‘এ দেশের যা-কিছু তা হোক না নগণ্য, ক্ষুদ্র তাঁর চোখে মূল্যবান ছিল-নিজের জীবনই শুধু
তাঁর কাছে খুব তুচ্ছ ছিল; স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে পড়ে আছে বিশাল শরীর…’ -রফিক আজাদ (‘এই সিঁড়ি)
আজ পনের আগস্ট। জাতীয় শোকের দিন। বাংলার আকাশ-বাতাস-নিসর্গ প্রকৃতিও অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। পঁচাত্তরের এই দিনে বাঙালির ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে সপরিবারে প্রাণ হারান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গভীর শোক ও ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে পড়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর বিশাল অস্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁরই একটি ভাবনা (কৃষি) নিয়ে কিছু কথা আমি পাঠকদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
কৃষি খাতের উন্নয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রার মান সম্পর্কিত। দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৪৩ শতাংশের উত্স আমাদের কৃষি খাত। সাম্প্রতিক সময়ে কৃষি খাতে উন্নয়নের কারণে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে। স্বাধীনতার ঠিক পরে ১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উত্পাদন হয় এক কোটি ১০ লাখ টন। এর মধ্যে ধান উত্পাদন হয় ৯৩ লাখ টন। তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্যে ওই খাদ্য পর্যাপ্ত ছিল না। ৪৩ বছরের ব্যবধানে আজ দেশের মানুষ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আবাদি জমি কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। তবে, খাদ্য উত্পাদন বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ। বর্তমানে ৩.৩৮ কোটি টন ধানসহ খাদ্যশস্যের উত্পাদন প্রায় ৪ কোটি টনে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে দানা জাতীয় খাদ্যশস্য, আলু ও শাক-সবজিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ডাল, তেলবীজ, মসলা ও ফল উত্পাদনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। মাছ, মুরগি, ডিম, দুধ ও গবাদি পশুর বাণিজ্যিক উত্পাদনের ক্ষেত্রেও অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ। গত পাঁচ বছরে দেশে দারিদ্র্যের হার ১০ শতাংশ কমানোর ক্ষেত্রেও কৃষি উত্পাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে বিশ্বব্যাংক, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ইফপ্রি) বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইফপ্রি’র ক্ষুধা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। মাত্র এক বছরেই এই সূচকে ১১ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কৃষি খাতে এসব সাফল্যের পেছনে বঙ্গবন্ধুর কৃষি ভাবনা মূলশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, কৃষির উন্নতি ছাড়া এদেশের মানুষের মুক্তি আসতে পারে না। কৃষকেরাই এদেশের প্রাণ। তাই তিনি সবসময় বলতেন, ‘আমাদের চাষিরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পিছনে নিয়োজিত করতে হবে।’ ১৯৭০ সালের ২৯ অক্টোবর প্রাক-নির্বাচনী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের গোটা কৃষি-ব্যবস্থাতে বিপ্লবের সূচনা অত্যাবশ্যক। পশ্চিম পাকিস্তানে জমিদারি, জায়গীরদারি, সরদারি প্রথার অবশ্যই বিলুপ্তি সাধন করতে হবে। প্রকৃত কৃষকের স্বার্থে গোটা ভূমি-ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস সাধনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ভূমি দখলের সর্বোচ্চ সীমা অবশ্যই নির্ধারণ করে দিতে হবে। নির্ধারিত সীমার বাইরের জমি এবং সরকারি খাসজমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করতে হবে। কৃষি ব্যবস্থাকে অবশ্যই আধুনিকীকরণ করতে হবে। অবিলম্বে চাষিদের বহুমুখী সমবায়ের মাধ্যমে ভূমি-সংহতিসাধনে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। সরকার এজন্যে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘ভূমি-রাজস্বের চাপে নিষ্পিষ্ট কৃষককুলের ঋণভার লাঘবের জন্যে অবিলম্বে আমরা ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা বিলোপ এবং বকেয়া খাজনা মওকুফ করার প্রস্তাব করেছি। আমরা বর্তমান ভূমিরাজস্ব-প্রথা তুলে দেবার কথা ভাবছি। প্রাকৃতিক সম্পদের সর্বাধিক উন্নয়নের জন্যে বৈজ্ঞানিক তত্পরতা চালাতে হবে। অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আমাদের বনজ সম্পদ, ফলের চাষ, গো-সম্পদ, হাঁস-মুরগির চাষ—সর্বোপরি মত্স্যচাষের ব্যবস্থা করতে হবে।’
