ভাষা আন্দোলন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা – মহিউদ্দিন আল-আমান শাহেদ

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন
বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের দ্বার উন্মোচিত হয়। দেশ বিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তান অপেক্ষা পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের বাস ছিল। তাদের ভাষা ছিল বাংলা। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষীর বাস সেহেতু, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জোর দাবি উঠে পূর্ব বাংলায়। পরবর্তীতে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়।
 ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করতে বহু নেতা-কর্মী অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁদের মধ্যে নেতৃত্বদানকারী উল্লে­খযোগ্য ব্যক্তিবর্গ হচ্ছেন—মওলানা আব্দুল হামিদ খাঁন ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু), শওকত আলী, শামসুল হক, নাইমুদ্দিন আহমেদ, অলি আহাদ, কমরুদ্দিন আহমেদ, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব, আব্দুল মতিন, আবুল কাশেম, মোঃ তোয়াহা, গোলাম মাওলা, গাজীউল হকসহ অনেকে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। ইতিহাসের পাতায় তাঁদের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
এমনই একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শওকত আলী (আমার বাবা)। শওকত আলীর জন্ম ১৯১৮ সালের ২০শে এপ্রিল, পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়ায়। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান শওকত আলী ছাত্র জীবন থেকেই জড়িত ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে। ভাষা আন্দোলনের সূচনালগ্ন থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং নেতৃত্ব দেন। ১৯৪৭ সালের প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, ১৯৪৮ সালের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং ১৯৫২ সালের সর্বদলীয়  রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে তাঁর সাহসী ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম হরতাল সফল করতে শওকত আলী অত্যন্ত সাহসীকতার পরিচয় দেন। পিকেটিং এর এক পর্যায়ে তিনি পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন এবং গ্রেফতার হন। ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে পুরান ঢাকায় উর্দুভাষী ঢাকাইয়ারা আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। পরবর্তীতে ঢাকাইয়াদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে শওকত আলীর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও পত্রিকা সম্পাদক সানাউল­াহ নূরী তাঁর—‘৪০-এর দশকের রাজনীতি এবং ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন: চকবাজারে ছিলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের অক্লান্ত কর্মী শওকত ভাই। তিনি ছিলেন ঢাকার স্থানীয় লোক। বিভাগ পূর্বকালে মুসলিম লীগ সংগঠক হিসাবে পুরাতন শহরে সকলের সুপরিচিত ছিলেন তিনি। সুখে-দুঃখে সবসময়ে তিনি থাকতেন সাধারণ মানুষের পাশে। মিটফোর্ড রোড, চকবাজার,  মৌলবীবাজার এবং লালবাগ এলাকায় ছিল তাঁর ব্যাপক জনপ্রিয়তা। এই মহল্ল­াগুলোতে প্রথমদিকে শওকত ভাইকে সঙ্গে নিয়েই আমরা পোস্টার লাগাতাম, বিলি করতাম প্রচারপত্র। স্ট্রিট কর্ণার মিটিংও করেছি অনেক। কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পায়নি। বরং স্থানীয় জনসাধারণ নানাভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। প্রচারপত্র ছাপানোর জন্য চাঁদা পর্যন্ত দিয়েছেন। (ঐতিহ্য-১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ফাল্গুন ১৩৯২, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬)
শওকত আলী’র ১৫০ নং চক মোগলটুলীর বাসভবনটিও (লীগ অফিস নামে পরিচিত ছিল)। ঐতিহাসিক দিক থেকে অনেক গুরুত্ব বহন করে। এই বাড়িটি ছিল ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার ও স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী বাহিনীর মিলনক্ষেত্র। রাজনীতি চর্চার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ছিল এই বাড়িটি। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কার্যক্রম এখান থেকেই পরিচালিত হতো। ১৯৭১-এ মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটি ছিল এই বাড়িটি। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন  বৈঠকসহ নানাবিধ কার্যক্রম পরিচালিত হতো। কয়েকবার এ বাড়িটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। তারা একাধিকবার শওকত আলীকে হত্যার অপচেষ্টা চালায়।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত কাছের মানুষ, ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা ছিলেন শওকত আলী। বঙ্গবন্ধু ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তে অনেক জায়গায় শ্রদ্ধাভরে শওকত আলী (বঙ্গবন্ধুর শওকত মিয়া) সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন।
 ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির জনকের নিহত হওয়ার দুঃসংবাদে শওকত আলী ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন এবং চিকিত্সাধীন অবস্থায় ১৮ই আগষ্ট ১৯৭৫-এ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে জুরাইন কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
ভাষা আন্দোলনে তাঁর কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবময় অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শওকত আলী-কে ২০১১ সালে মরণোত্তর ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করেন এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন মহান ভাষা আন্দোলনে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১০ সালে শওকত আলীর নামে ধানমন্ডিস্থ ৪/এ সড়কটির নামকরণ করেন। তিনি জাতির গর্বিত সন্তানদের একজন।
 অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, যেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য এত আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠিত হলো সেই বাংলা ভাষা অদ্যাপি মর্যাদার আসনে আসীন হতে পারেনি। এমনকি এখনো অনেক জায়গায় আমরা বাংলার বিকৃত উচ্চারণ লক্ষ করি। বিশেষ করে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো এবং বেসরকারি এফ এম রেডিও চ্যানেলগুলোতে বাংলার বিকৃত উচ্চারণ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এগুলো শুধরানোর এখনই সময়।
পরিশেষে, আর একটি কথা বলতে চাই। অপ্রিয় শোনালেও সত্য যে, বর্তমান সরকারের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবাররা সরকারের দেওয়া অনেক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ভাষা  সৈনিকদের পরিবারগুলো এ ধরনের সকল সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়ই আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। এটাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের অনুরোধ- আপা, আপনিও একজন ভাষা  সৈনিকের সন্তান। সেই দাবি নিয়েই আমরা আপনার কাছে আমাদের কথা বলার অনুমতি চাচ্ছি। আমাদের কথা বলার সুযোগ করে দেন।
সুত্র ইত্তেফাক 

আরও পড়ুন