বাঙালির ভাষা আন্দোলন সারা বিশ্বেই আজ স্বীকৃত। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একটি ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনে এ আন্দোলনের অনন্য ভূমিকার কথা এখন সবারই জানা। কিন্তু এ আন্দোলনের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে এখনো গভীর আলাপ-আলোচনা হতে দেখি না। পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিকাশমান বাঙালি মধ্যবিত্তের আর্থসামাজিক মুক্তির আশা পক্ষপাতমূলক নয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানের শুরুর দিনগুলোতেই নিরাশায় পরিণত হয়। এ শ্রেণীর ছাত্র প্রতিনিধিরা মূলত অবাস্তব পাকিস্তান রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ভাষার ওপর আক্রমণ তাদের হতাশাকে আরও তীব্র করে। আর তাই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। প্রথম পর্বের ভাষা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৪৮ সালেই। এর পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় ১৯৫২ সালে। ওই সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটে ভাষার জন্য প্রাণ দেয়ার এক মর্মান্তিক ঘটনা। এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন যে তরুণরা, তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন পূর্ব বাংলার উদীয়মান রাজনীতিক শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সহনেতারা। একই সঙ্গে তারা কাজ করেছেন প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও গণতান্ত্রিক যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত কলকাতাফেরত শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার কারণে রাজপথ থেকেই গ্রেফতার হন। ১১ মার্চের হরতাল, পিকেটিংসহ কর্মসূচির পুরো রূপরেখা তৈরি করেছিলেন শেখ মুজিব। স্মরণে রাখা চাই, ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে যে ১৪ জন রাজনৈতিক নেতাকর্মী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানিয়ে ২১ দফা দাবিসহ একটি পুস্তিকা প্রচার করেছিলেন, তার মধ্যে শেখ মুজিবও ছিলেন। ওইসব দাবির মধ্যে দুটো দাবি ছিল রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কিত। গোয়েন্দারা যেসব গোপন প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, তাতেও স্পষ্ট বলা হয়েছে, শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটেই তিনি তার সহনেতাদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছাত্রদের সংগঠিত করা এবং ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট পালনের সময় তিনি কীভাবে গ্রেফতার হন, তার বিস্তারিত বিবরণ পাই এম আবদুল আলীমের লেখায় (‘ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব: তারিখ ও ঘটনাপঞ্জি, ‘অন্যদিন’ ঈদ সংখ্যা, ২০১৯)। এটি ছিল তার জীবনের প্রথম রাজনৈতিক কারাবরণ। ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ মুক্ত হয়েই তিনি ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সামনের সারিতে থেকে এ আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান। তবে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি কারাবন্দি ছিলেন। ১৯৫০ সালেই তিনি বন্দি হন। বন্দি অবস্থায়ও তিনি ভাষা আন্দোলনকারী তার সহযোগী নেতাদের সঙ্গে সংযোগ রাখেন। কারাগার থেকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে তিনি ছাত্রলীগ ও ভাষা আন্দোলনের অন্য কর্মীদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিতেন। সেজন্য তাকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। স্থানান্তর হওয়ার পথেও তিনি নারায়ণগঞ্জে নেতাকর্মীদের ভাষা আন্দোলনে কী করতে হবে, তার নির্দেশনা দিয়ে যান। এরপর আন্দোলন দানা বাঁধে। তিনি তার সহনেতা মহিউদ্দীনের সঙ্গে অনশন করেন। এর মধ্যেই একুশে ফেব্রুয়ারির মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। জেলখানা থেকে তিনি চিরকুট পাঠাতেন এবং আন্দোলনকে চাঙ্গা রাখতেন। ১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তিনি জেলখানা থেকে মুক্তি পান। এর কয়েক দিন পর থেকেই তিনি ফের সারা পূর্ব বাংলা ঘুরে ঘুরে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালির স্বার্থ রক্ষার পক্ষে জোরালো বক্তব্য দিতে থাকেন। এ আন্দোলন যে কেবল ভাষার প্রশ্নেই সীমাবদ্ধ ছিল না, সে বিষয়ে আমরা বিস্তর গবেষণা করেছি (দেখুন আতিউর রহমান ও অন্যান্য ‘ভাষা আন্দোলনের আর্থসামাজিক পটভূমি’ ইউপিএল)। এ আন্দোলন আর্থসামাজিক প্রেক্ষিত সংক্ষিপ্ত আকারে আমরা এভাবে বর্ণনা করতে পারি। ওই গবেষণায় ধরা পড়ে: পাকিস্তানের উদ্ভব হয়েছিল তৎকালীন মুখ্য রাজনীতিকদের জনতুষ্টিবাদী সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মাধ্যমে। তবে পাকিস্তান আন্দোলনে সাধারণ বাঙালি মুসলমানদের অংশগ্রহণের পেছনে তাদের আর্থসামাজিক বঞ্চনার দিকটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। এর বস্তুগত প্রেক্ষাপট বেশ জোরালো ছিল। অপেক্ষাকৃত অনুন্নত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে মুসলমান শিক্ষিতজনদের মনে অনেক সময়ই বস্তুগত ও হিন্দু অধিপতি শ্রেণীর শোষণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতো। একই সঙ্গে এ প্রতিক্রিয়ার সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটও প্রণিধানযোগ্য। অপেক্ষাকৃত অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রাধান্যের কারণে মুসলমান সম্প্রদায়ের মনে এক ধরনের প্রান্তিকীকরণের আশঙ্কা কাজ করত। উল্লেখ্য, পাটের উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাওয়া ছাত্রছাত্রীরাই ‘আলোকিত’ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভিত্তি তৈরি করেন। তারাই পাকিস্তান আন্দোলনের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেন। এদের সঙ্গে কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের নাড়ির যোগ ছিল। তারা গ্রাম ও শহরের মাঝে সেতুবন্ধের কাজ করতেন।
পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালি মুসলমান কেন এতটা সক্রিয় ছিলেন, তা বোঝা যায় ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের মতামত থেকে।
‘আমাদের সামনে সেদিন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রশ্নটিই বড় করে ধরা পড়েছিল। কাল বিচারে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পরিপক্ব যে সময়টাকে বলা হয়, সেটা ছিল পাকিস্তান দাবির পক্ষে এক প্লাবনের যুগ।’ বিচারপতি হাবিবুর রহমান শেলী (আতিউর রহমান ও অন্যান্য, প্রাগুক্ত)।
‘আমাদের হলে মফস্বল থেকে অনেক ছাত্র আসত। যারা বিদ্যুতের আলো কীভাবে নেভাতে হয় তা জানত না, ট্রেনের শব্দকে ঝড়ের শব্দ ভেবে আজান দিতে আরম্ভ করত। হিন্দু ছেলেরা সে যুগ অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছিল।’ (ভাষাসৈনিক কামরুদ্দিন আহমদ ‘বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মপ্রকাশ’ (১৩৮২)।)
পূর্ব পাকিস্তানকে ঘিরে মধ্যবিত্তের যেসব স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল, সেগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নিচের কয়েকটি: ক. জমিদারের শোষণের অবসান, মধ্যবিত্ত পাবে জমির মালিকানা। খ. রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দেবে বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী। গ. ভূমি, শিক্ষা, জনপ্রশাসন সংস্কারের মাধ্যমে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিফলন ঘটবে।
বাস্তবে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি হাঁটতে থাকে এসব আকাঙ্ক্ষার উল্টোপথে। সুবিধাবাদী রাজনীতির প্রতীকে পরিণত হয় পাকিস্তান। আমলা, মহাজন, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও তাদের মদদদাতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় রাজনীতি, প্রশাসন ও অর্থনীতি।
মধ্যবিত্ত, কৃষক ও শ্রমিকদের স্বপ্নের কথা আমলেই নেয়া হয়নি নতুন রাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থায়। পাশাপাশি নেমে আসে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। বাঙালির অগ্রসর সাংস্কৃতিক চিন্তা ও অহংকারের ওপর আসে আঘাত। এ আক্রমণ প্রথমেই আসে বাংলা ভাষার ওপর। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করার ঘোষণা তাদের মনোজগতে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করে।
পাকিস্তান আন্দোলনের তরুণ কর্মীদের মধ্যে হতাশা ছড়িয়ে পড়ে গভীরভাবে। স্বপ্নভঙ্গের পর তাদের জাগিয়ে তোলেন বাঙালি নেতারা। বিশেষ করে মওলানা ভাসানী তরুণ নেতৃত্বকে উৎসাহ দিলেন। আর শেখ মুজিব সংগঠিত করলেন ছাত্রনেতাদের। ছাত্রনেতারা সংগঠিত করলেন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের। এভাবেই আটচল্লিশ থেকে বায়ান্নপর্বে ভাষা আন্দোলন সংস্কৃতির চৌহদ্দি থেকে রাজনীতির অঙ্গনে চলে এল।
স্বপ্নভঙ্গের পর নতুন করে জেগে ওঠা ছাত্র ও যুবসমাজকে সংগঠিত করার প্রক্রিয়ায় শেখ মুজিব ও তার সহনেতাদের অনুপ্রেরণামূলক নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের ঘোষণাপত্র থেকেই অনুভব করা যায় তরুণদের স্বপ্নভঙ্গের গভীরতা।
‘আমরা মধ্যবিত্ত যুবসমাজ স্বপ্ন দেখেছিলাম পাকিস্তানে আমরা চাকুরি পাইব, ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশের সুযোগ পাইব, গৃহ পাইব, পাইব উন্নত সংস্কৃতি ও উন্নত জীবনধারণের মান। কিন্তু বাস্তবতার নিষ্ঠুর আঘাতে সে স্বপ্ন আমাদের ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। অভাবের তাড়নায় আমরা জর্জরিত, শহরে, বাসস্থানের অভাব আমাদের এক বিরাট সমস্যা।’ (পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের ঘোষণাপত্র ১৭ মার্চ ১৯৫২)। এমন আশাভঙ্গের প্রেক্ষাপটেই ভাষা আন্দোলন তরুণদের এক নতুন পথের দিশা হিসেবে হাজির হয়।
ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে সচেতন বাঙালির প্রাথমিক প্রতিবাদের কথা বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে বেশ স্পষ্ট করেই তুলে ধরেছেন।
‘(১৯৪৮ সালে) বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি (জিন্নাহ) যখন আবার বললেন, “উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”—তখন ছাত্ররা তার সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, “না, না, না”। জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তার মুখের ওপর তার কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কোনোদিন বলেননি, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান]
তখনো কাটেনি পাকিস্তানের ঘোর। সব ঢাকাবাসী একইভাবে সমর্থন করেনি ভাষা আন্দোলনকে। ‘তমদ্দুন মজলিস’-এর প্রধান নেতা অধ্যক্ষ আবুল কাসেম যথার্থই লিখেছেন, ‘…ক্যাম্পাসে তখনকার শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্র “মুসলিম হল” ও “ফজলুল হক” হলেও আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলার ব্যাপারে বৈঠক করার চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি। ঢাকাবাসীদের কাছ থেকেও প্রথমে সমর্থন পাওয়া যায়নি।’ বামপন্থী ছাত্রনেতা মোহাম্মদ তোয়াহাও এই মত সমর্থন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘জনসাধারণকে এমন ধারণা দেয়া হচ্ছিল যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তুলে ছাত্ররা পাকিস্তান ও ইসলামী আদর্শের খেলাপ করছে।’
১৯৪৮-৫২ পর্বেই ভাষা আন্দোলন পায় এক নয়া জাতীয় চরিত্র। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষও এ আন্দোলনের মূল চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে থাকে। এর প্রধান কারণ হলো এ আন্দোলন তাদের মনের গহিনে নাড়া দিতে পেরেছিল।
বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক চাওয়া-পাওয়া আন্দোলনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। ঢাকা থেকে আন্দোলন শুরু হলেও বিভিন্ন মফস্বল, এমনকি গ্রামগঞ্জেও ছড়িয়ে পড়ে এর দাবানল। ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও অন্যান্য বর্গের মধ্যবিত্তের পাশাপাশি শ্রমিক, কৃষক, ছোটখাটো ব্যবসায়ীরাও আন্দোলনে অংশ নেয়। আর সে কারণেই বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি একেবারেই নড়বড়ে হয়ে গেল।
এ আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল মধ্যবিত্তের হাতেই। আমরা ১৯৮৫ সালে ১২৩ জন অংশগ্রহণকারীর ওপর জরিপ করে জানতে পারি যে:
৫০ শতাংশেরও বেশি আন্দোলনকারীর পিতা শহরে বাস করতেন।
৭০ শতাংশ আন্দোলনকারীর পিতা ৫ একরের বেশি জমির মালিক ছিলেন।
৬৮ শতাংশ আন্দোলনকারী কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
নেতৃত্বে থাকা এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গ্রামের সঙ্গে, কৃষক-শ্রমিকের সঙ্গে ছিল গভীর সংযোগ। আর তাই এ আন্দোলন বাঙালি জাতি গঠনের শুরুর দিনগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। নিঃসন্দেহে, সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল ন্যায়সংগত আন্দোলনের সাফল্যের চাবিকাঠি। অংশগ্রহণকারীদের একজন এ আন্দোলনের রূপান্তরের কথা এভাবে বলেছেন:
‘…আমাদের মাইক্রোফোনে উর্দুতেও বক্তৃতা দেয়া হয়, পরিষ্কারভাবে বোঝানো হয় যে উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই নয়, আমাদের দাবি বাংলা ভাষার স্বীকৃতির জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। প্রতিদিন বিকালে পরবর্তী কর্মসূচির খবর নিতে হলো প্রাঙ্গণে সমবেত হতো হাজার হাজার লোক। ওইদিন (২৩ ফেব্রুয়ারি, লেখক) ঢাকার সর্দাররা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তাদের সমর্থন জানালেন। সর্দারদের সমর্থনকে আমরা খুবই বিশেষ নজরে দেখতাম।’ [সাবেক অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’, ড. মোহাম্মদ হান্নান (১৯৯২)]
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ব্যতিক্রমী এক বাঙালি মধ্যবিত্তের মানস খুঁজে পাওয়া যায়। এই মধ্যবিত্ত ছিল প্রলেতারিয়েতের প্রায় কাছাকাছি। তারা গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে এক অভিনব মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। যেমন নিম্নমধ্যবিত্ত দোকান কর্মচারীরা মালিকদের সহায়তাকারী সুবিধাবাদিতার বদলে সক্রিয় বিক্ষোভে যুক্ত হয়েছেন।
গ্রাম থেকে উঠে আসা মধ্যবিত্তদেরও ছিল শ্রমিক-কৃষকদের মতোই অনিশ্চয়তার জীবন। তাই শ্রমিক-কৃষকদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নিজেদের চাওয়া-পাওয়াকে মিলিয়ে দেখতে তাদের অসুবিধা হয়নি। নিজেদের পাকিস্তানি শাসকের অংশ মনে না করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মোহনায় এসে তাদের ঐক্যের আকাঙ্ক্ষা নানাভাবে তারা প্রকাশ করেছেন। আন্দোলনে মাঠে, শিল্প-সাহিত্যে, জীবন চলার নানা দিকে তারা বাঙালিয়ানার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আর এ প্রকাশের সামনের সারিতে ছিলেন বাঙালির উদীয়মান প্রাণপুরুষ শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধুর সংশ্লিষ্টতা ছিল খুবই নিবিড়। তিনি এবং তার সহনেতাদের কল্যাণেই ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্ত পাটাতন তৈরিতে এমন অনন্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিল। তাই উপসংহারে বলা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকা মধ্যবিত্তের শক্তির জায়গাই ছিল সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা। অবিবেচক পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের বঞ্চনার শিকার সব শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ করেই এগিয়েছে বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্বে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের যে বীজ বপন করা হয়েছিল তাই পরবর্তী সময়ে প্রস্ফুটিত হয়েছিল এমন সফলভাবে। মধ্যবিত্ত নেতৃত্বের (বিশেষত বঙ্গবন্ধুর) রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় মধ্যবিত্তের গণসংশ্লিষ্টতা একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল বলেই ভাষা আন্দোলন ও বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক একটি আধুনিক রাষ্ট্রের বিকাশের ধারাটি এমন পরিপক্বতার সঙ্গে বিকশিত হতে পেরেছিল।
ড. আতিউর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
Source: Bonikbarta: Link | Date: মার্চ ১৭, ২০২০