বঙ্গবন্ধুর কৃষি-ভাবনা

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির পথপ্রদর্শক। তিনি শোষণহীন সমাজ গঠনের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি বাংলার প্রত্যেক মানুষের জীবনের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন আহার, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছেন। বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে তিনি ছিলেন আপসহীন। বিপন্ন জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়েও তিনি জনগণের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। এ জন্য সারা জীবন জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন, এমনকি ফাঁসির দড়িও তাঁকে লক্ষ্য থেকে একচুল নড়াতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলেও বঙ্গবন্ধু বিজয়ীর বেশে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। ফিরে আসেন তাঁর প্রিয় জনগণের মাঝে। নিজেকে সঁপে দেন দেশ গড়ার কাজে। শুরু হয় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন এ দেশের শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত কৃষকদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। তাই তিনি সব সময় কৃষির প্রতি শ্রদ্ধা ও অগ্রাধিকার প্রদান করেছিলেন।

বিখ্যাত দার্শনিক রুশো বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ও গৌরবমণ্ডিত শিল্প হচ্ছে কৃষি।’ শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী ও বিজ্ঞানমনস্ক। চির আধুনিক রাজনৈতিক নেতা। তিনি দার্শনিক রুশোর বাণীকে লালন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি সোনার বাংলা গড়তে কৃষিশিল্পের উন্নয়ন অপরিহার্য। তিনি উপলব্ধি করতেন, কৃষি একটি জ্ঞাননির্ভর শিল্প। গতানুগতিক কৃষিব্যবস্থা দ্বারা দ্রুত ক্রমবর্ধমান বাঙালি জাতির খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য চাই কৃষির ব্যাপক আধুনিকীকরণ। আর কৃষিশিল্পের আধুনিকীকরণ ও লাগসই উন্নয়নের একমাত্র কারিগর হচ্ছেন কৃষি শিক্ষায় শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটরা। এ জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের ১১ দফায় কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেন। সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আত্মমর্যাদাশীল কৃষিবিদরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণে দেশের বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগানে নিয়োজিত রয়েছেন। কৃষিবিদদের চিন্তাচেতনা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, আধুনিক প্রযুক্তিগত ধারণা ও প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর ভাগ্যের পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ উপহার দিতে সক্ষম হবে বলে আমি আশাবাদী।

কৃষির সার্বিক উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু যে মমত্ববোধ ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর প্রদত্ত ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে আজও সাক্ষ্য দেয়। ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি গৌরবময় দিন। বঙ্গবন্ধু শত ব্যস্ততার মধ্যেও কৃষি ও কৃষকের টানে ছুটে এসেছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ শ্যামল আঙিনায়। এ দেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদদের সঙ্গে যে তাঁর আত্মার সম্পর্ক ছিল তা প্রদত্ত ভাষণে তিনি স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা, সত্য কথা বলতে কী বাংলার মাটি, এ উর্বর জমি বারবার দেশ-বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষকদের টেনে এনেছে এই বাংলার মাটিতে। এই উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো, তবে এতকাল আমাদের থাকতে হতো না। যেখানে মধু থাকে, সেখানে মক্ষিকা উড়ে আসে। সোনার বাংলা নাম আজকের সোনার বাংলা নয়। বহু দিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মতো মাটি দুনিয়ায় দেখা যায় না। বাংলার মানুষের মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলার সম্পদের মতো সম্পদ দুনিয়ায় পাওয়া যায় না।’ তিনি কৃষির গুরুত্ব উপলব্ধি করে বলেন, ‘যেভাবে মানুষ বাড়ছে যদি সেভাবে আমাদের বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে, তবে ২০ বছরের মধ্যে বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে।’ সে কারণেই আমাদের কৃষির দিকে নজর দিতে হবে এবং কৃষিবিদদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের কোট-প্যান্ট খুলে একটু গ্রামে নামতে হবে। কেমন করে হালে চাষ করতে হয়, এ জমিতে কত ফসল হয়, এ জমিতে কেমন করে লাঙল চষে, কেমন করে বীজ ফলন করতে হয়। আগাছা কখন পরিষ্কার করতে হবে। ধানের কোন সময় নিড়ানি দিতে হয়। কোন সময় আগাছা ফেলতে হয়। পরে ফেললে আমার ধান নষ্ট হয়ে যায়। এগুলো বই পড়লে হবে না। গ্রামে যেয়ে আমার চাষি ভাইদের সঙ্গে প্রাকটিক্যাল কাজ করে শিখতে হবে। তাহলে আপনারা অনেক শিখতে পারবেন। অনেক আগে কৃষি বিপ্লবের কথা বলছি। ৫০০ কোটি টাকার ডেভেলপমেন্ট বাজেট করেছিলাম এবং ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য দিয়েছি। ভিক্ষা করে টাকা আমি জোগাড় করেছি।’ বঙ্গবন্ধু কৃষি ও কৃষক তথা আপামর জনগণের মুক্তির জন্য আজীবন প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাঁর প্রদত্ত ভাষণ থেকে তা সহজেই অনুমেয়। তিনি ছিলেন আবহমান বাংলার একজন পথচারী। বংলার মাটির সাধারণ মানুষ।

