আধ্যাত্মিক উপলব্ধির প্রচেষ্টা

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

শেখ রাসেল সশরীরে বেঁচে থাকলে তার বয়স ছাপ্পান্নতে উত্তীর্ণ হতো। সশরীরে কথাটি বলার অর্থ হচ্ছে জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ দুটি আত্মাধারণ করে জগতে বিচরণ করে। একটি জীবাত্মা, অন্যটি পরমাত্মা। জীবাত্মার মৃত্যু হয়; কিন্তু পরমাত্মার মৃত্যু হয় না। তবে পরমাত্মার সঙ্গে সব জীবাত্মার সম্পর্ক স্থাপন হয় না বিধায় জড়জগতে অপরাধের মহাকলঙ্ক নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়; তাদের কেউ মনে রাখে না। আবার যেসব জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার অনুপম যোগসূত্র স্থাপিত হয়, তখন সে মহান মানুষে পরিণত হয়। প্রকৃতির নিয়মানুসারে পৃথিবী থেকে সশরীরে বিদায় নিলেও তার মহত্ব-প্রভায় প্রভাবিত হয় সমাজ-সভ্যতা। তাই কেউ কেউ মরে গিয়েও বেঁচে থাকে মানুষের হৃদয়ে। সেটির জন্য কোনো বয়স লাগে না। এটা সত্য যে, মানুষ প্রকৃতিকে জয় করার জন্যই জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু পাশ্চাত্য জাতি ‘প্রকৃতি, শব্দে শুধু জড় বা বাহ্য প্রকৃতিকেই বুঝে থাকে। নদী-শৈল-সাগর সমন্বিতা নানা শক্তি ও ভাবম-িতা তার বাহ্য প্রকৃতি অতিমহৎ। কিন্তু তা অপেক্ষাও মহত্তর মানবের অন্তঃপ্রকৃতি সূর্য-চন্দ্র-তারকা পৃথিবী তথা সমগ্র জড় জগৎ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আমাদের তাই ক্ষুদ্র জীবনের ঊর্ধ্বে এই অন্তঃপ্রকৃতি গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র। পাশ্চাত্য জাতি যেমন বহির্জগতের গবেষণায় প্রাধান্য লাভ করেছে, প্রাচ্য জাতি তেমনি অন্তর্জগতের শ্রেষ্ঠতা লাভ করেছে। অতএব, এটাই সঙ্গত যে, যখন আধ্যাত্মিক সামঞ্জস্যের প্রয়োজন হয়, তখন প্রাচ্য হতেই হয়ে থাকে। এরূপ হওয়াই সঙ্গত। আবার যখন প্রাচ্যজাতি যন্ত্রনির্মাণ, শিক্ষা করতে ইচ্ছা করে, তখন তাকে যে পাশ্চাত্য জাতির পদতলে বসে শিখতে হবে তা সত্য। পাশ্চাত্য জাতির যখন আত্মতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব ও ব্রহ্মা- রহস্য শেখার প্রয়োজন হবে, তখন তাকেও প্রাচ্যের পদতলে বসে শিক্ষা করতে হবে। শেখ রাসেলের জন্মদিন নিয়ে লিখতে গিয়ে এসব কথা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে; কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্বের গভীরতর জায়গায় প্রবেশ করতে হলে আধ্যাত্মিক উপলব্ধি দরকার। এ উপলব্ধি সবার মধ্যে হয় না। এ বাংলাদেশে সরকারি শুমারি অনুসারে ১৭ কোটি লোক। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে কত শিশুর জন্ম হচ্ছে, আবার মৃত্যু হচ্ছে; তার নিত্যকার হিসাব কিন্তু নেই। কয়েক বছর পর পর আদম শুমারি হয়; সে হিসাবটিই লিপিবদ্ধ থাকে। এত শিশুর জন্ম হয়, বছরান্তে সবারই কী জন্মদিনের কথা মনে থাকে? আজকাল মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারে প্রায় সবাই জন্মদিন সংস্কৃতিকে আত্মস্থ করে ফেলেছে। পারিবারিকভাবে জন্মদিন পালিত হলেও কয়জন মানব-মানবীর জন্মদিন বৃহৎ জনগোষ্ঠী সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পালন করে? তাৎপর্যটা এখানেই! শেখ রাসেল আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র। ১৯৬৪ সালে শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে ঘাতক কর্তৃক নিহত হয়। একটি জাতি ও দেশের অভ্যুদয়ে যার অবদান সবার ঊর্ধ্বে সেই মহান মানুষটি রাষ্ট্রচালকের আসনে অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় নিহত হন সপরিবারে। কী নিষ্ঠুর-নির্মম ইতিহাস রচিত হয়েছে এ দেশে। তাই রাসেলের জন্মদিনটি একদিকে শুভদিন হলেও অন্যদিকে বড়ই বেদনাদাহ। সে স্মৃতিগুলো ভেসে উঠে বারবার। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়, সে ভোরটি পৃথিবী যতকাল থাকবে ততদিনই থাকবে কলংকিত। সেদিন কী আকুতি ছিল রাসেলের? কেউ কী তা দেখেছে? সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা অনুসারে রাসেলের বাঁচার আকুতি বিশ্ব মানবজাতির হৃদয়পি-কে নাড়িয়ে দেয়? জন্মদিনকে স্মরণ করতে গিয়ে সংগত কারণেই মৃত্যুদিনটি চোখের সামনে জল জল করে উঠে। একটি ১১ বছরের শিশুর মধ্যে যে বৈশিষ্ট্য ছিল, তা সৃষ্টির আধ্যাত্মিক উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করে। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া রাসেল রাজনীতির বিশুদ্ধ বাতাসে বেড়ে উঠছিলেন।

