সাহসের নাম শেখ কামাল

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

শেখ কামাল আমার বন্ধু ছিলেন না, তবে আমি তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দেখেছি, একসঙ্গে মিছিলও করেছি। তাঁর মধ্যে একই সঙ্গে সাহস ও অসহায়ের প্রতি দরদ আমি লক্ষ করেছি।

১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট শেখ কামালের জন্ম। মাত্র ২৬ বছর বয়সের এক টগবগে যুবক যখন তিনি, তখনই তাঁকে বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতির মানুষ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র অবস্থাতেই শেখ কামাল রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী অপশাসন এবং শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করে পিতা শেখ মুজিবের জীবন কেমন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ছিল, সেটা শেখ কামাল একেবারে জন্মের পর থেকেই দেখেছেন। স্ত্রী-কন্যা-পুত্র-সংসার-পরিবার নয়, শেখ মুজিবের জীবন নিবেদিত ছিল দেশের সব মানুষের কল্যাণের জন্য। পিতার আদর্শ বুকে ধারণ করে মানুষের কল্যাণচিন্তায় শেখ কামালও উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তিনি পিতার মতোই সাহসী ও নির্ভীক হয়ে উঠেছিলেন। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে শুরু করেছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায্যতার পক্ষে সংগ্রাম।

আজকের পত্রিকা অনলাইনের সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
শেখ কামাল ছিলেন নানামুখী প্রতিভার অধিকারী একজন উদ্যমী সংগঠক। মিছিল-মিটিং ছাড়াও খেলার মাঠে ছিলেন অতি সক্রিয়। আবার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তাঁর উৎসাহে কমতি ছিল না। নাটকে অভিনয় করেছেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সেতারবাদন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। গিটার বাজাতে দক্ষ ছিলেন। ছাত্রলীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। সত্তরের নির্বাচনের সময় ছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষের একজন প্রচারকর্মী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সময় একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ছুটে গেছেন অসহায় মানুষের কাছে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি যুদ্ধকালে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর এডিসির দায়িত্বও পালন করেছেন।

স্বাধীনতার পর সদ্য স্বাধীন দেশে খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কাজে তিনি বেশি সময় দিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন ক্রীড়া সংগঠন ‘আবাহনী’ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্পন্দন’। শেখ কামাল ছিলেন একজন প্রাণবন্ত উচ্ছল তরুণ। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের সন্তান হিসেবে তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন না। সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশতেন, চুটিয়ে আড্ডা দিতেন, গল্প, হাসি-তামাশায় আসর মাতিয়ে রাখতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে যাঁরা শেখ কামালকে ক্যাম্পাসে দেখেছেন, তাঁরা জানেন তাঁর মধ্যে কোনো দম্ভ ছিল না। চোখের সামনে কোনো অন্যায় হতে দেখলে প্রতিবাদ করা ছিল তাঁর সহজাত প্রবণতা।

১৯৭৩ সালের শেষের দিক থেকেই সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টির চোরাগোপ্তা আক্রমণ বাড়তে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে সিরাজ সিকদার ও অন্য সশস্ত্র গ্রুপ নাশকতা চালাতে পারে বলে খবর ছিল। সিরাজ সিকদার বিজয় দিবস মানতেন না। তিনি মনে করতেন, দেশের পূর্ণাঙ্গ বিজয় হয়নি। সে জন্য তাঁরা ১৪ ডিসেম্বর ঢাকায় দুটি স্থানে বোমা নিক্ষেপ করেছিল। একটি বাংলার বাণী (অধুনালুপ্ত দৈনিক এবং মালিক ছিলেন শেখ কামালের ফুফাতো ভাই শেখ ফজলুল হক মণি) পত্রিকা অফিসে এবং অপরটি বিস্ফোরিত হয় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস অফিসে। বোমা দুটি একটি লাল টয়োটা গাড়ি থেকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বলে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।

পরদিন দিবাগত রাতেই আমরা শুনেছিলাম, বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল মতিঝিল এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তখন এমন রটনা করা হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংকে ডাকাতি করতে গিয়ে শেখ কামাল গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ছেলের টাকার দরকার হলে ব্যাংক ডাকাতি করতে হবে কেন অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকে সত্যি সত্যি ডাকাতি করা সম্ভব কি না—এসব যৌক্তিক প্রশ্নও তখন কারও মাথায় আসেনি বলেই শেখ কামালের বিরুদ্ধে ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগ অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিল। আমাদের দেশের অনেকে ঘটনার চেয়ে রটনায় বেশি বিশ্বাস করে।

