স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশের পথ দেখান বঙ্গবন্ধু

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

২০২১ সালের দুটি অনন্য উপলক্ষ- স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবর্ষ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হয়েছে। উদযাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। এই উদযাপনের বছরেই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রথম রূপকল্পের (ভিশন-২০২১) মূল উপজীব্য ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল বাস্তবায়নের দৃষ্টান্ত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের এই সাফল্যের অভিযাত্রায় একটি মাইলফলক অর্জন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ। ২০১৮ সালের ১২ মে এটি উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রযুক্তিতে অগ্রগামিতায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। এদিন বিশ্বের ১৯৮টি দেশের মধ্যে ৫৭তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্য্যাটেলাইটের এলিট ক্লাবের সদস্য হয়। এটা আমাদের জন্য শুধু গর্বের নয়, মর্যাদাকরও।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের চার বছর পূর্তিতে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট নিয়ে ভাবনা শুরু কবে, কখন এবং কোন প্রেক্ষাপটে তা নিয়ে আলোচনার জন্য এ নিবন্ধের অবতারণা। আমি এখানে বঙ্গবন্ধুর তিনটি উদ্যোগের কথা তুলে ধরছি যা প্রমাণ করে বিচক্ষণ ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনেতা বঙ্গবন্ধু শুধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পথ সুগম করেননি, ডিজিটাল বিপ্লবে শামিল হওয়ার ভিতও তৈরি করেন তিনি। প্রথম উদ্যোগটি ছিল আর্থ রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট (ইআরটিএস) শীর্ষক প্রোগ্রাম গ্রহণ। এই প্রোগ্রাম গ্রহণের একটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বে বিজ্ঞানের আবিস্কার ও প্রযুক্তির উন্নয়ন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং তা মানুষের কল্যাণে ব্যবহারের কথা বলতেন। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) আর্থ রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট বা ইআরটিএস উৎক্ষেপণ করে। এটি সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়ের আগাম বার্তা বা আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানানোর জন্য অত্যন্ত কার্যকর স্যাটেলাইট প্রযুক্তি। বঙ্গবন্ধু এর গুরুত্ব ও উপকারিতা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন।

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলঙ্করী সাইক্লোনের ভয়াবহতা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। সত্তরের নির্বাচনী প্রচার স্থগিত রেখে সাইক্লোন উপদ্রুত এলাকায় ছুটে গিয়েছিলেন। নাসার ইআরটিএস উৎক্ষেপণের পর তিনি সাইক্লোনসহ আবহাওয়ার আগাম তথ্য জানার জন্য ইআরটিএস প্রোগ্রাম গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহী হন। এই প্রোগ্রাম দ্রুত গ্রহণে ভূমিকা রাখে ১৯৭৩ সালের আবহাওয়ার পূর্বাভাস। আণবিক শক্তি কমিশনের অধীন স্পেস অ্যান্ড অ্যাটমোসফেয়ারিক রিসার্চ সেন্টারের (এসএআরসি) সাবেক কর্মকর্তা ও পরিচালক ড. আব্দুল মোবাচ্ছের (এএম) চৌধুরী ‘বাংলাদেশ, আমি ও উন্নত বিশ্বের দেশসমূহ’ (প্রকাশক: একাডেমি প্রেস অ্যান্ড পাবলিসার্স লাইব্রেরি) গ্রন্থে লিখেছেন, ‘১৯৭৩ সালের নভেম্বরের প্রথম দিকে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়। নিম্নচাপটি সাইক্লোনে রূপ নেয়। বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ পূর্বাভাস দেয় যে, সাইক্লোনটি বাংলাদেশে আঘাত হানবে। শুরু হয় লোকজন সরানোর কাজ। বঙ্গবন্ধুর সরকার ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

উপগ্রহ থেকে প্রেরিত ছবিতে দেখা যায়, সাইক্লোনটি গতি পরিবর্তন করে ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমি এবং আণবিক শক্তি কমিশনের তৎকালীন সদস্য ড. আনোয়ার হোসেন ছুটে যাই বঙ্গবন্ধুর কাছে। ড. আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জানান, সাইক্লোন বাংলাদেশের দিকে আসবে না। গতিপথ পরিবর্তন করে উড়িষ্যার দিকে চলে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু নিজের চেয়ার থেকে উঠে বললেন, তিনি সারারাত আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেছেন যেন সাইক্লোনটা আমাদের দিকে না আসে। তিনি বললেন, আল্লাহ তার প্রার্থনা শুনেছেন।’ ড. আনোয়ার বঙ্গবন্ধুকে জানান, ইআরটিএস প্রোগ্রামের ফাইলটি পরিকল্পনা কমিশনে রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ফাইলটি আনিয়ে তাতে অনুমোদন দেন। ফলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই স্বাধীন বাংলাদেশে মহাকাশ প্রযুক্তি গবেষণার জন্য ইআরটিএস প্রোগ্রাম এবং মহাকাশ ও বায়ুমণ্ডল কেন্দ্র (এসএআরসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়।