শিশু বয়সে মহান পিতার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখেছে নিজের চোখে বিশ্বের চোখ। তাই উপলব্ধিটা একটু আলাদা হওয়াই স্বাভাবিক। রাসেল বেঁচে থাকলে কী হতো তা সুনির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও একটি জাতির কর্ণধার হতে পারত তা সহজেই অনুমেয়। উত্তরাধিকার সূত্রেই এমনটি হওয়া স্বাভাবিক। শিশুকালেই তার মধ্যে ছিল মহান ব্যক্তিত্বের অভিব্যক্তি। ১১ বছরের ওই শিশুকে নিয়ে হয়তো কেউ গবেষণা করবে না। কিন্তু কালের কপল তলে রাসেল কখনও হারিয়ে যাবে না। চির ভাস্মর হয়ে থাকবে রাসেলের সংক্ষিপ্ত জীবন ইতিহাস। জীবনটি ১১ বছরের হলেও সৃষ্টি হবে দীর্ঘ ইতিহাস।

আজ রাসেলের জন্মদিন বিভিন্ন সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করছে। শেখ রাসেল ক্রীড়াচক্র সারা দেশে পোস্টার করেছে। রাসেল স্মৃতি সংসদও পোস্টার করেছে। অন্যান্য সামাজিক সংগঠনও প্রতি বছরই শেখ রাসেলের জন্মদিন ঘটা করে পালন করে আসছে। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় রাসেলের জন্মদিন যেভাবে পালিত হয়, ক্ষমতায় না থাকা অবস্থায় সেভাবে পালিত হয় না। এর একটি নৈর্ব্যক্তিক কারণ রয়েছে। আমি সে কারণ ব্যাখ্যা করতে চাই না। কিন্তু আমার মনে একটি প্রশ্ন সব সময় ঘুরপাক খায়, শেখ রাসেল তথা তার পরিবারের সদস্যদের যারা নির্মমভাবে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল, তাদের কী সত্যি বিচার হয়েছে? শুধু কয়েকজন প্রত্যক্ষ খুনে অংশগ্রহণকারীর বিচার হয়েছে।

এ বিচার যথার্থ নয়। আমার ধারণা, খুনি চক্রের উত্তরাধিকার অনেকেই এখনও ক্ষমতার কাছাকাছি অবস্থান করছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয়বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে এটা দৃশ্যমান সত্য। কিন্তু প্রশাসনের অভ্যন্তরে এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গনে খুনির উত্তরসূরিরা ঘাপটি মেরে বসে থেকে রাষ্ট্রটাকে খাবলে খাচ্ছে। আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে অজনপ্রিয় করতে যা যা করা দরকার, তারা সেটি করছে। নেত্রীর সামনে বাহবা কুড়াচ্ছে। কিন্তু তারা একদিন ধরা পড়বেই। দেখুন পুলিশ বাহিনীতে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ অস্থিরতার নেপথ্যে কুশীলবরা যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করে না, তা আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি। কী একটি সস্তা স্লোগান দিয়ে তেল মারা হয়েছে; রাষ্ট্রের যারা থিঙ্ক ট্যাংক তারা কী এটা বুঝেন, নাকি বুঝতে চেষ্টা করেছেন। আমি আরও দুয়েকটি লেখায় উল্লেখ করেছি। স্লোগাননটি হচ্ছে ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার, আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এ স্লোগানটি উদ্দেশ্যমূলক। স্লোগানটি হওয়া উচিত ছিল ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ কাজে হবে দুর্বার। কেন না, পুলিশের থিমটা কী? পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ’ এ বাহিনী গড়ে উঠার ঊষালগ্ন থেকেই থিমটি প্রযোজ্য হয়ে আসছে। মুজিববর্ষে নতুন করে কেন জনতার হওয়ার জন্য অঙ্গীকার করতে হচ্ছে। আগে পুলিশ কাদের ছিল? এখানে স্বরাষ্ট্র সচিব, মন্ত্রী, মাথাওয়ালা কেউ কী নেই এ সেøাগানটি যে অর্থহীন তা বোঝার জন্য?