এ উপমহাদেশের আর এক জাতির জনক ও অসহযোগ আন্দোলনের পথিকৃৎ মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, ‘একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি এক টুকরো রুটির মধ্যে স্রষ্টাকে দেখেন।’ বঙ্গবন্ধু এই ঐতিহাসিক বাণী উপলব্ধি করে বলেছিলেন, ‘খাবার অভাব হলে মানুষের মাথা ঠিক থাকে না। সে জন্য খাওয়ার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে অন্নহীন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিতে।’ এ লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার জন্য বাঙালি জাতি যখন অগ্রসরমাণ, ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি কুচক্রী মহল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর নিজ বাসভবন ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটি স্বাধীনতাবিরোধী কুচক্রী মহলের হস্তক্ষেপে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা আর আশার আলো দেখেনি। কৃষি খাতে ভর্তুকি প্রত্যাহার, অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদির ফলে বিগত দিনগুলোতে বিপুল সম্ভাবনাময় কৃষি খাতে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি।

১৯৯৬ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্ন ‘সোনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছিলেন। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি উন্নয়ন, মহিলাদের কৃষিতে অংশগ্রহণ ও দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে কয়েকটি বছর আবার কৃষি খাতের উন্নয়ন থমকে ছিল। ২০০৮ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত শক্তি আবার ক্ষমতায় এলে কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার আরো এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। কৃষি খাতে আবার ভর্তুকি, সার বিতরণ ব্যবস্থা, সেচব্যবস্থার উন্নয়ন, একটি বাড়ি, একটি খামার প্রকল্প, শস্য বহুমুখীকরণসহ অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে বর্তমান সরকার। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ১৯৭২ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে যেখানে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল প্রায় এক কোটি টন সেখানে ২০০৮-০৯ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন হয়েছে প্রায় তিন কোটি ১২ লাখ টন অর্থাৎ শস্যের উৎপাদন প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদেরও উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়েছে। কৃষি ক্ষেত্রে এ যুগান্তকারী সাফল্য, বঙ্গবন্ধুর অবদান বাঙালি জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে।

বর্তমানে জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব, শিল্পায়ন নগরায়ণ, কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, রাসায়নিক সার ও কল-কারখানার দূষিত বর্জ্যে কৃষিসম্পদ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য এ দেশের কৃষি, কৃষক, কৃষিবিদ ও কৃষিবান্ধব সরকারের যৌথ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ তাঁর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে বাস্তবায়িত হবে বলে আমরা আশাবাদী। সর্বোপরি বলা যায়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুই ছিলেন এই চিরচেনা কৃষির পথপ্রদর্শক। শক্তিমান কবির লেখনীতে যেমন সৃষ্টি হয় মহাকাব্যের, তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার স্পর্শে জাগরিত হয়েছে এ মহাদেশ- সোনার বাংলাদেশ।

লেখক : ড. এম আফজাল হোসেন, ডিন, কৃষি অনুষদ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
কালেরকণ্ঠ, ১৫ আগস্ট, ২০১৪

আরও পড়ুন