দ্বিতীয় উদ্যোগটি ছিল জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভে কূটনৈতিক তৎপরতা। ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নয়া মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। সরকার জাতিসংঘ ও জাতিসংঘের অধীন বিভিন্ন সংস্থা ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভের জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এ তৎপরতার ফলে বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আইটিইউর সদস্যপদ লাভ করে। আর ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্থা আইটিইউ। আইটিইউর সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাগোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সম্প্রসারণ বিশেষ করে স্যাটেলাইটভিত্তিক কার্যক্রমে জাতিসংঘের সহযোগিতা লাভের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কারণ আইটিইউ স্যাটেলাইটের অরবিট/ফ্রিকোয়েন্সি ও রেডিও’র ব্যান্ড ও ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দের সমন্বয় এবং স্যাটেলাইটের সাথে সম্পর্কিত কক্ষপথ নিবন্ধন করায় সহযোগিতা করে এবং হস্তক্ষেপবিহীন টেলিযোগাযোগের সুবিধার্থে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সির যুক্তিযুক্ত, দক্ষ, অর্থনৈতিক ও ন্যায়সংগত ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করে।

তৃতীয়ত উদ্যোগটির সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় ঘটে ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর। বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি প্রদর্শন ও প্রচার করা হয় ঐতিহাসিক মোহাম্মদ আলী ক্লে ও জর্জ ফোরম্যানের মুষ্টিযুদ্ধ। তখন আজকের মতো টেলিভিশন ঘরে ঘরে না থাকলেও সেদিন মানুষ দূরদূরান্ত থেকে ছুটে গিয়ে যেখানে টেলিভিশন আছে সেখানে গিয়ে মুষ্টিযুদ্ধ দেখে। আর সেদিনই বাংলাদেশের মানুষ প্রথম জানল বেতবুনিয়া স্যাটেলাইট আর্থ স্টেশন বা উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রের কথা। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় দ্রুতগতিতে বাস্তবায়নের ফলে এ কেন্দ্রর বিশাল অ্যান্টেনা তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়ে যাওয়ায় বিটিভি পরীক্ষামূলক চালু অবস্থায়ই সেদিন তা ব্যবহার করে ঐতিহাসিক মুষ্টিযুদ্ধ সরাসরি দেশের মানুষকে দেখাতে পেরেছিল। বিটিভির জন্যও এটি ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক ইভেন্টের লাইভ অনুষ্ঠান দেখানো। এর কয়েক মাস পর ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাঙামাটির কাউখালী উপজেলার বেতবুনিয়ায় ১২৮ একর জমির ওপর উপগ্রহ ভূ-কেন্দ্রটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। যা বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র নামে সমধিক পরিচিত। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণে এটিও একটি মাইলফলক ঘটনা।

আলোচ্য উদ্যোগুলো থেকে স্পষ্টত বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশের জন্য কতটা আগ্রহী ছিলেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে উচ্চাভিলাষী সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার বাস্তবায়ন করেছিলেন। এমন একজন প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী নেতা জীবিত থাকলে বাংলাদেশ যে অনেক আগেই মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণ করত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশের সৌভাগ্য যে, তার সুযোগ্য কন্যা ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্টম্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একজন দূরদর্শী রাষ্ট্র নেতা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ৪৩ বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মে তার সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে মহাকাশ গবেষণা, স্পেস ও ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।

উপগ্রহটি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরালের কেনেডি স্পেস সেন্টার লঞ্চপ্যাড ৩৯-এ থেকে আকাশ গবেষণা সংস্থা স্পেসএপের ফ্যালকন-৯ ব্লক ৫ রকেট ব্যবহার করে যখন মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়, তা অন্যান্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছিলেন ডিজিটাল বাংলাদেশের আর্কিটেক্ট প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। পলক বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে যে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়, তা শুধু ডিজিটাল অর্থনীতির বিকাশে নয়, প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের গতিকে আরও বেগবান করছে। আইসিটি বিভাগে দুর্গম এলাকার ৭১৭টি ইউনিয়নে অপটিক্যাল ফাইবার কানেক্টিভিটির মাধ্যমে উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করায় ‘কানেক্টেড বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রকল্পের বাস্তবায়ন করছে।

এর বাইরে দ্বীপ এলাকা ও গভীর জলসীমায় উচ্চগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করবে স্যাটেলাইট।’ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ ভূস্থির যোগাযোগ স্যাটেলাইট থেকে সম্প্রচার, টেলিযোগাযোগ এবং ডেটা কমিউনিকেশনস এই তিন ধরনের সেবা পাওয়া যায়। দেশের প্রায় ৩০টি টিভি চ্যানেল বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট ব্যবহার করছে। এ থেকে সরকারের আয় প্রায় ১২০ কোটি টাকা। আগে এসব চ্যানেল সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের মালিকানাধীন স্যাটেলাইটের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর অভিজ্ঞতায় ২০২৩ সালের মধ্যে দ্বিতীয় স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ও ব্যবহারের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। দ্বিতীয় স্যাটেলাইটের ধরন নির্ধারণে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে প্রাইসওয়াটার কুপার (পিডব্লিউসি) নামক ফ্রান্সের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। স্যাটেলাইটের বিনিয়োগের পরিকল্পনা সুচিন্তিত তা বোঝা যায় স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন ‘স্যাটেলাইট কমিউনিকেশনস: উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষা থেকে। এতে বলা হয়, রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ১ পাউন্ড ব্যয় করে ৪৫ পাউন্ড আয় করা সম্ভব।

অজিত কুমার সরকার: সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক সিটি এডিটর, বাসস

প্রকাশ: ০৬ মে ২১ | Source: Samakal Link

আরও পড়ুন