সত্তরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ২০ লাখ লোকের এক সমাবেশে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের সদস্যগণ জনগণের সামনে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ বাক্য পাঠ করানোর পর বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আমার দল ক্ষমতায় যাওয়ার সাথে সাথেই ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেবে। আর দশ বছর পর বাংলাদেশের কাউকেই জমির খাজনা দিতে হবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলায়ও এই একই ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে। ঐ সমাবেশে তিনি আরো বলেন, আইয়ুবী আমলে বাস্তুহারা হয়েছে বাংলার মানুষ। সরকারের খাস জমিগুলো বণ্টন করা হয়েছে ভুঁড়িওয়ালাদের কাছে। তদন্ত করে এদের কাছ থেকে খাসজমি কেড়ে নিয়ে তা বণ্টন করা হবে বাস্তুহারাদের মধ্যে। চর এলাকায়ও বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।’
স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষকদের ভাগ্যোন্নয়নে বঙ্গবন্ধু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। সদ্যস্বাধীন দেশের ৩০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতি পূরণে বঙ্গবন্ধু তাত্ক্ষণিক আমদানির মাধ্যমে এবং স্বল্প মেয়াদে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, উন্নত বীজ, সেচ ও অন্যান্য কৃষি-উপকরণ সরবরাহ করে এবং কৃষিঋণ মওকুফ, সার্টিফিকেট মামলা প্রত্যাহার ও খাসজমি বিতরণ করে কৃষিক্ষেত্রে উত্পাদনশীলতা ও উত্পাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘একটা স্বল্প সম্পদের দেশে কৃষি পর্যায়ে অনবরত উত্পাদন-হরাসের পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা যেতে পারে না। দ্রুত উত্পাদন বৃদ্ধির সকল প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। চাষিদের ন্যায্য ও স্থিতিশীল মূল্য প্রদানের নিশ্চয়তা দিতে হবে।’ তিনি কৃষিতে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের জন্যে কৃষি ব্যাংক স্থাপন করেন। উন্নত বীজ ও প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেন, উচ্চতর কৃষি গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
১৯৭৩ সালের মধ্যেই ধ্বংসপ্রাপ্ত কৃষি-অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ ও কৃষি-যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্যে হরাসকৃত মূল্যে ৪০ হাজার শক্তিচালিত লো-লিফট পাম্প, ২৯০০টি গভীর নলকূপ ও ৩০০০টি অগভীর নলকূপের ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৭২ সালের মধ্যেই জরুরি ভিত্তিতে বিনামূল্যে এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে অধিক কৃষিপণ্য উত্পাদনের জন্যে ১৬,১২৫ টন ধানবীজ, ৪৫৪ টন পাটবীজ ও ১০৩৭ টন গমবীজ সরবরাহ করা হয়। পাকিস্তানি শাসনকালে রুজু করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা থেকে কৃষকদের মুক্তি দেয়া হয় ও তাঁদের সকল বকেয়া ঋণ সুদসহ মাফ করে দেয়া হয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা চিরদিনের জন্যে রহিত করা হয়। আগের সমস্ত বকেয়া খাজনাও মাফ করা হয়। ধান, পাট, তামাক ও আখসহ গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির লক্ষ্যে ন্যূনতম ন্যায্যমূল্য বেঁধে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামাজিক ন্যায় বিচার ও দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষ্যে কৃষি-উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। ঐ সময় দেশে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা ছিল শতকরা ৩৫ ভাগ। বিরাজমান খাসজমির সাথে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণযোগ্য জমির