বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। পৃথিবীতে যতগুলো স্বাধীন দেশ আছে তন্মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস অবিস্মরণীয়। বহু আন্দোলন সংগ্রাম ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এদেশের স্বাধীনতা। কত নির্যাতন, কত অবহেলিত, কত লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে এদেশের জনগণ। তার কোন ইয়ত্তা নেই। বুক ভরা আশা নিয়ে এ দেশের সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে।
দীর্ঘ নয় মাস রক্ত-ক্ষয়ী যুদ্ধ করার পর ত্রিশ লাখ মানুষের জীবনের বিনিময়ে এই দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পৃথিবীর ইতিহাসে দেশ স্বাধীন করতে বহু নেতার জীবন সংগ্রামের কথা শুনেছি। তাদের মধ্যে আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলাসহ, কিউবার ফিদেল ক্যাস্ত্রো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
ঠিক আমরাও এদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে পেয়েছি। এই স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে নাম না জানা অনেক ব্যক্তির অবদান রয়েছে। কিন্তু যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হচ্ছেন আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমান তরুণ সমাজে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যে বঙ্গবন্ধুকে চেনে না। আর চিনবেই বা না কেন? যার মহান আত্মত্যাগের ফলেই জন্ম হয়েছে বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্রের।
এই মহান নেতার শৈশব- কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মায়ের নাম সায়েরা খাতুন। চার মেয়ে ও দুই ছেলের সংসারে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান।
১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাত বছর বয়সে পড়াশোনা শুরু করেন। নয় বছর বয়সে তথা ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জে মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৭ সালে অর্থাৎ দেশবিভাগের বছর শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পাকিস্তান-ভারত পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।
বঙ্গবন্ধু ছাত্র জীবন থেকেই রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজনীতির প্রতি তার এক ধরনের ভালো লাগা, ভালো লাগার অনুভ‚তি সৃষ্টি হয়। আর এই রাজনীতির পথ চলা শুরু হয় ১৯৪০ সাল থেকে শুরু করে দেশের সকল রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে আমরা পেয়েছি এই এই স্বাধীন বাংলা।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান হন এবং সাড়ে তিন বছর দেশ পরিচালনা করেন। এর মধ্যে তিনি বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। সার্বিকভাবে রাষ্ট্রপ্রধান থাকাকালীন সময়ে সফলতার ছোঁয়া পেয়েছেন। তার উল্লেখযোগ্য সফলতার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ গঠন করা।
স্বল্প সময়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন ও তার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দাঁড় করানো তার জন্য ছিল একটি চ্যালেঞ্জিং এর ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু কখনো ইসলামকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেননি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন হল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। ইসলামিক ফাউন্ডেশন যা ২২ মার্চ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই গঠিত হয়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ গঠন করা হয়েছে দেশে ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রচার করে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে অবগত করা। ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যদি জানতে চাই তাহলে আমরা দেখতে পাব ইতিহাসের পাতায় এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিশদভাবে উল্লেখ করেছে।
দেশের যত মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র বা একাডেমী রয়েছে সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর সেগুলো পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য ধর্মীয় এবং সমাজসেবায় নিবেদিত সংগঠনসমূহকে আর্থিক সহায়তা দেয়া। ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির চর্চা, ইসলামী মনীষীদের চিন্তা ভাবনা সম্পর্কে এবং ইসলামে বিজ্ঞান ও সভ্যতার ক্ষেত্রে অবদানের ওপর গবেষণা পরিচালনা করা।
যার ফলশ্রুতিতে দেশের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা নিতে এবং ইসলামের আদর্শ নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ইসলামের মৌলিক আর্দশ বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ববোধ, পরমসহিষ্ণুতা, ন্যায়বিচার প্রভৃতি প্রচার করা ও প্রচারের কাজে সহায়তা করা এবং সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষার্থে ও নীতিমালা প্রণয়ন করে প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করে তা বাস্তবায়ন করা।
