বাঙালির ভাষা সংগ্রামের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু, তখন শেখ মুজিব ছিলেন সংগ্রামের সামনের কাতারে। প্রকাশ্যে, গোপনে, রাজপথে, সভা-সমাবেশে, কারাগারে, চিকিৎসাধীন অবস্থায়, সর্বদা তিনি ছিলেন কর্মী, সংগঠক, উপদেষ্টা বা নেতা। পরিতাপের বিষয় যে বঙ্গবন্ধুর ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তে জাগ্রত থাকার ও অবদান রাখার বিষয়টি বহুকাল ধামাচাপা দেয়া অবস্থায় ছিল, ঠিক যেমন ছিল ধামাচাপা দেয়ার প্রবণতা তার মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার বিষয়টি।
বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে ১৯৪৭ সালেই গঠিত হয় গণতান্ত্রিক যুবলীগ। সংগঠনটির প্রথম সম্মেলনেই রাষ্ট্রভাষা-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং তরুণ সংগঠক শেখ মুজিবুর রহমান সিদ্ধান্তগুলো পাঠ করেন। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন- ‘পূর্ব-পাকিস্তান কর্মী সম্মেলন প্রস্তাব করিতেছে যে, বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লিখার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।’ (সূত্র: ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, গাজীউল হক)।
১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে বাংলা ভাষার দাবির সপক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযানে তার অগ্রণী ভূমিকা পালন ও খাজা নাজিমুদ্দীনের বাসভবনে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা চলাকালীন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার মিছিলে শেখ মুজিব নেতৃত্বদান করেন। সে বছরেরই ডিসেম্বরে তার উদ্যোগে তার ও অন্যান্য ১৪ জন ভাষাবীরের স্বাক্ষরসংবলিত ইশতেহার প্রস্তুত করে তা বই আকারে প্রকাশ করা হয়।
১৯৪৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ও অক্লান্ত পরিশ্রমে গঠিত হয় ছাত্রলীগ। এই ছাত্র সংগঠনটি ভাষা অন্দোলনসহ প্রতিটি প্রগতিশীল ছাত্র ও গণ-আন্দোলনে বিশাল ভূমিকা রাখে। গঠিত হওয়ার সময় সংগঠনটির মাধ্যমে ১০ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়, যার মধ্যে ছিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলা করা, সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের নিয়োগ এবং বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার দাবি।
১৯৪৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘটের ও ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মিছিলে ও এর পুরো ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালনায় শেখ মুজিব বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান করেন। তিনি তমুদ্দুন মজলিশের সঙ্গে মুসলীম ছাত্রলীগের যোগসূত্র স্থাপন ও শক্তিশালী করেন ও সংগঠনদ্বয়ের ১৯৪৮ সালের ২ মার্চের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করেন। এই সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন নজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহম্মদ তোয়াহা, আবুল কাসেম, রণেশ দাশ গুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখ। এই সভায়ই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
ভাষা অন্দোলনের জন্য ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছিল এক অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন দেশব্যাপী সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। শেখ মুজিব এই হরতালে ও অন্য কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বদান করেন ও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন এবং সেদিনই রাজপথ থেকে গ্রেপ্তার হন।
সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিব ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে এক সাধারণ ছাত্রসভা শেষে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে মিছিলে নেতৃত্ব দেন। পরদিন ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বানে সভায় শেখ মুজিব বিশেষ ভূমিকা রাখেন। মুজিব ও তার সহকর্মী তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, আবদুল মতিন, শামসুল হক প্রমুখ যুবনেতাদের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব ভাষা আন্দোলনকে একটি প্রবল শক্তিশালী গণ-আন্দোলনে পরিণত করে। শেখ মুজিব অসংখ্যবার কেবল ভাষা আন্দোলনের জন্যই কারাবরণ করেন ও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন।
পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, শেখ মুজিবকে আন্দোলনের উত্তাল মুহূর্তগুলোতে ও সংগ্রামের গতিপথ নির্ধারণী পরিকল্পনা প্রণয়ন থেকে দূরে রাখার জন্য ১৯৪৯ সালে গ্রেপ্তার করে দীর্ঘ আড়াই বছর করান্তরালে রাখা হয়, যার ফলে তিনি বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে রাজপথে ছিলেন না। তবে আন্দোলনের গতিপথ নির্ধারণে তিনি কারান্তরাল থেকেই নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘শেখ মুজিব জেলে থেকেই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন। অন্যান্য রাষ্ট্রভাষা সংগ্রামের নেতৃবৃন্দ, যেমন আব্দুস সামাদ আজাদ, জিল্লুর রহমান, কামরুজ্জামান, আব্দুল মমিন, সকলেই উল্লেখ করেছেন যে বঙ্গবন্ধু জেলখানা থেকে ও হাসপাতাল থেকে চিরকুটের মাধ্যমে নির্দেশ পাঠাতেন।’
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বেগবান হতে শুরু করে। ৪ ফেব্রুয়ারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালিত হয়। জনতার ঢল নামে রাজধানী ও দেশের সব শহরের সড়কে। কারান্তরীণ মুজিব আন্দোলনকারী নেতা শামসুল হক চৌধুরী ও আব্দুস সামাদ আজাদের মাধ্যমে সংবাদ পাঠিয়েছেন, এখন আন্দোলনকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য অবিলম্বে মিছিল-সহকারে আইনসভা ঘেরাও করতে হবে ও আইনসভার সদস্যদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে হবে। তিনি একুশে ফেব্রুয়ারি হরতাল হবে বলেও জানান। কারাগারে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন তখন রাষ্ট্রভাষার দাবিতে অনশনরত। তিনি আরও জানান, আন্দোলনকারীদের অবশ্যই রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য আওয়াজ তুলতে হবে। রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে পাকিস্তানিরা মুজিবকে অবিলম্বে ঢাকা থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ও অনশনরত মুজিবকে ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে ফরিদপুরে স্থানান্তরিত করে। মুজিবের মুক্তির দাবিতে ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশ হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্ররা সব বাধা উপেক্ষা করে রাজপথে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিল করে আইনসভার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায় ও সালাম-বরকতসহ অগণিত ছাত্রকে হত্যা করে।
১৯৫২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয়। পরবর্তী বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি শোক দিবস হিসেবে পালিত হতে থাকে। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনে শেখ মুজিব অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। সেদিনই আরমানীটোলা ময়দানে শেখ মুজিব ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার আহ্বান জানান ও আবারও বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান আইনসভার সদস্য হন ও হক মন্ত্রিসভার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে যোগ দেন। সেখানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৫৬ সালে শেখ মুজিব আইন পরিষদে সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলি বাংলা ভাষায় ছাপানোর প্রস্তাব করেন। আইনসভার পরবর্তী অধিবেশনে শেখ মুজিব বলেন, ‘পাকিস্তানের জনগণের শতকরা ৫৬ ভাগ লোকই বাংলা ভাষায় কথা বলে, রাষ্ট্রীয় ভাষার প্রশ্নে কোনো ধোঁকাবাজি করা যাবে না। পূর্ববঙ্গের জনগণের দাবি এই যে, বাংলাও রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক।’
১৬ ফেব্রুয়ারি আইনসভার অধিবেশনেও তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। এই মহান নেতা কখনোই জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ের ব্যাপারে কোনো আপসকামিতায় যাননি। সে জন্যই শেখ মুজিব হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা। তার অবিরাম সংগ্রামের ফসল ছিল ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারির সাংবিধানিক পরিবর্তন ও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি।
