স্মরণঃ নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে—

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ১৩০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ রচিত পঙক্তি

‘নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে’

যথার্থ উচ্চারণ বলে মনে করি। সারাটি জীবন তিনি দৃষ্টান্তমূলক স্বচ্ছ, নির্লোভ, সহজ-সরল জীবন যাপন করে গেছেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তাঁর বৈদগ্ধ্য, বিচক্ষণতা, বিশ্লেষণদক্ষতা ও বঙ্গবন্ধু চর্চার জন্য ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ব্যক্তিত্ব, পাণ্ডিত্য, সততা ও মানবপ্রেম রবীন্দ্রনাথের পঙক্তিটির যথাযথ উদাহরণ হিসেবেই আমরা গণ্য করতে পারি।

পরমাণুবিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ডাকনাম সুধা মিয়া। ১৯৪২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানাধীন ফতেপুর গ্রামের বিখ্যাত মিয়াবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬২-তে এমএসসি পরীক্ষায়ও অর্জন করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান। ১৯৬১-৬৪ শিক্ষাবর্ষে তিনি লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে ডিপ্লোমা লাভ করেন। ওয়াজেদ মিয়া ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রিতে সম্মানিত হন। তাঁর গবেষণা-অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল হাই এনার্জি নিউক্লিয়ার ফিজিকস। গবেষণা তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সেকালের বিখ্যাত পদার্থবিদ অধ্যাপক ই জে স্কুইরিস (ঊ ঔ ঝয়ঁরত্বং)।

১৯৬৭ সালে ওয়াজেদ মিয়ার জীবনে নবতর অধ্যায়ের সূচনা হয়। তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। এই কালপর্ব আমাদের জাতীয় জীবনেও বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তান সরকারের তথাকথিত আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধু তখন কারাবন্দি।

মেধাবী ছাত্র হয়েও তিনি রাজনীতিসংলগ্ন, তৎকালীন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মীই শুধু ছিলেন না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলের নির্বাচিত সহসভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে।

ওয়াজেদ মিয়ার কর্মজীবন শুরু হয় পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশনের ঢাকা কেন্দ্রে যোগদানের মাধ্যমে (১ এপ্রিল ১৯৬১)। কমিশনের কর্মে নিয়োজিত থাকাকালেই ১৯৬৯ সালে তিনি নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী অধ্যাপক আবদুস সালামের ইতালির ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিকসের ফেলোশিপ লাভ করেন। ইতালিবাস তাঁর বিজ্ঞানীজীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এর ফলে তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিভিন্ন বিজ্ঞানীর সঙ্গে গবেষণার ও মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পান, যা তাঁর চেতনাকে অধিকতর শাণিত ও সমৃদ্ধ করেছে।

গবেষণাবৃত্তি সমাপ্ত করে ১৯৬৯ সালে ওয়াজেদ মিয়া স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন ও নিয়োজিত হন তাঁর কর্মস্থল পরমাণু কমিশনের কর্মপ্রবাহে। স্বাধীনতা-উত্তরকালে আরো বৃহত্তর পরিসরে গবেষণার সুযোগ হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত তিনি গবেষণা করেন ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের নতুন দিল্লির গবেষণাগারে।

তিনি ৯ মে ২০০৯ সালে পরলোকগমন করেন, রেখে যান স্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এক পুত্র ও এক কন্যা—সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ নাতি-নাতনি, অসংখ্য আত্মীয়-পরিজন, বহু বন্ধুবান্ধব ও গুণগ্রাহী।

ড. ওয়াজেদ মিয়া পরলোকগমনের পর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত তাঁর স্মরণসভায় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতারা, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা, ওয়াজেদ মিয়ার ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, গুণগ্রাহী, কৃতী সব বিজ্ঞানীসহ অনেকেই উপস্থিত হন। তাঁরা নানাভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে সদ্যঃপ্রয়াত এই বিজ্ঞানীর স্মৃতিচারণা করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। আমার বিবেচনায়, তাঁদের কথামালাই ড. ওয়াজেদ মিয়ার প্রকৃত পরিচয়। আমরা সেভাবেই তাঁকে অনুভব করি।

এক. তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন; কিন্তু পুথিগতবিদ্যার ইউটোপিকজগৎ পরিভ্রমণে আগ্রহী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাস্তবতাসচেতন। স্বদেশ ও স্বদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর কৌতূহল ও অনুরাগ। স্বতন্ত্র মনোগঠনের কারণেই ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে তিনি শুধু যুক্তই হননি, এ সংগঠনের কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে কারাবরণও করেছেন।

দুই. তিনি এক অর্থে রাজনৈতিক পরিবারেরই সদস্য। রাজনৈতিক নেতারা সব সময়ই তাঁর সহানুভূতি ও সহযোগিতা লাভ করেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি কখনো রাজনীতিবিদ হয়ে উঠতে চাননি। পেশাশ্রয়ী ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতিই ছিল তাঁর কাম্য এবং নিজেকে তিনি সেভাবেই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর এই ব্যক্তিস্বরূপই প্রত্যক্ষ করা যায় তাঁর রচিত দুটি বিজ্ঞান গ্রন্থে : Fundamentals of Electromagnetics (Tata Mcgraw-Hill, 1982) ও Fundamentals of Thermodynamics (University Press Ltd. Dhaka, 1988).

তিন. রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে তিনি অবস্থান করেছেন ঠিকই; কিন্তু ক্ষমতার উত্তাপ কখনো তাঁকে স্পর্শ করেনি। সারা পৃথিবীর নানা দেশের যে দৃষ্টান্ত, সে আলোকে বিচার করলে অবশ্যই বলতে হয় তিনি সবার থেকে ব্যতিক্রম, নির্লোভ, নিরহংকার ও মেধাশাসিত।

চার. বিজ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত হলেও দেশ, সমাজ ও সভ্যতা সম্পর্কে তিনি ছিলেন সব সময় সজাগ ও প্রত্যাশাদীপ্ত। তাঁর এই চেতনালোক মূর্ত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ এবং ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ও সরকারের চালচিত্র’ শীর্ষক দুটি গ্রন্থে।

পাঁচ. বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাঁর ছিল ভিন্ন আবেগ, যা একান্ত তাঁরই। ১৯৭৫ সালের ট্র্যাজেডি তাঁকে আবিষ্ট ও বেদনাক্ষত করেছে ঠিকই; কিন্তু নিজের কর্তব্য তিনি সঠিকভাবেই পালন করেছেন। এ চরম দুঃসময়ে তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পরম আশ্রয়, মূর্তিমান সান্ত্বনা ও শুশ্রূষা।

ড. ওয়াজেদ মিয়া আজ সব কিছুর ঊর্ধ্বে। কিন্তু তিনি আমাদের ইতিহাসের অংশ। তাঁর দেশহিতৈষণা ও মানবপ্রেমই তাঁকে স্মরণে রাখবে। তাঁর মতো নির্লোভ, নিভৃতচারী, উদার ও বিজ্ঞানবোধপরিস্নাত মানুষের যতই আবির্ভাব ঘটবে ততই দেশ, জাতি ও বিশ্বের মঙ্গল। আমি ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।

ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ৬৭ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে যে দেশপ্রেম ও বিজ্ঞান দর্শনের দীপ্তি ছড়িয়ে গেছেন, সত্য অনুশীলনের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন, তা থেকে আমাদের নবীন প্রজন্ম বিজ্ঞানচেতনা ও প্রজ্ঞায় আলোকিত হবে, এটি আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখক : আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক
সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কালের কণ্ঠ ০৯ মে ২০২৩

আরও পড়ুন