ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই অর্জিত হয়েছে আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। ধর্মীয় আবেদনে পাকিস্তানের সৃষ্টি। এই উপমহাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়কে বুঝানো হয়েছিল, সত্যিকার মর্যাদা ও স্বার্থ নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে তাদের জন্য একটা ভিন্ন রাষ্ট্রের প্রয়োজন। এরূপ আবেগ ও অনুভূতির বশবর্তী হয়ে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা ভোট দিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি করে। আর ওই পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা হয় সবচেয়ে নিগৃহীত ও উপেক্ষিত। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সৃষ্টি ছিল বাঙালির স্বার্থবিরোধী। পাকিস্তানি শাসকরা প্রায় ১২০০ মাইল ব্যবধানে বৃহত্তম জনসংখ্যা অধ্যুষিত একখণ্ড ভূমিতে বসবাসকারী যারা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, খাদ্যাভ্যাস, অনুভূতি প্রেরণায় সম্পূর্ণ এক পৃথক জাতিসত্তার মানুষ। অথচ তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হলো পাকিস্তান নামক স্বাধীন মুসলিম ধর্মরাষ্ট্রে। পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের তথা নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেণির বলে গণ্য করত। তারা ভালো করে জানত যে, পাকিস্তানকে তৎকালীন কাঠামো অনুযায়ী একটা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় বাঙালিরা কোনোদিনই পাকিস্তানের আনুগত্য মেনে নেবে না। তাই প্রথম থেকেই তারা সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ লুণ্ঠন করে পাকিস্তানের উন্নয়ন তৎপরতা এগিয়ে নেয়া। সে কারণেই সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তানিরা নির্মম শোষণ ও বৈষম্যের সৃষ্টি করে। যে ভ্রান্ত ধারণা তখন পাকিস্তানি শাসকরা উপলব্ধি করত, তা ছিল হয়তো বাঙালিদের পাকিস্তানিকরণ করতে পারলে পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। তাই প্রথমে তারা শুরু করে ভাষার ওপর আগ্রাসন। অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব তার পরামর্শদাতাদের পরামর্শে বলতে শুরু করলেন, ‘একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ পাকিস্তান জন্মের ১ বছর পরই পূর্ব বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে জিন্নাহ যখন এই উক্তি করলেন, তখন বাংলা মায়ের নির্ভীক সন্তানরা প্রতিবাদের আওয়াজ তুলল। নো, নো বলে চিৎকার করে উঠল। সেই নো টু উর্দু ল্যাঙ্গুয়েজ একদিন নো টু পাকিস্তানে রূপান্তরিত হলো। মাত্র ২৩ বছরের ব্যবধানে এ ধরনের ঘটনা ঘটে গেল। আসলে বাঙালি কখনো তার জাতিসত্তা হারিয়ে ফেলেনি। কয়েক সহস্র বছরের সমন্বিত সংস্কৃতিভিত্তিক ভাষাকে আশ্রয় করে যে জাতীয়তাবাদী চেতনা বাঙালি হিসেবে গড়ে ওঠেছিল, তা শুধুমাত্র পাকিস্তানের নাগরিক হওয়ার কারণে বাঙালি বিসর্জন দেয়নি। তাই ভাষার ওপর আগ্রাসনের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়েই তারা প্রতিহত করেছে। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করেছে। আরো ইতিহাস গড়েছে যে, ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো জাতি করেনি।

তবে সেখানে এসে আন্দোলন থেমে যায়নি। স্বায়ত্তশাসনের দাবির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে ভাষা আন্দোলন এক মহাজাগরণে রূপান্তরিত হয়েছে। তাই শুধু আজ বাংলা ভাষায়ই কথা বলছি না, স্বাধীন দেশে বসবাস করছি। যে মহান নেতার নিরবচ্ছিন্ন জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই অধিকার অর্জিত হয়েছে, তিনি হচ্ছেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। পাকিস্তান ঘোষণার পর পরই যখন তিনি কলকাতায় অবস্থানরত ও ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়ার জন্য ব্যাগ গুছাচ্ছিলেন, তখনই তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু বাঙালিরা স্বাধীন হয়নি। বাঙালিকে স্বাধীন করার মিশন নিয়েই তিনি কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলেন এবং স্বাধীন পাকিস্তানে এসে মাত্র ১ বছর পরেই তিনি ছাত্রলীগ গঠন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করলেন। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। ওই আন্দোলনে অনেকেই তাঁকে খাটো করে দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তিনি ছিলেন ওই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অগ্রদূত। ভাষার জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে প্রথম পর্যায়ে তিনি জেলও খেটেছেন। বিশেষ করে ওই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে রূপান্তরিত করে স্বাধীনতার সংগ্রামে রূপান্তরিত করার মহান কাজটি তিনিই করেছিলেন। স্বায়ত্তশাসনের যে আন্দোলনকে তিনি সুসংহত করে মহান মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তর করেছিলেন, তাই সত্যিকার অর্থে ছিল স্বাধিকার আন্দোলন। তিনি তাঁর ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এক জনজাগরণ সৃষ্টি করেন এবং ওই ৬ দফার মধ্যেই বাঙালির অধিকার, স্বাধীনতা ও বাঁচার দাবি সংযোজিত ছিল। পরবর্তী সময়ে ৬ দফা আন্দোলনই ১ দফাতে পরিণত হয়ে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়। ১৯৬০-এর দশকেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন জাতীয় নেতাকে এ বিষয়ে অবহিত করেছিলেন। শ্রদ্ধেয় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এক সময় যে পাকিস্তানকে সালাম দিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন, তা ছিল শেখ মুজিবের দর্শনভিত্তিক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম ঘোষণা। শেখ মুজিব হচ্ছেন সেই মহান নেতা, যিনি ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত ও ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন এবং বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বাঙালি জাতি মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসকদের পরাজিত করে বাঙালি জাতি স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটায়।

ভাষা আন্দোলন ছিল প্রকৃত অর্থেই একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে, কখনোই বাঙালি তার স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হতো না। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহান রাজনৈতিক কারিগর, যিনি ভালো করেই জানতেন যে, ওই সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনে রূপান্তর করা সম্ভব। ১৯৫২, ’৫৪, ’৫৮, ’৬২, ’৬৪, ’৬৬ ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি ঐতিহাসিক কাজটি সম্পন্ন করেন। ১৯৭০- এর নির্বাচনে তিনি ও তাঁর দল নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে, পূর্ব বাংলাকে শাসন করার নৈতিক অধিকার পাকিস্তান শাসকরা হারিয়ে ফেলেছে। পূর্ব বাংলার জনগণ তাঁকে শাসন করার গণরায় দিয়েছে, অন্য কাউকে নয়। পাকিস্তানি শাসকরা শেখ মুজিবের ওই কথা প্রত্যাখ্যান করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ওপর যুদ্ধ চালিয়ে দেয়। ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে ১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারিতে রাজপথে মিছিল বের করা হলে পাকিস্তান পুলিশ গুলি চালায়। এতে সালাম, রফিক, বরকত ও জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে শহীদ হন। ভাষা শহীদরা যে মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তা ইতিহাসে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। আর শেখ মুজিব তাদের আত্মত্যাগের পথ ধরে দীর্ঘ ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়ে জীবনের জয়গান গাইতে গাইতেই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলার আকাশ-বাতাস, মাঠ-প্রান্তর, নদী-সাগর সবই তাঁর হৃদয়কে আন্দোলিত করত। কথাবার্তায়, আচার-আচরণে, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার-দাবারে, অনুভূতি ও প্রেরণায় তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের তিনি ছিলেন প্রাণপুরুষ। ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত একটানা সংগ্রামই ছিল তাঁর জীবন সংগ্রাম। তাঁর কারণে বাঙালিরা আজ শুধু বাংলা ভাষায় কথাই বলছে না, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর পিতার মতো একজন খাঁটি বাঙালি। বাংলা ভাষায় তাঁর যথেষ্ঠ দখল রয়েছে, একাধিক পুস্তক তিনি বাংলা ভাষায় রচনা করেছেন। যদি কেউ তাঁর রচিত পুস্তক পড়েন, তাহলে বুঝবেন কত খাঁটি বাঙালি তিনি। ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ঐতিহ্যকে আশ্রয় করে তাঁর জীবন অবলম্বন। পিতার মতো তিনিও বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করেছেন।

বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদার স্বীকৃতি পেয়েছে- এটা শেখ হাসিনা সরকারের কারণেই সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব দরবারে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন-সার্বভৌম, উন্নত, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মর্যাদার আসনে তুলে ধরার জন্য শেখ হাসিনা সংগ্রাম করে চলেছেন। ২১ ফেব্রুয়ারির মতো জাতীয় দিবস আসলেই বুঝা যায়, কত গভীর অনুভূতিসম্পন্ন হৃদয় নিয়ে এসব জাতীয় দিন উদযাপন করেন। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হতে পেরেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে। শহীদ স্মৃতি অমর হোক। মহান ২১-এর চেতনায় উদ্ভাসিত হোক সমগ্র জাতি ও নতুন প্রজন্ম।

** ডা. এ স এ মা লে ক **
Link: Bhorerkagoj |  বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

আরও পড়ুন