এটাই কি রাষ্ট্র, এটাই কি রাষ্ট্রের ধারণা? বঙ্গবন্ধুকে যারা ভালোবাসে, তারা দেশকে ভালোবাসবে, তারা কখনও দুর্নীতি করতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শই হচ্ছে স্বাধীনতা, স্বাধীন বাংলাদেশের মৌলিকত্ব। শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি দেশ স্বাধীন করেছেন, নতুন করে শোষক তৈরি করার জন্য নয়। আজ নতুন একদল রক্তচোষা ঢুকে পড়েছে চোরাগলি দিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরে। এসব রক্তচোষারাই প্রশাসনের অভ্যন্তরে কতগুলো বর্ণচোরাকে লুটপাটের জায়গা তৈরি করে দিয়েছে। নীতিনিষ্ঠ শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি নিয়ে ছিনিমিনি খেলা অপশক্তি চিহ্নিত করে এখনই ব্যবস্থা না নিলে, রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে। শেখ রাসেলের জন্মদিনে নতুন করে শপথ নিতে হবে যে, অন্যায় দুরাচার সব অপশক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের ভাবমূর্তি সমুজ্জ্বল রাখব। ভালো করে খোঁজ নিন। দেশবাসী ভাবুন, একবার ভাবুন তো বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমাদের অবস্থান কী হতো? পাকিস্তানিদের বাসাবাড়িতে ফুট ফরমায়েশের কাজ নিতে হতো। কেউ কী শিল্পপতি, আমলা, জজ সাহেব হতে পারত? পারত না। যারা এগুলো হয়েছে, তাদের বেশির ভাগই তো অপশক্তির উত্তরসূরি। হৃদয়ে বড় যন্ত্রণা, যারা এই কিছুদিন আগেও বঙ্গবন্ধুর মু-ুপাত করত আওয়ামী লীগের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করত; তারাই বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে, আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ, কলাগাছ থেকে বটগাছে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতার দৃশ্যপটে আওয়ামী লীগ, কিন্তু ভেতরে অন্যকিছু। সেজন্যই সংকট ঘনীভূত হচ্ছে।

উন্নয়নে আমরা যতটা আত্মপ্রসাদ লাভ করছি, তার চেয়ে অনেক বেশি শঙ্কিত বোধ করছি। প্রশাসনে, রাজনীতিতে, সমাজে শ্রেষ্ঠত্বে অবস্থান করছে ভয়ংকর অপশক্তি। নানা কৌশলে শেখ মুজিবের ঢোল বাজাচ্ছে জোরে জোরে। আমরা বাহবা দিচ্ছি। প্রকৃত বন্ধু চিনতে পারছি না। ১৯৭৫ সালেও চিনতে পারিনি! শেখ হাসিনা এক বক্তৃতায় বলেছিলেন ‘এত আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কোথায় ছিল?’

আরও একটি কথা আমার মনে আছে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমি ছাড়া সবাইকেই কেনা যায় এ কথার প্রতিবাদ করতে কেউ কী সাহস পেয়েছে? পায়নি। শেখ রাসেলের জন্মদিনকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণি নিজেদের উচ্চমার্গে পর্যবসিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে। তাদের থেকে সাবধান!

শেখ রাসেল নেই; কিন্তু রয়েছে তার স্মৃতি। বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরি হিসেবে উচ্চাদর্শে ম-িত হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে রাসেলও অভূতপূর্ব অবদান রাখতে পারত। ঘাতকরা সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে জাতিকে। এখন জননেত্রী শেখ হাসিনা কা-ারি হয়ে আলোর পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন; কিন্তু পদে পদে বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন।

আসুন এ বাধা অতিক্রম করতে নিঃস্বার্থভাবে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়াই। কুচক্রী আমলাদের মুখোশ উন্মোচন করে সত্য প্রতিষ্ঠা করি। শেখ রাসেলের শুভ জন্মদিনে আমাদের প্রত্যাশা শিশু-কিশোরদের সুন্দর বাসযোগ্য ভূমিতে পরিণত হোক এই মাতৃভূমি। শিশুদের বাসযোগ্য হলে সবার জন্যই তা হবে তীর্থভূমিসম।

 ফনিন্দ্র সরকার  ১৮ অক্টোবর ২০২০ লিংক

আরও পড়ুন