সরবরাহ বৃদ্ধির জন্যে বঙ্গবন্ধু পারিবারিক ও ব্যক্তিগত মালিকানার পরিধি কমিয়ে এনে পরিবারপিছু জমির সিলিং ১০০ বিঘায় নির্ধারণ করে দেন। ১৯৬৮-৬৯ সালের ১১ হাজার শক্তিচালিত পাম্পের স্থলে ১৯৭৪-৭৫ সালে এই সংখ্যা ৩৬ হাজারে উন্নীত করা হয়। এর ফলে সেচের আওতাধীন জমির পরিমাণ এক-তৃতীয়াংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬ লাখ একরে উন্নীত হয়। বিশ্ববাজারে রাসায়নিক সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষককে সারে ভর্তুকি দিয়ে রক্ষা করেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, কৃষিই যেহেতু এ দেশের জাতীয় আয়ের প্রধান উত্স সেহেতু কৃষির উন্নতিই হবে দেশের উন্নতি। ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক জনসভায় তিনি বলেন যে, ‘আমি চাই বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষক ভাইয়ের কাছে যারা সত্যিকার কাজ করে, যারা প্যান্ট-পরা কাপড়-পরা ভদ্রলোক তাদের কাছেও চাই-জমিতে যেতে হবে, ডবল ফসল করুন। প্রতিজ্ঞা করুন, আজ থেকে ঐ শহিদদের কথা স্মরণ করে ডবল ফসল করতে হবে। যদি ডবল ফসল করতে পারি, আমাদের অভাব ইনশা-আল্লাহ্ হবে না।’ কৃষি ও কৃষকের উন্নতি-বিশেষ করে অধিক ফসল উত্পাদন, সেই সঙ্গে উত্পাদিত কৃষিপণ্য কৃষকরা যাতে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও বাজারজাত করতে পারে সেদিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল। সদ্যস্বাধীন দেশে কৃষি-উত্পাদনের প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সরবরাহ খুব বেশি না থাকলেও এগুলোর প্রয়োজনীয়তা তিনি অনুভব করতেন। ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বঙ্গভবনে নবনিযুক্ত জেলা-গভর্নরদের প্রশিক্ষণ-কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কৃষকদের জন্যে গভর্নরদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে উল্লেখ করেন, “ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কের জন্য পাম্প পেলাম না, এটা পেলাম না-এসব বলে বসে না থেকে জনগণকে মবিলাইজ করুন। যেখানে খাল কাটলে পানি হবে সেখানে সেচের পানি দিন। সেই পানি দিয়ে ফসল ফলান। …আমি খবর পেলাম, ঠাকুরগাঁয়ে একটা কোল্ডস্টোরেজ করা হয়েছে। এক বছর আগে সেটা হয়ে গেছে। কিন্তু পাওয়ার নাই। খবর নিয়ে জানলাম, পাওয়ার সেখানে যেতে এক বছর লাগবে। কারণ, খাম্বা নাই। খাম্বা নাকি বিদেশ থেকে আনতে হবে। মিনিস্টার সাহেবকে বললাম, খাম্বা-টাম্বা আমি বুঝি না। বাঁশ তো আছে। এখানে দাঁড়াও, খাম্বা কাটো, দা লাগাও। দেড় মাস, দুই মাসের মধ্যে কাজ হয়ে যাবে। এটা লাগাও। কী করে লাগবে, সেটা আমি বুঝিটুঝি না। দিল, লেগে গেল। কিন্তু আমার কাছে যদি না আসত, এক বছরের আগে খাম্বা পেত না। খাম্বা আসে কোত্থেকে? পাওয়ার গেল, আলু রাখল।”
বঙ্গবন্ধুর এসব সচেতন ও কৃষকদরদী নীতির ফলে কৃষিক্ষেত্রে অগ্রগতির যে-ধারা সূচিত হয়েছিল তারই ফলে আজ কৃষিক্ষেত্রে শক্তিশালী ধারা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমান সরকার যে কল্যাণধর্মী ও কৃষকবান্ধব উন্নয়ন নীতি কৌশল গ্রহণ করেছে তা বঙ্গবন্ধুর কৃষিভাবনারই প্রতিফলন। দেশের অধিকাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। সেদিকে খেয়াল রেখেই বর্তমানে অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে যাতে সুবিধাবঞ্চিত এই সম্ভাবনাময় জনশক্তিকে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করা যায়। আধুনিক প্রযুক্তির যে আকাশছোঁয়া অগ্রগতি হয়েছে তার সুফল কী করে কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় সেই ভাবনাও চলছে। কৃষকদের ভূমির অধিকার, ঋণপ্রাপ্তির অধিকার, উত্পাদনের ন্যায্যমূল্য পাবার অধিকার, স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তানদের শিক্ষা পাবার অধিকার নিশ্চিতকরণের প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সরকার কৃষক ও কৃষির কল্যাণে নানা প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছে। উত্পাদন খরচ কমানোর জন্যে সার, বীজ, সেচসহ কৃষি উপকরণে ভর্তুকি সহায়তা, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য গুদামের ধারণক্ষমতা বাড়ানো এবং কৃষি গবেষণা, জৈবপ্রযুক্তি, জেনেটিক প্রকৌশল ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদের কৃষিবিজ্ঞানীরা খরা, লবণাক্ততা ও জলমগ্নতা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন।
এসব উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রকৃত কৃষক, বর্গাচাষি ও প্রান্তিক কৃষকদের ঋণ সেবাসহ আধুনিক ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানোর উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কৃষকের অধিকারকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণয়ন করা হচ্ছে যুগোপযোগী কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল ৯,২৮৪ কোটি টাকা, সেখানে গত অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে ১৬,০৩৭ কোটি টাকা। পাঁচ বছরের ব্যবধানে কৃষি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি প্রায় ৭৩ শতাংশ। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের অংশ হিসেবে কৃষকদের দশ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার সুযোগ করে দেয়া হয়। প্রায় ৯৭ লাখ কৃষক দশ টাকায় ব্যাংক হিসাব খুলেছে। কৃষকের এসব হিসাব সচল রাখার মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে অধিকতর গতিশীল করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০ কোটি টাকার একটি পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করেছে। ব্যাংকগুলো সরাসরি কিংবা এমআরএ’র অনুমোদনপ্রাপ্ত এমএফআই’র সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ তহবিলের সুবিধা নিয়ে দশ টাকার হিসাবধারীদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করতে পারে। উপেক্ষিত বর্গাচাষিদের ঋণ সুবিধা প্রদানের জন্যে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে এক অভিনব প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রথমবারের মতো গঠন করে ৫০০ কোটি টাকার একটি ঘূর্ণায়মান পুনঃঅর্থায়ন তহবিল। একটি অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত এ প্রকল্পের আওতায় পাঁচ বছরে (জুন ২০১৪ পর্যন্ত) দেশের ৪৮ জেলার ২৫০টি উপজেলায় ৮ লাখ ৬৩ হাজার বর্গাচাষিকে ১,৩২৮ কোটি টাকা অর্থায়ন করা হয়েছে। ঋণ পাওয়া বর্গাচাষিদের জীবনমানে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এই বর্গাচাষিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারী। ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে আমদানি নির্ভর আদা, রসুন, পেঁয়াজ, মরিচ, হলুদ চাষে রেয়াতি সুদহারে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গত চার অর্থবছরে আমদানি নির্ভর এসব ফসল চাষে ব্যাংকগুলো কৃষক পর্যায়ে ৩০৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। ইতোমধ্যে ব্যাংকিং খাতের ‘প্রো-একটিভ’ এই উদ্যোগের ফলে এসব পণ্যের মূল্যে আগের চেয়ে অনেকটাই স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কৃষি ও কৃষকের অবস্থার উন্নতির জন্যে দরকার কৃষকের নিজস্ব জমির ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনের সময় কম দামে কৃষকদের সার ও কীটনাশক সরবরাহ করা, কৃষকের উত্পাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য দেয়া, পচনশীল ফসল সংরক্ষণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, কম দামে সেচযন্ত্র ও অন্যান্য কৃষি-যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা এবং আধুনিক চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা। এসব কিছুরই সূচনা করে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মূলত কৃষক ও কৃষির উন্নতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে দেশের কল্যাণ। মাথা ছাড়া যেমন মানবদেহ ভাবা যায় না, তেমনি কৃষির উন্নতি ছাড়াও আমাদের অর্থনীতির উন্নতির কথা ভাবা যায় না। তাই কৃষির আরো উন্নতি ঘটাতে পারলেই আমাদের অর্থনীতির পালে জোর হাওয়া লাগবে। তখন বাংলাদেশ হয়ে ওঠবে সত্যিকারের সোনার বাংলা, যেমনটি বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন।
লেখক : ড. আতিউর রহমান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর
ইত্তেফাক, ১৫ আগস্ট ২০১৪ লিংক