পরবর্তী সময়ে শেখ কামালের সঙ্গে গাড়িতে থাকা দু-একজন প্রকৃত ঘটনাটি বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু গুজব যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা সত্য ঘটনা বিশ্বাস করবেন কেন? আমরা আমাদের সূত্র থেকে তখন যা শুনেছিলাম, তা মোটামুটি এ রকম:

সেই সময় পুলিশ কর্মকর্তা এসপি মাহবুব উদ্দিন আহমদ ঢাকায় কয়েকটি দল পরিচালনা করতেন জাসদের গণবাহিনী এবং সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি দমন করার জন্য। দলগুলো সাদাপোশাকে কিন্তু সশস্ত্র অবস্থায় প্রাইভেট গাড়িতে ঘুরত গণবাহিনী ও নকশালীদের ধরার জন্য এবং সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই চ্যালেঞ্জ করত। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ রাতে কাকরাইল, পল্টন ও মতিঝিল এলাকার টহলের দায়িত্বে থাকা বাহিনীর পক্ষ থেকেই শেখ কামাল ও তাঁর বন্ধুদের বহনকারী গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে জখম হন গাড়িতে থাকা শেখ কামালসহ কয়েকজন। ভুল-বোঝাবুঝি থেকেই এই অঘটন। এর সঙ্গে ব্যাংক ডাকাতির সামান্য যোগসূত্র না থাকলেও সেটাই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই। সে রাতে তিনি বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পরবর্তী সময়ে বিএনপি নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদও।

অবশ্য তখন আমরা এটাও শুনেছিলাম যে বঙ্গবন্ধু শেখ কামালের এ রকম অবাঞ্ছিত ঘোরাফেরায় ক্ষুব্ধ হয়ে হাসপাতালে দেখতে যেতে প্রথমে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।

এ নিয়ে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর কাছে একটি ঘটনা আমি ১৯৯৬ সালে শুনেছি। ঘটনাটি এমন, গাফ্‌ফার চৌধুরী তখন দৈনিক জনপদ পত্রিকার সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ডেকে শেখ কামালকে একটু বোঝানোর দায়িত্ব দেন, যেন শেখ কামাল এমন কিছু না করে, যাতে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। গাফ্‌ফার চৌধুরী যথারীতি শেখ কামালকে ডেকে একদিন কথা বলেন, ‘শোনো বাবা, তোমার বাবা কিন্তু এখন শুধু তোমার বাবা নন, তিনি এখন জাতির পিতা। জাতির পিতার সম্মান ক্ষুণ্ণ হয় এমন কিছু করা তোমার উচিত হবে না।’

শেখ কামাল বাধ্য ছাত্রের মতো সব কথা শোনেন এবং শেষে হাত কচলে বলেন, ‘চাচা, আমি বুঝেছি। কিন্তু চাচা শেখ কামাল তো শেখ মুজিবেরই ছেলে। শেখ কামালের যে সাহস, তা তো রক্তে পাওয়া। আমি আমার বাবা জাতির পিতা হওয়ার আগে যেমন সাহসের পরিচয় দিয়েছি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সময়, এখন তার থেকে বেশি সাহস দেখাই না। আমি যেমন ভীরু নই, তেমনি আমি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণও করি না। বাবা প্রধানমন্ত্রী, সে দাপট আমি দেখাই না, তবে আমার সামনে অন্যায় কিছু ঘটতে দেখলে আমি প্রতিবাদ করি মাত্র।’

শেখ কামালের বক্তব্য শুনে গাফ্‌ফার ভাইও আর কথা বাড়াননি।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্রের ধারাবাহিক অপপ্রচারের কারণে তিনি কিছু অকারণ অপবাদের শিকার হলেও অধ্যাপক আবুল ফজলের মতো মানুষও শেখ কামালের সঙ্গে দুই দফা সাক্ষাতের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তাঁর সৌজন্য-সহবতের প্রশংসাই করেছেন।

লেখক: বিভুরঞ্জন সরকার
সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২২

আরও পড়ুন