বাঙালির জাতিসত্তা গড়ে তোলার জন্য বাংলা ভাষাই যে শেষ্ঠতম একক সেটি নিয়ে যার যা ধারণাই থাকুক না কেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে সেই অনন্য একককেই ধারণ করেছিলেন। সেজন্য পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম ধর্মঘট সংগঠিত করার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পালিত ধর্মঘটটি ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম সফল ধর্মঘট। এ ধর্মঘটে বঙ্গবন্ধু নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে :
[IB report on Sheikh Mujinur Rahman, who was arrested on 11.3.1948… This subject (Sheikh Mujibur Rahman) was arrested on 11.3.48 for violating the orders…He took very active part in the agitation for adopting Bengali as the State language of Pakistan, and made the propaganda at Dacca for general strike on 11.3.48 on this issue. (Secret Documents of Intelligence Branch (IB) on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, V-1, page-7)]
অনুবাদ : ১১-০৩-১৯৪৮ তারিখে গ্রেপ্তার হওয়া শেখ মুজিবুর রহমানের বিষয়ে গোয়েন্দা শাখার রিপোর্ট। আদেশ অমান্যের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে ১১-০৩-১৯৪৮ তারিখে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার এই আন্দোলনে খুবই সক্রিয় ছিলেন এবং এই ইস্যুতে ১১-০৩-৪৮ তারিখে সাধারণ ধর্মঘটের জন্য ঢাকাতে প্রচার চালিয়েছেন। (জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর গোয়েন্দা শাখার (আইবি) গোপন নথি খ–১, পৃ.-৭) পাকিস্তানি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে একজন সাধারণ ছাত্রনেতা পাকিস্তানি হানাদারদের নজরে পড়েন সেদিন থেকেই। তার কারণও রয়েছে যথেষ্ট।
এছাড়া বিভিন্ন দলিল তথ্যাদিতে উল্লিখিত যে, ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সমকালীন রাজনীতিবিদসহ ১৪ জন ভাষাবীর সর্বপ্রথম ভাষা-আন্দোলনসহ অন্যান্য দাবি সংবলিত ২১ দফা দাবি নিয়ে একটি ইস্তেহার প্রণয়ন করেছিলেন। ওই ইস্তেহারে ২১ দফা দাবির মধ্যে দ্বিতীয় দাবিটি ছিল রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত। ঐতিহাসিক এ ইস্তেহারটি একটি ছোট পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়েছিল যার নাম ‘রাষ্ট্রভাষা-২১ দফা ইস্তেহার- ঐতিহাসিক দলিল’। উক্ত পুস্তিকাটি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্বীকৃত। এই ইস্তেহার প্রণয়নে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ছিল অনস্বীকার্য এবং তিনি ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। ১৫০নং মোগলটুলীর ‘ওয়ার্কার্স ক্যাম্প’ ছিল সে সময়ে প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীদের মিলনকেন্দ্র। ওয়ার্কাস ক্যাম্পের কর্মীরা বাংলা ভাষাসহ পাকিস্তানের অন্যান্য বৈষম্যমূলক দিকগুলো জাতির সামনে তুলে ধরেন। ভাষা আন্দোলনের সপক্ষের কর্মীবাহিনী এখানে নিয়মিত জমায়াত হতো এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার নানা কর্মপরিকল্পনা এখানেই নেয়া হতো। শেখ মুজিব, শওকত আলী, কামরুদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ ছিলেন এই ক্যাম্পের প্রাণশক্তি। এ সম্পর্কে বাহাউদ্দিন লিখেছেন, ‘সাতচল্লিশে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও ১৫০ মোগলটুলী বিরোধী রাজনীতির সুতিকাগার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। কলকাতা থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, জহিরুদ্দিন, নঈমুদ্দিনের মতো নেতারা প্রথমে ১৫০ মোগলটুলীতেই জমায়াতে হন।’ (সূত্র : ১৫০ মোগলটুলী- বাহাউদ্দীন চৌধুরী, জনকণ্ঠ ঈদসংখ্যা-২০০৮)। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনটির ভূমিকা খুবই স্মরণীয়। ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার ও সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি ছিল অন্যতম দাবি।
২৬ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘট চলাকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তমদ্দুন মজলিস প্রধান অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে এক সমাবেশ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিযারিং কলেজ ও ইঞ্জিনিযারিং স্কুলের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে দলে দলে এ সমাবেশে যোগদান করেন। ২৬ ফেরুয়ারি ধর্মঘটে শেখ মুজিবের ভূমিকা প্রসঙ্গে ড. মাযহারুল ইসলাম লিখেছেন, ‘এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এই মিছিলের সমগ্র ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন। শেখ মুজিবসহ সব প্রগতিবাদী ছাত্রনেতাই বাংলা ভাষার দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটি সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেন।’ (সূত্র : ভাষা আন্দোলন ও শেখ মুজিব, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৯-২০)
সামগ্রিক তথ্যগুলো পর্যালোচনা করলে এটা স্পষ্ট হয় যে পাকিস্তান জন্ম নেয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলা ভাষাকেই তার রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি যেভাবে যে অবস্থায় পেরেছেন সংগঠিত করার চেষ্টা করেছেন। একই সঙ্গে বাংলা ভাষা আন্দোলনই তাকে তরুণ রাজনৈতিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চে গ্রেপ্তার হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের এক টার্নিং পয়েন্ট। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ঐতিহাসিক ১১ মার্চের গুরুত্ব এবং গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়, মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ (সূত্র : দৈনিক আজাদ, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১)। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। সেদিনই সকাল ৯ ঘটিকার সময় আমি গ্রেপ্তার হই। আমার সহকর্মীদেরও গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ধাপে ধাপে আন্দোলন চলতে থাকে।’
১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে তদানীন্তন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে আট দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের পূর্বে জেলখানায় আটক ভাষা আন্দোলনের কর্মী রাজবন্দিদের চুক্তিপত্রটি দেখানো হয় এবং অনুমোদন নেয়া হয়, অনুমোদনের পর চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। কারাবন্দি অন্যদের সঙ্গে শেখ সাহেবও চুক্তির শর্ত দেখেন এবং অনুমোদন প্রদান করেন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং চুক্তির শর্ত মোতাবেক শেখ সাহবেসহ অন্য ভাষাসৈনিকরা কারামুক্ত হন। এই ঐতিহাসিক চুক্তির ফলে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকার এ দেশবাসীর কাছে নতিস্বীকারে বাধ্য হয়েছিল। ১৫ মার্চ আন্দোলনের কয়েকজন নেতৃবৃন্দকে মুক্তিদানের ব্যাপারে সরকার গড়িমসি শুরু করেন। এতে শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষিপ্ত ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।
১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে পূর্ববাংলা আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে এক মিছিল বের হয়। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন সদ্য কারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।
মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময বেশ কিছুটা বাড়াবাড়ি হয়েছে বলে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা থেকে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন, ‘এমএলএদের বিরুদ্ধে মোটামুটিভাবে বিক্ষোভ হয়। তাদের গালাগালি ও অনেক ক্ষেত্রে মারধর করা হয়। মোয়াজ্জেম ডাক্তার নামে বাগেরহাটের এক এমএলএকে ধরে নিয়ে মুসলিম হলে ছাত্ররা আটক করে রেখেছিল। সেখানে গিয়ে আমি তাকে ছাড়াই। শওকত সেদিন সন্ধ্যা বেলায় বেশ আঘাত পায় পুলিশের হাতে’ (সূত্র : ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গ- কতিপয় দলিল, ২য় খ-, কৃত- বদরুদ্দীন উমর : ঢাকা, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৫ : পৃ. ৩২৫) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে ছিলেন, যেমন- আবদুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান, আবদুল মমিন তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে এবং পরে হাসপাতালে থাকাকালীন আন্দোলন সম্পর্কে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন।
নাজিমুদ্দিনের ভাঁওতার চুক্তি : বাংলা ভাষা নিয়ে সরকারের প্রস্তাবিত চুক্তির সংশোধনীতে অন্যান্য দাবি ছাড়াও শেখ মুজিব ও ছাত্র নেতাদের মুক্তি দাবি করা হয়। আট দফার চুক্তিপত্রটি সরকারের পক্ষে খাজা নাজিমুদ্দিন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কমরদ্দীন আহমদ স্বাক্ষর করেন। যদিও নাজিমুদ্দিন সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তবুও বাংলা ভাষা সম্পর্কে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়নি, চুক্তি পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এসব দাবিতে ছিল-
১। অদ্য পাঁচ ঘটিকায় সব রাজবন্দীর মুক্তি। ২। ইত্তেহাদ, স্বাধীনতা ও অন্যান্য খবরের কাগজের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা ওইদিনই তুলে নেয়া। ৩। আজই ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হবে। ৪। আজই ব্যবস্থা পরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য অনুমোদনসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে। ৫। পুলিশি নির্যাতনের জন্য ইনকোয়ারি কমিশন করা এবং দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হবে। ৬। যে সব গু-া শ্রেণীর লোক আন্দোলনে ছাত্রদের মারপিট করেছে তাদের শাস্তি দেয়া হবে। ৭। এ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী কোন ছাত্র বা অন্য কাউকে ‘ভিকটিম’ করা হবে না।
উপরোক্ত দাবিগুলো ছাত্রদের আগেই তৈরি করা ছিল। আলোচনার সময় আরও যে নতুন দাবি ওঠে তা খাজা নাজিমুদ্দিন নিজ হাতে লিখে ৮ নম্বর শর্ত বলে মেনে নেন।
৮। সংগ্রাম পরিষদের সহিত আলোচনার পর এই মর্মে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে- এই আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই।
খাজা নাজিমুদ্দিনের এই চুক্তি ছিল ভাঁওতাবাজি। জিন্নাহ সাহেবের ঢাকা আগমনকে নিষ্কণ্টক করা- যাতে ওই সময় কোন আন্দোলন না হয়। কিন্তু জিন্নাহ সাহেবকে বাংলা ভাষার ব্যাপারে তার ওই চুক্তির কথা খাজা নাজিমুদ্দিন হয় কিছু বলেননি, না হয় তাকে রাজি করাতে পারেননি।
তবে চুক্তি মোতাবেক ১৫ মার্চ শেখ মুজিব এবং নেতারা জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন।
ওই সময় অন্যান্য বন্দী রণেশ দাশগুপ্ত, ধরণী রায় প্রমুখের অন্য মামলার অজুহাতে মুক্তি দিতে সরকার অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু ভাষা আন্দোলনের বন্দীরা বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে চাপাচাপি করলে ১৫ মার্চ রণেশ দাশগুপ্ত ও ধরণী রায়কে বন্দীদের সঙ্গে ছেড়ে দেয়া হয়। (বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস মোহাম্মদ হান্নান, পৃ. ৪২)।
ঢাকা, প্রথম লেখা ২৩ জানুয়ারি ২০২০। সর্বশেষ সম্পাদনা ২৩ আগস্ট ২০২০ ॥ মতামত লেখকের নিজস্ব।
মোস্তাফা জব্বার ২৪ আগস্ট ২০২০ লিংক