শুধু তাই নয় বরং ইসলামী মূল্যবোধ ও নীতিমালা মানুষের মধ্যে বিশ্বাস বা জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কিত গবেষণার আয়োজন করা ও তার প্রসার ঘটানোর জন্য মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অনুভ‚তির সৃষ্টি করা। এমনকি ইসলামের ইতিহাসের সাহিত্য ও সংস্কৃতিগুলো দেশের মানুষের ধর্মীয় কল্যাণে সুলভে প্রকাশ করা এবং সেগুলো মানুষের মধ্যে বিলি-বন্টন করার নিমিত্তে উৎসাহী করে তোলা।
দেশের মানুষের ধর্মীয় কল্যাণে ইসলাম ও ইসলামের বিষয় সম্পর্কিত বই-পুস্তক, সাময়িকী ও প্রচার পুস্তিকা অনুবাদ করা এবং সংকলন করা ও প্রকাশ করা। হতে পারে সেটা পবিত্র কোরান শরিফের বাংলা অনুবাদ অথবা ইসলাম সম্পর্কিত ইতিহাস, গবেষণা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক যেকোন বইয়ের বাংলা অনুবাদ করা। যার ফলে আমাদের দেশের মানুষ খুব সহজেই ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধ সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে পারবে।
মানুষের মধ্যে ধর্মীয় অনুভ‚তির বা ভালোবাসা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইসলামের ইতিহাস, দর্শন, সংস্কৃতি, আইন ও বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কিত বিষয়াদির ওপর সম্মেলন, বক্তৃতামালা, বিতর্ক ও প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। এতে করে আমাদের দেশের মানুষ ইসলামের বিধি-বিধান সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবে। সেই সাথে আমাদের দেশে যারা ইসলামী বিষয়ে গবেষণা ও অসামান্য অবদানের জন্য পুরস্কার ও পদক প্রবর্তন করা।
কেননা এটি বাস্তবায়ন করার ফলে অনেকেই ইসলামী গবেষণার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। আমাদের দেশে ইসলাম সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়া এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য সহায়তা করা। হতে পারে সেটি দেশের যেকোনো প্রান্তে ইসলামিক লাইব্রেরি প্রতিস্থাপন করা এবং যারা ইসলামিক গবেষণা করবে তাদের জন্য বৃত্তি প্রদান করা।
এছাড়াও দেশের অন্যতম ও জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের ব্যবস্থাপনা ও উন্নতিবিধান করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা। বর্তমান ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধ প্রচার এবং ইসলামের সম্পর্কিত কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ফাউন্ডেশনটির প্রতিটি বিভাগীয় কার্যালয়, ৬৪টি জেলা কার্যালয়, দেশের প্রতিটি বিভাগে ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসহ এবং ২৯ টি ইসলামিক প্রচারণা কেন্দ্রের সহায়তায় কার্যক্রমসমূহ বাস্তবায়ন করে আসছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় বিধি-বিধান সম্পর্কে আলোচনা, গবেষণা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ মূলনীতি লিপিবদ্ধ করে অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেন। বাংলাদেশ থেকে হজ প্রেরণের এর যাত্রা শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে। যা ১৯৭২ সাল থেকে প্রশাসনিক ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এছাড়াও দেশে ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ গঠন করার পাশাপাশি ইসলাম প্রসারের লক্ষ্যে ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে দেশের কামিল মাদ্রাসায় অনার্স কোর্স চালু করেছেন।
যোগ্য আলেমদের ফতোয়া প্রদানে আদালতের ঐতিহাসিক রায়ে সুযোগ করে দিয়েছেন। জাতীয় শিক্ষানীতিতে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগে বাস্তবায়ন করেন। বঙ্গবন্ধু শুধু দেশে ইসলামে প্রসারে ক্ষান্ত হননি বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেছেন।
যেমন: ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরাইল যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমর্থনে ১ লাখ পাউন্ড চা, ২৮ সদস্যের মেডিকেল টিমসহ একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী পাঠানো হয়। ১৯৭৪ সালে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এতে আরবসহ মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের ভাব উজ্জ্বল হয় এবং মুসলিম বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে সুদৃঢ় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গড়ে ওঠে।
পরিশেষে, বঙ্গবন্ধুর ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন ও প্রসারের লক্ষ্যে যেসব অবদান রেখেছেন তা আমাদের জন্য সত্যি বড় গৌরবের বিষয়। আমাদের মাঝে তার অবদান গুলো ইতিহাসের পাতায় যুগ যুগ ধরে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বলতে হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধু ও সপরিবারকে হত্যা করেছে।
যার ফলশ্রুতিতে, এদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আর সেই জন্যই আমরা এই মহান নেতাকে প্রত্যেক বছরের ১৫ আগস্টে বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে স্মরণ করি। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাতের কামনায় প্রার্থনা করি। আর তাই তো কবি বলেছেন, ‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা যমুনা গৌরি বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’।
মু. সায়েম আহমাদ
মানব কণ্ঠ ০৯ আগস্ট ২০২১, লিঙ্ক