জিয়া নন, বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষক: হাই কোর্ট

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ও বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ সালামের দায়ের করা এক জনস্বার্থ রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায় দেয়।

সেইসঙ্গে আদালত জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক উপস্থাপন করে প্রকাশিত “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র”-এর তৃতীয় খণ্ড বাতিল ঘোষণা করেছে। এই খণ্ডটি দেশ-বিদেশের সব স্থান থেকে বাজেয়াপ্ত ও প্রত্যাহারেরও নির্দেশ দেওয়া হয়।

এ বাজেয়াপ্তের আদেশ যথাযথভাবে কার্যকর করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হযেছে।

আদালতের রায়ে বলা হয়, যারা এরকম ইতিহাস বিকৃতির সঙ্গে জড়িত তারা সংবিধান লংঘন করেছে। যারা বিকৃত ইতিহাস রচনা করেছেন সেই প্রত্যয়ন কমিটির বিরুদ্ধে ধোকাবাজি ও সংবিধান লংঘনের অভিযোগে সরকার চাইলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

হাইকোর্ট দেশের সব মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রমে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস বাধ্যতামূলকভাবে সন্নিবেশ করার জন্যও সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে।

আদালত রায়ে বলেছে, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র” এর তৃতীয় খন্ডে স্বাধীনতা ঘোষণা সংক্রান্ত তথ্য স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের পরিপন্থী ও আইন বাহির্ভূত বিবেচনায় বাতিল ঘোষণা করা হল।

আদালতের এ রায়ের প্রতিক্রিয়ায় অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম ইনায়েতুর রহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্ষমতায় বসে স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছেন তা বিকৃত করার যে অপচেষ্টা করছিল এ রায়ের মাধ্যমে তার মৃত্যু হলো।

“বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, প্রকাশনা, দলিলপত্র পর্যালোচনা করে আদালত সেই সত্যটিই এই ঐতিহাসিক রায়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।”

রিট আবেদনকারীর কৌসুলি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ষড়যন্ত্রকারীদের অপচেষ্টা নস্যাৎ করে বঙ্গবন্ধুই যে স্বাধীনতার প্রকৃত ঘোষক আদালতের মাধ্যমে সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হলো।”

রিট আবেদনকারী ডা. এম এ সালাম রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “সত্যের জয় হয়েছে। ভবিষ্যত প্রজন্ম স্বাধীনতার ঘোষণার প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারবে। এ রায়ে জাতির জয় হয়েছে।”

ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসির মামুন বলেন, “যা সত্য ছিল আদালত রায়ে তা তুলে ধরেছে। এই রায়ের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে- যারা ইতিহাস বিকৃতির জন্য দায়ী সরকার তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে।”

গত ২০ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা ডা. এম এ সালামের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’ এর তৃতীয় খন্ড কেন বাজেয়্প্তা করা হবে না এবং ইতিহাস বিকৃতকারীদের বিরুদ্ধে কেন আইনগত পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে না তার কারণ জানতে চেয়ে হাইকোর্ট সরকার ও সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুলনিশি জারি করেছিল।

পরে রিটটিতে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ও মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল্লা খান পক্ষভুক্ত হন। গত ১৯ এপ্রিল ডা. এম এ সালাম রিটটি দায়ের করেন।

রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। সরকার পক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম ইনায়েতুর রহিম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোস্তফা জামান ইসলাম। সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলম। হামিদুল্লাহ খানের পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমাদ।

শুনানি শেষে দেওয়া আদালতের রায়ের অভিমতে বলা হয়, স্বাধীনতার ইতিহাস অমূল্য সম্পদ। এটা জানার অধিকার প্রতিটি বাঙালির রয়েছে। এই ইতিহাস পরিবর্তন গণবিরোধী, ১৪ কোটি মানুষের সঙ্গে প্রতারণার সামিল ও সংবিধানের লংঘন।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিক প্রত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে আদালতের রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের পূর্বেই শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বিএনপি নেতা মওদুদ আহমেদের লেখা ‘ইরা অব শেখ মুজিব’ গ্রন্থের কথা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা করেছেন।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত লে. কর্নেল জিয়াউর রহমানের লেখা জাতির জনক শিরোনামের প্রবন্ধের উল্লেখ করে আদালত বলেন, জিয়াউর রহমান ওই প্রবন্ধে ২৫ মার্চের বিস্তারিত বিবরণ দেন। কিন্তু কোথাও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি। তিনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক বলে আখ্যায়িত করেন। এতে জিয়াউর রহমানের সততার প্রকাশ পায়।

১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি হিসেবে জিয়াউর রহমানের দেওয়া ভাষণের উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সম্পর্কে জিয়াউর রহমান তার ভাষণে বলেছিলেন ‘কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে আপনাদের উদ্দেশে কথা বলার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।’ কিন্তু তিনি ওই ভাষণেও নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করেননি।

শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে এতে বলা হয়, ছাত্রনেতা থেকে তিনি আওয়ামী লীগ নেতা এবং এরপর বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার হয়েছেন। জীবনের তিন ভাগের একভাগ শেখ মুজিব কারাগারে কাটিয়েছেন। তিনি একাত্তুরের ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতারের পর ৯ মাস পাকিস্তানের কারাগারে ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক সরকার তার মনোবলে একটুও চির ধরাতে পারেনি। কোনো মুচলেকায় তিনি স্বাক্ষর করেননি।

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি কেবল শ্রেষ্ঠ মুুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার ঘোষকই ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা একাত্তুরের ২৬ মার্চ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এই ঘোষণার কথা সংবিধানের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

“এ অবস্থায় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র’-এর তৃতীয় খন্ডে প্রকাশিত স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত তথ্য অসত্য। ইতিহাস বিকৃত করার জন্যই এই প্রকাশনা।”

এতে আরও বলা হয়, স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত অসত্য তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে ধোকাবাজি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। বর্তমান প্রজন্মকে প্রকৃত ইতিহাস থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন