বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। মূলত বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপেশাদার ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের শ্রম অধিকারের একটি উল্লেখযোগ্য আকাক্সক্ষা, বিশেষভাবে তাদের অমানবিক কর্মপরিবেশ, বেতন বৈষম্য নিরসন এবং শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিবাদের ঝড় তুলেছিলেন। এটি ছিল শ্রমিক আন্দোলনের সূচনা। পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দীর্ঘ অভিযাত্রার প্রতিটি পর্বে রয়েছে শ্রমজীবী মানুষ ও শ্রমিকদের সক্রিয় এবং বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ।
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের বেতন বৈষম্য নিরসন, চাকরির নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি একটি শালীন কাজের পরিবেশের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে আসছিলেন। অব্যাহত সংলাপ এবং তাদের প্রত্যাশিত দাবি পূরণ না হওয়ায় কর্মচারীরা ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত ধর্মঘট এবং শ্রমিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে সহায়ক শক্তি হিসেবে এগিয়ে আসে। সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা একটি সভার আয়োজন করে। যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতিস্বরূপ ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ থেকে ক্লাস বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এটি ছিল ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে ছাত্রসমাজের একাত্মতা প্রকাশের একটি অসাধারণ দৃষ্টান্ত। ছাত্রসমাজের ওই বৈঠকে শিক্ষার্থীরা কর্মচারীদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের সংহতি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তরুণ ছাত্রনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু এই শ্রমিক আন্দোলনকে সমর্থনই করেননি, সক্রিয়ভাবে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণও করেছিলেন। তিনি তখন আইন বিভাগের ২য় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীরা তাদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা এবং চাকরির অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন। তখন তাদের বেতন ছিল মাত্র ১১-১৪ টাকা। ছিল না তাদের কোনো লিখিত চাকরির চুক্তি। এভাবে তারা সর্বদা অন্যায্য হেনস্তার শিকার হতেন এবং অমানবিক জীবনযাপন করতেন। তাছাড়াও তারা অন্য পেশাজীবীদের মতো আবাসনসহ অন্যান্য আনুপাতিক সুবিধা পেতেন না।
ছাত্রদের সংশ্লিষ্টতায় কর্মচারীদের আন্দোলন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জন্য চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্মচারী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করায় ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেন। ৪ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয় ৬ জনকে, হল থেকে বহিষ্কার করা হয় ১৫ জনকে, ১৫ টাকা জরিমানা করা হয় ৫ জনকে এবং ১০ টাকা জরিমানা করা হয় ১ জনকে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের নির্দেশানুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই আন্দোলনকে নেতিবাচক পন্থায় দমন করার উদ্দেশ্যে ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন।
আন্দোলনের মতো নেতিবাচক পন্থা অবলম্বনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ টাকা জরিমানা করা হয়। শাস্তিপ্রাপ্ত অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শর্ত মেনে জরিমানা পরিশোধ করেন ও মুচলেকা দিয়ে ছাত্রত্ব বজায় রাখেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শর্ত মেনে ১৫ টাকা জরিমানা পরিশোধ এবং মুচলেকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে ফিরে আসার প্রস্তাব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৯ সালের ১৮ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানের ছাত্রত্ব বাতিল করে তাঁকে বহিষ্কার করে। শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন ও নেতৃত্বদান ছিল তাঁর অসাধারণ দূরদর্শী ও জ্ঞানদীপ্ত গণতান্ত্রিক চেতনার বহির্প্রকাশ। অধিকন্তু এটি ছিল তৎকালীন সময়ের সাহসী ন্যায়ভিত্তিক শ্রমবান্ধব সমাজ বিনির্মাণে একটি দুঃসাহসী পদক্ষেপ। কর্মচারীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণ ছিল যথার্থ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
শ্রমিকদের অধিকার ও দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে পালিত হয় মে দিবস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর শ্রমিকরা শ্রম-স্বাধীনতা ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ভোগ করছেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১ মে-কে মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন। তারপর ১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান এক ভাষণে বাংলাদেশের সর্বস্তরের শ্রমিক ও মেহনতি জনগণকে সচেতনভাবে দেশ গড়ার শপথ গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। তিনি শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির সংগ্রামে শক্তিশালী ও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান শ্রমজীবীদের।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর শ্রমিক শ্রেণির সংগঠনগুলোতে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আদর্শিক চর্চার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় দলীয় রাজনৈতিক আদর্শিক ধারার চর্চা। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করতে শুরু করলে শ্রমিক সংগঠনগুলোতে তার প্রতিফলন ঘটে। জামায়াতের মতাদর্শের শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন নামে শ্রমিক সংগঠন গঠিত হয়। এভাবেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে শ্রমিক সংগঠনগুলো। ফলে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থরক্ষার পরিবর্তে শ্রমিক সংগঠনগুলো রাজনৈতিক নেতাদের গদি রক্ষা এবং গদিতে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত থাকে।
বঙ্গবন্ধুর মতো তাঁরই সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাও একজন শ্রমিক দরদি মানুষ। তিনি সর্বদা শ্রমিকদের জন্য ভাবেন। ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সামরিক আইন জারি করে নিজে রাষ্ট্রপতি হন। তিনি মানুষের মৌলিক ও ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার হরণ করেন। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতি এরশাদ সব বিরোধী দলের নেতাদের গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। সভার শুরুতে শেখ হাসিনা পিতার মতো শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি তোলেন। জেনারেল এরশাদ তার দাবি মেনে নিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ তুলে নেন।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিল, কলকারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন। শেখ হাসিনা তার পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৯৯৯ সালে ১১টি বন্ধ টেক্সটাইল মিল শ্রমিকদের মালিকানায় দেন। ২০১৩ সালে গার্মেন্টস শ্রমিকরা মজুরি বৃদ্ধি ও বকেয়া পাওনা আদায়ের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। শ্রমিক আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য একটি কুচক্রী মহল এই সুযোগে গার্মেন্টস কারখানা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৈরি পোশাক শিল্পের ৫২টি রেজিস্টার্ড শ্রমিক ফেডারেশন ও ২৫টি রেজিস্ট্রেশনবিহীন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করে গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ গঠন করেন। ২০১৩ সালে ৫ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। শ্রমিক নেতাদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠক করেন এবং শ্রমিক নেতাদের কথা মনোযোগসহকারে শোনেন ও তাদের দাবি-দাওয়া মেনে নেন।
১৯৮৪ সালে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ছিল ৫৭০ টাকা। ১৯৯৪ সালে তা বৃদ্ধি করা হয় ৯৩০ টাকায়। ২০০৬ সালে তা করা হয় ১৬৬২ টাকা। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে চার বছর পর ২০১০ সালে তা বৃদ্ধি করে তিন হাজার টাকায় উন্নীত করেন। পরবর্তী তিন বছর পর ২০১৩ সালে ন্যূনতম মজুরি তিন হাজার টাকার স্থলে পাঁচ হাজার তিনশ’ টাকা এবং পাঁচ শতাংশ হারে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি দেওয়া হয়। এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে পাঁচ হাজার তিনশ’ টাকার স্থলে আট হাজার টাকায় উন্নীত করেন।
সরকার শ্রম বিধিমালা ২০১৫ সংশোধন করেছে, কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতায়ন করেছে এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আরও বিধান করেছে। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ দেওয়ার জন্য মালিকদের নির্দেশ দেন।
ট্রেড ইউনিয়ন করা শ্রমিকদের ন্যায়সঙ্গত ও আইনগত স্বীকৃত অধিকার। ট্রেড ইউনিয়নকে একদিকে যেমন শ্রমিকদের সুসংগঠিত করে, অন্যদিকে শিল্পকারখানায় সুষ্ঠু মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। সরকার ১ সেপ্টেম্বর সংশোধিত শ্রম বিধিগুলোর একটি গেজেট জারি করেছে, যাতে ৯৯টি বিধিতে পরিবর্তন এনেছে এবং অন্য দুটি বিধি বাতিল করেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার মতো মনে করেন শিল্পের শ্রমিক ও মালিকদের সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে।
লেখক : ব্যারিস্টার মো. গোলাম কবির ভূঁইয়া,
শ্রমবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ট্রেড ইউনিয়ন, হিথরো এয়ারপোর্ট, যুক্তরাজ্য
দৈনিক জনকণ্ঠ