ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫। বাংলাদেশের তিনজন তরুণ বর্তমানে স্যান্ডহার্স্ট মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আজকে ক্যাডেটদের বহিরাঙ্গন প্রশিক্ষণ ‘এক্সারসাইজ ভার্জিন সোলজার’ শুরু হয়েছে…। সারা দিন হেঁটে তরুণ ক্যাডেটদের দলটি একটি বনে পৌঁছল।
সন্ধ্যাবেলায় খাওয়ার পর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন ক্লান্ত ক্যাডেট শেখ জামাল। মধ্যরাতে হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। তাঁবুর দরজা ফাঁক করে দেখেন বাইরে এক অদ্ভুত পরিবেশ। আকাশে মস্ত বড় চাঁদ। তারা ঝলমলে জ্যোত্স্নায় বার্চ আর পাইনের বন যেন অপার্থিব রকম সৌন্দর্যে সেজেছে। শেখ জামাল তাঁবুর বাইরে এলেন। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন বন্ধু ক্যাডেট মাসুদুল হাসান (পরে ক্যাপ্টেন) ও ক্যাডেট আলাউদ্দিন মো. আবদুল ওয়াদুদ (পরে মেজর জেনারেল) তাঁবু থেকে বেরিয়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বার্চ গাছের সারি ঢালু হয়ে নেমে গেছে সামনের উপত্যকায়। তারপর সেই পাহাড় সারির ওপর সেই অদ্ভুত পূর্ণিমা। তিন বাঙালি তরুণ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখেন স্যান্ডহার্স্টের ‘প্রথম পূর্ণিমা’…।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য কিশোর শেখ জামাল ১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট ধানমণ্ডির তারকাঁটার বেড়া দেওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে ভারতে যান। আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে শেখ জামাল পৌঁছলেন ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে। মুজিব বাহিনীর (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে শেখ জামাল ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
প্রশিক্ষণ সমাপ্তির পর শেখ জামাল ৯ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন। ধানমণ্ডির বঙ্গবন্ধু জাদুঘরে শেখ জামালের কক্ষে দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে রণাঙ্গনে তোলা রাইফেল কাঁধে শেখ জামালের মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি ছবি। এ প্রসঙ্গে একাত্তরে রণাঙ্গনের সাংবাদিক এ বি এম মূসা লিখেছেন, ‘অসম সাহসী আরেক জামালের দেখা পেলাম যুদ্ধ এলাকায় একটা পরিখায় অস্ত্র হাতে। এই চমক লাগানো খবর আবিষ্কার করে আমার ক্যানন এসএলআর ক্যামেরায় জামালের ছবি তুলে পাঠালাম ‘লন্ডন দ্য টাইমস’-এ (‘মুজিব ভাই’, এ বি এম মূসা)।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দ্বিতীয় পুত্র শেখ জামালকে সেনা অফিসার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের শরতে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক একাডেমি স্যান্ডহার্স্টে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের লক্ষ্যে শেখ জামাল লন্ডনে এসে পৌঁছেন। তবে স্যান্ডহার্স্টের পূর্বশর্ত হিসেবে তাঁকে ব্রিটেনের আর্মি স্কুল অব ল্যাঙ্গুয়েজ, বেকনস ফিল্ড থেকে প্রয়োজনীয় পূর্ব প্রশিক্ষণ (ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা ও মৌলিক সামরিক বিষয়) গ্রহণের প্রয়োজন পড়ে। স্যান্ডহার্স্টে (১৮১২) ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়। স্যান্ডহার্স্ট লন্ডনের ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এ সময় স্যান্ডহার্স্টের কমান্ড্যান্ট ছিলেন মেজর জেনারেল রবার্ট ফোর্ড।
