরাজয় হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে আবার প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
আমির হোসেন আমু
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র