কারাবন্দি শেখ মুজিবের ভাষা আন্দোলন

ভাষা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব

তাপস হালদার

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন আন্দোলনের অগ্রসৈনিক। বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনের ভূমিকাকে কখনো সামনে আনা হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা বহুদিন ধরেই ছিল। কিন্তু ইতিহাসকে কখনো হত্যা করা যায় না, সময়ের পরিক্রমায় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়। বাঙালিরা ভাষা আন্দোলন থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এই নেতৃত্বই বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় নেতায় পরিণত করে। তাঁরই ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন ধাপে ধাপে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ

ভাষা একটি জাতির আত্ম পরিচয়ের প্রতীক। ভাষা শুধু মনের ভাব প্রকাশ করে তা নয়, এটা জাতির অস্তিত্ব। আমরা বাংলায় কথা বলি বলেই জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি। পৃথিবীর প্রতিটি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা আছে। কিন্তু বাংলা ভাষার ওপর বিভিন্ন যুগে বারবার আঘাত এসেছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যে কোনো কিছুর মিল না থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে ১২০০ মাইল দূরের দুটি ভূখ-কে এক করে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম হয়।

পাকিস্তানি শাসক চক্র ক্ষমতায় গিয়ে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষাকে বাদ দিয়ে মাত্র ৭.২ শতাংশ মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। কিন্তু বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তা মেনে নেয়নি।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই  ১৪ ডিসেম্বর ২১ দফা ইশতেহার প্রণয়ন করা হয়। ইশতেহারের দ্বিতীয় দফাটি  ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সংক্রান্ত। ইশতেহারটি পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। এই ইশতেহার প্রণয়নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম স্বাক্ষরদাতা। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের যুবকদের উদ্যোগে ‘গণতান্ত্রিক যুবলীগ’ গঠিত হয়।

সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবগুলো পাঠ করেন সে সময়কার তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে ভাষা সম্পর্কিত প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা কি হইবে তৎসম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভার জনসাধারণের ওপর ছাড়িয়ে দেওয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলিয়া গৃহীত হোক।’ এভাবে বঙ্গবন্ধুই ভাষার দাবি প্রথমে উত্থাপন করেন।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রলীগের যৌথ সভায় শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, আবুল কাশেম, রণেশ গুপ্ত, অজিত গুহসহ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এটিই প্রথম হরতাল। সেদিন হরতালে নেতৃত্বদানের কারণে বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রথম কোনো রাজনৈতিক নেতার প্রথম গ্রেফতার। বঙ্গবন্ধুসহ নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার হলে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ১৫ মার্চ রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পেয়েই ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র সভায় সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে বঙ্গবন্ধু সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তমদ্দুন মজলিস, মুসলিম ছাত্রলীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগকে ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম পরিষদ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এসব কারণেই ১৯৪৯ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রচারপত্র বিলি করার সময় গ্রেফতার হন এবং দীর্ঘ সময় জেলে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে বঙ্গবন্ধুকে জেলে আটক করে রাখা হয়।

যেসব জ্ঞানপাপী ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন বলে থাকেন তারা কৌশলে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে ছোট করার চেষ্টা করেন, তিনি কি কারণে জেলে ছিলেন সেটি এড়িয়ে যান। বঙ্গবন্ধু কিন্তু জেলে থেকেও নীরব ভূমিকায় ছিলেন না। কখনো পোপনে নেতা-কর্মীদের পরামর্শ দিয়েছেন আবার কখনো অনশন করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবি জানান। কিন্তু তাঁর দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার করার বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস প্রতিবাদ জানায় এবং দাবি করে বাংলা ও উর্দু দুই ভাষাকেই রাষ্ট্র ভাষা করতে হবে। এই সময় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদ্দুন মজলিস সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম’ পরিষদ গঠন করে।
খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েই ঘোষণা দেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা।’ সেদিন বঙ্গবন্ধু রাজবন্দি হিসেবে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘বারান্দায় বসে আলাপ হলো এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার।

এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইন সভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে আইন পাস করে নেবে’। পরের দিন রাতে অনেকে আসল। সেখানেই ঠিক হলো আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত সৃষ্টি করা শুরু হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন হয় এবং ২১ ফেব্রুয়ারি আন্দোলনের দিন ধার্য করা হয়।

১৯৫২ সালের ২ থেকে ১২ অক্টোবর চীনের পিকিংয়ে এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় শান্তি সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু চীন সফরে গিয়েছিলেন। সেখানেও বাংলায় বক্তব্য দিয়েছেন। বক্তব্য নিয়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে’ লিখেছেন, ‘আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্প্যানিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না?

ভারত থেকে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘মুজিব ভাই আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে পারে নেই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।’
১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করলে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে এবং সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সংবিধানের ২১৪(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়, উর্দু ও বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু প্রণীত সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা কবে বাংলা।
বাঙালি মুসলমান প-িতেরা যখন উর্দু, ফার্সি কিংবা আরবি ভাষার পরিচয় নিয়ে সংশয় ছিলেন তখন বঙ্গবন্ধু মাতৃভাষা বাংলার প্রশ্নে আপোসহীন অবস্থান নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলমানেরা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। আরব দেশের লোকেরা আরবি বলে।

পারস্যের লোকেরা ফার্সি বলে, তুরস্কের লোকেরা তুর্কি ভাষা বলে, ইন্দোনেশিয়ার লোকেরা ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় কথা বলে, মালয়েশিয়ার লোকেরা মালয়া ভাষায় কথা বলে, চীনের মুসলমানেরা চীনা ভাষায় কথা বলে।’ এ সম্বন্ধে অনেক যুক্তিপূর্ণ কথা বলা চলে। শুধু পূর্ব পাকিস্তানের ধর্মভীরু মুসলমানদের ইসলামের কথা বলে ধোঁকা দেওয়া যাবে ভেবেছিল কিন্তু পারেনি। যেকোনো জাতি তার মাতৃভাষাকে ভালোবাসে। মাতৃভাষার অপমান কোনো জাতিই কোনো কালে সহ্য করে নাই।
বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনা গত বছর একুশে পদক প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্যে বলেন, ‘আমাদের ভাষা মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন সূচনা করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরই উদ্যোগে ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় এবং আমাদের ভাষার জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সাল থেকে।

ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা অর্জন।’ তিনি যথার্থই বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচায়’ ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস সুন্দর তুলে ধরা হয়েছে। দীর্ঘদিন পর হলেও মানুষ সঠিক ইতিহাস জানতে পারছে। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন আন্দোলনের অগ্রসৈনিক। বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনের ভূমিকাকে কখনো সামনে আনা হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা বহুদিন ধরেই ছিল। কিন্তু ইতিহাসকে কখনো হত্যা করা যায় না, সময়ের পরিক্রমায় স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হয়। বাঙালিরা ভাষা আন্দোলন থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনে উজ্জীবিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এই নেতৃত্বই বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় নেতায় পরিণত করে। তাঁরই ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন ধাপে ধাপে স্বাধীনতার আন্দোলনে পরিণত হয়। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য
সম্প্রীতি বাংলাদেশ

আরও পড়ুন