পাকিস্তানের জন্মের শুরু থেকেই তরুণ মুজিবের বাঙালির অধিকার আদায়ে সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন আন্দোলনে জড়িত হওয়ায় এবং তার প্রজ্ঞা, মেধা, জনগণকে সংগঠিত করার ও নেতৃত্বের গুণাবলি, বিশেষত তার ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে এই উদীয়মান তরুণ নেতার বিষয়ে চিন্তিত করে তোলে। নানা অছিলায় তাকে নিষ্ক্রিয় করার মানসে পাকিস্তানি শাসকরা তাকে হেনস্তা করার প্রক্রিয়া শুরু করে।
১৯৪৭-৪৮ সালে তাকে বেশ কয়েকবার কারাবন্দি করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র মুজিবের বিশ্ববিদ্যালয়ে বিচরণ বন্ধ করার লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের মার্চে শুধু চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট সমর্থন করায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে সেই বছরেরই অক্টোবরে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্বদানের অছিলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইতিমধ্যে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ও শেখ মুজিব সেই দল গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ও দলীয় কার্যক্রম সুসংহতকরণে আত্মনিয়োগ করেন। রাজনীতিতে মুজিবের এই পদযাত্রা শাসকগোষ্ঠীকে শঙ্কিত করে তোলে। তাই ১৯৪৯ সালের এই কারাবন্দি প্রলম্বিত করা হয় ও শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হয় দীর্ঘ আড়াই বছর পর ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে কারান্তরালে শেখ মুজিব রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আমরণ অনশন পালন করে যেতে থাকেন ও একপর্যায়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাকিস্তান সরকার তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি স্থানান্তরিত করে। কিন্তু পরে নানা অছিলায় চিকিৎসা না দিয়ে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরিত করে। কারাবন্দি থাকাকালীন পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক অঙ্গনে, বিশেষত সভা-সমাবেশে ও রাজপথে শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ্য ভূমিকার অভাব প্রবলভাবে অনুভূত হতে থাকে। মওলানা ভাসানীসহ অন্য নেতারা সরকারের কাছে মুজিবের আশু মুক্তি দাবি করেন।
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৭ সাল থেকে যে আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে, তা ১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ না করা পর্যন্ত বিভিন্নভাবে বজায় থাকে। তাই ১৯৫২-র মহান ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত সময়কে আমরা ভাষা আন্দোলনের তৃতীয় ধাপ বলতে পারি। ১৯৪৭ সালের ১ অক্টোবরে ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, যা সে বছরেরই ডিসেম্বরে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তখন থেকেই এই সংগঠন ধীরে ধীরে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিতকরণের লক্ষ্যে জনমত গঠন শুরু করে ও ছাত্রদের সংগঠিত করার জন্য সভা আয়োজন, পুস্তিকা ও লিফলেট বিতরণ করা শুরু করে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে এটি নানভাবে বিবর্তিত হয়। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ সংগঠনটি পুনর্গঠিত হয়। এই পুনর্গঠনটির মাধ্যমে একই মঞ্চে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এ পর্যায়ে এই সংগঠনের মাধ্যমে সংগ্রামের মঞ্চে যুক্ত হয় গণ-আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, তমুদ্দুন মজলিশ ও বিভিন্ন ছাত্রাবাসের প্রতিনিধিরা। মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর ও ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রত্যক্ষ্য অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই সংগ্রামকে বেগবান করা। মূলত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্বের ভূমিকায় চলে আসে।
পরে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সম্মেলনে সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিব এক জ্বালাময়ী বক্তব্যে মুসলিম লীগের মুখোশ খুলে ফেলার জন্য সবাইকে আহ্বান জানান। তিনি রাষ্ট্রভাষার বিষয়ে সরকারকে উদ্দেশ করে গণভোট আয়োজন করার আহ্বান জানান। বাংলা ভাষাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবিটি ছিল একটি নমনীয় দাবি, যার মাধ্যমে দেশের অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে কোনোভাবেই হীন প্রতিপন্ন করার বা বাংলাকে অন্য ভাষার ওপরে স্থান দেয়ার কোনো প্রকার বাসনার প্রতিফলন ছিল না। যদিও পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ জনগণের এই ভাষাকে উর্দু বা অন্য যেকোনো ভাষার পরিবর্তে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটিও ছিল যৌক্তিক। উল্লেখ্য, পাকিস্তানে উর্দু ভাষাভাষীর সংখ্যা ১৯৫২ সালে ছিল মাত্র ৭ শতাংশ। এ ছাড়া ততদিনে বাংলা ভাষা বিশ্বের দরবারে একটি অত্যন্ত সম্মানজনক অবস্থানে ছিল। ১৯১৩ সালেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এশিয়ায় প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। বাংলা সাহিত্য ততদিনে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত, জীবনানন্দ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ দিকপালদের পদচারণে মুখরিত। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেই রেনেসাঁর যুগে এই ভাষার ওপর বর্বর আগ্রাসন বাঙালিদের মেনে নেয়া ছিল প্রশ্নাতীত। সেই আঙিকে ভাষা আন্দোলন ছিল একটি অপরিহার্য জাতীয় আন্দোলন।
১৯৫২ সালের ১৭ এপ্রিলের এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সম্মেলন সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবের পদচারণে ছিল মুখরিত। তিনি বলেন, ‘একমাত্র মুসলিম লীগের অনুসারী ও পাকিস্তানি শাসকদের তোষণে নিয়োজিত কিছু গণমাধ্যম ছাড়া দেশের আপামর জনতা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চায়। এটি বাংলার মানুষের ন্যায্য দাবি।’ সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দানের দাবিতে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ২২টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সম্মেলনের সিদ্ধান্তের আলোকে শেখ মুজিব কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের মাধ্যমে ও সব সমমনা সংগঠনের অংশগ্রহণে বন্দি মুক্তি দিবস হিসেবে ১৯৫২ সালের ৫ ডিসেম্বর নানা কর্মসূচি পালনের নির্দেশ দেন। ভাষার জন্য আটক রাজবন্দিদের মুক্ত করা ছিল একটি অতিজরুরি কাজ। কারণ পাকিস্তানি শাসকরা নানা অছিলায় ভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী ছাত্র, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব ও কর্মী সংগঠকদের কারান্তরালে রেখে ভাষা অন্দোলনকে স্তিমিত করার প্রয়াসে লিপ্ত ছিল। ৫ ডিসেম্বরের নানা কর্মসূচির মধ্যে ছিল আরমানীটোলার মাঠের বিশাল জনসভা। শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ্য তত্ত্বাবধানে ও নেতৃত্বে আয়োজিত সভায় বয়োজ্যেষ্ঠ আতাউর রহমান খান সভাপতিত্ব করেন। মুজিব আবার দ্ব্যর্থ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘কোন মূল্যে মওলানা ভাসানীসহ অন্য রাজবন্দিদেরকে মুক্ত করতে হবে।’ সভা অনুষ্ঠান রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ও গণপরিষদের বিলুপ্তির দাবিতে উত্তাল হয়ে ওঠে।
অমর একুশের পথ ধরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাংলার জনতা তাদের সব আশার প্রতিভূ যুক্তফ্রন্টকে প্রাদেশিক পরিষদে এনে দেয় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন পায়, যা মোট আসনের ৯৪ শতাংশ ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি বাংলার মানুষকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায়। এই ষড়যন্ত্রের পথ ধরেই আসে আইয়ুব-মোনেম-ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্র। সমান্তরালভাবে বেগবান হতে থাকে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের মাধ্যমেই শেখ মুজিব রূপান্তরিত হন বাংলার মানুষের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুতে। তার নেতৃত্বে অনেক ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, লাখো শহীদের প্রাণের বিনিময়ে, লাখো মা-বোনের অসীম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাই স্বাধীন বাংলাদেশ।
লেখক: জহুরুল আলম
সাহিত্যিক ও অধ্যাপক, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
প্রকাশিত