এখানে উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর বিশেষ উদ্যোগে ও বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য প্রতিরক্ষা সহযোগিতার আলোকে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ থেকে সর্বপ্রথম দুজন ক্যাডেট (ক্যাডেট শফি মোহাম্মদ মেহবুব, পরবর্তী সময়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও ক্যাডেট লুেফ কামাল, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট) স্যান্ডহার্স্টে যোগদান করেন। তাঁরা ১৯৭৪ সালে কমিশন লাভ করেন।
কঠিন ট্রেনিংয়ের মধ্যে রোমাঞ্চকর ঘটনাও ঘটে। কোর্সের একজন প্রশিক্ষক ক্যাপ্টেন মার্ক ফিলিপস আলোচিত ব্রিটিশ রাজকুমারী অ্যানের স্বামী। একদিন সিগন্যাল এক্সারসাইজ চলাকালে ক্লান্ত একদল ক্যাডেটের মাঝে হঠাৎ সাদা ঘোড়ায় চড়ে উদয় হলেন বিখ্যাত অশ্বারোহী রাজকুমারী অ্যান। প্রিন্সেস ঘোড়া থেকে নেমে নিজের পরিচয় দিয়ে একজন বাঙালি ক্যাডেটের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন এবং হাতের গ্লাভস খুলে হ্যান্ডশেক করলেন। এরপর ঘোড়া দাবড়িয়ে পাহাড়ের আড়ালে মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেলেন রূপকথার রাজকুমারীর মতো।
স্যান্ডহার্স্টের শর্ট সার্ভিস কমিশনের সুকঠিন গ্র্যাজুয়েট কোর্সটির মেয়াদ ছিল প্রায় ছয় মাস (৩ জানুয়ারি থেকে ২৭ জুন ১৯৭৫)। ৪০০ জন ক্যাডেটের মধ্যে বিদেশি ক্যাডেটের সংখ্যা ছিল ৩০। আন্তর্জাতিক পরিবেশে খুব অল্প সময়ে নিজেদের মানিয়ে নেন থ্রি মাসকেটিয়ার্স।
১৯৭৫ সালের মে মাসের শেষের দিকে স্যান্ডহার্স্ট থেকে ক্যাডেটরা রণকৌশলগত চূড়ান্ত অনুশীলনে (এক্সারসাইজ ডায়নামিক ভিক্টোরি) অংশগ্রহণ করতে পশ্চিম জার্মানিতে (ব্রিটিশ আর্মি অন রাইন) যান। পশ্চিম জার্মানির পশ্চিম অঞ্চলের এক ছোট্ট এয়ারপোর্টে ক্যাডেটদের বহনকারী প্লেনটি ল্যান্ড করে। জার্মানিতে নেমে ক্যাডেট মাসুদের মনে পড়ে লেখক এরিক মারিয়া রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী বিখ্যাত উপন্যাস ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্নফ্রন্ট’-এর নায়ক সৈনিক পল বোমারের কথা। তাঁর মনে হয়, কাছেই হয়তো ছিল ওয়েস্টার্নফ্রন্ট (ফ্রান্সের পূর্বাঞ্চল)। কত দুপুর এই উপন্যাসের নায়ক পলের সঙ্গী হয়ে সেই ওয়েস্টার্নফ্রন্টের দুঃসাহসিক অভিযানে গেছেন কিশোর মাসুদ।
এই অনুশীলনকে রীতিমতো যুদ্ধই বলা যায়। গায়ে কমব্যাট ইউনিফর্ম, হাতে রাইফেল, পিঠে হ্যাভারস্যাক—ওয়াদুদ মাসুদ ও জামাল পুরোপুরি যোদ্ধা। কখনো পাহাড়ি এলাকা, কখনো অরণ্য, কখনো খোলা প্রান্তরে চলে দুঃসাহসিক অনুশীলন। সারা দিন প্রতিরক্ষায় ট্রেঞ্চে বসে থাকা। ভোর রাতে পরিচালিত হলো গোর্খা ব্যাটালিয়নের আক্রমণ। আকাশে শত্রুর বিমান। ট্রেঞ্চের কিছু দূরে আর্টিলারি শেল পড়ছে। চলছে লাইভ ফায়ারিং। শত্রুদের হটিয়ে এবার এগিয়ে যেতে হবে। পাইন বৃক্ষশোভিত অরণ্যময় এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে রেপলিং করে নামতে হলো কয়েক শ ফুট। কখনো শত্রুর প্রতিরক্ষায় বেপরোয়া আক্রমণ…।
২৭ জুন ১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত হয় ক্যাডেটদের প্রার্থিত সভরিন (পাসিং আউট) প্যারেড। প্যারেড রিভিউ করছিলেন ব্রিটেনের রাজকুমারী এলিস। প্যারেডের শেষ পর্যায়ে অর্কেস্ট্রায় স্কটিশ বিদায় সংগীত ‘ওল্ড লংসিনস’-এর (পুরনো সেই দিনের কথা) সুর বেজে উঠেছে। ক্যাডেটরা সারিবদ্ধভাবে প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে মার্চ করে ওল্ড কলেজের সিঁড়ি অতিক্রম করলেন। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের তিন তরুণের ক্যাডেট থেকে কাঙ্ক্ষিত আর্মি অফিসারে রূপান্তর ঘটল।
১ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে স্যান্ডহার্স্টে রেগুলার ক্যারিয়ার কোর্স শুরু হবে। শেখ জামাল এই প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পেয়েও অংশগ্রহণ করেননি। কারণ তাঁর দুই প্রিয় বন্ধু মাসুদ ও ওয়াদুদ বাংলাদেশে ফিরে যাচ্ছেন। আর রয়েছে মায়ের জন্য গভীর টান। মাত্র দেড় মাস পর এই সিদ্ধান্তই তাঁর জীবনকে তছনছ করে দেবে।
স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে ফিরে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট শেখ জামালের পোস্টিং হলো ঢাকা সেনানিবাসে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ব্যাটালিয়নের চার্লি কম্পানিতে। ইউনিটে যোগদানের দিন সেনাবাহিনীর খাকি ইউনিফর্ম পরে বাড়িতে ফেরেন শেখ জামাল। মুগ্ধ চোখে স্মার্ট এক আর্মি অফিসারকে দেখেন পিতা শেখ মুজিব ও মা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব।
দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলে জামালের চাকরিকাল ছিল প্রায় দেড় মাস। কিন্তু এই স্বল্প সময়ে অফিসার ও সৈনিকদের মাঝে তিনি চমৎকার পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতার ছাপ রেখেছিলেন। কয়েক সপ্তাহেই জামাল অফিসার ও সৈনিকদের মধ্যে তাঁদেরই একজন হয়ে যান।
এই তিন বাংলাদেশি ক্যাডেটের সঙ্গে বেশ কয়েকজন বিদেশি ক্যাডেটের বন্ধুত্বময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাঁদের কয়েকজন হলেন—লুক্সেমবার্গের ক্যাডেট হেনরি (বর্তমানে গ্র্যান্ড ডিউক অব লুক্সেমবার্গ, রাজা বা রাষ্ট্রপ্রধান), কাতারের ক্যাডেট গানিম শাহিন আল গানিম (পরবর্তী সময়ে লে. জেনারেল ও কাতার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান) এবং সৌদি আরবের ক্যাডেট ফয়সাল (পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল ও সৌদি সিভিল এভিয়েশন প্রধান) শেখ জামালের জীবন ছিল খুব সংক্ষিপ্ত—২৮ এপ্রিল ১৯৫৪ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। শেখ জামাল এখন ঘুমিয়ে আছেন বনানী কবরস্থানে। তাঁর পাশেই ঘুমিয়ে আছেন প্রাণপ্রিয় স্ত্রী রোজী জামাল, যাঁর হাতের তাজা মেহেদির রং বুকের তাজা রক্তে একাকার হয়ে গিয়েছিল।
আজ শেখ জামালের জন্মদিন। আজকের এই দিনে একজন অকালপ্রয়াত কিশোর মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার, বন্ধু-অন্তপ্রাণ ও সাহসী তরুণের কথা স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল—স্যালুট টু ইউ স্যার।
লেখক : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার এনডিসি (অবসরপ্রাপ্ত)
গবেষক
কালের কণ্ঠ বৃহস্পতিবার । ২৮ এপ্রিল ২০২২ । ১৫ বৈশাখ ১৪২৯ । ২৬ রমজান ১৪৪৩