বঙ্গবন্ধুর অন্তরজুড়ে কৃষি ও কৃষক

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

বঙ্গবন্ধুর জন্ম গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক কৃষক পরিবারে। গ্রামীণ কৃষক সমাজের মধ্য থেকে উঠে আসা বাঙালির রাজনৈতিক নেতা হিসেবে মাটি আর ফসলের সঙ্গে বাঁধা জীবন-জীবিকাকেই তিনি সারাটি জীবন দেখেছেন বাঙালির শক্তির আধার হিসেবে। জন্মভূমির মাটির কৃষকদের হৃদয়ে এখনও সমান উজ্জ্বলতায় আলো ছড়াচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। আমি আমার অনুষ্ঠানের কাজে অনেকবারই টুঙ্গিপাড়া গেছি। সেখানে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি নিয়ে কথা বলেছি পুরনো মানুষের সঙ্গে। বিশেষ করে যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্যবেলাটি জানেন। কয়েক বছর আগে বঙ্গবন্ধুর এক প্রতিবেশী ৮০ ছুঁই ছুঁই এক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, বঙ্গবন্ধু বাল্যবেলা থেকেই জনদরদি ছিলেন। একবার দেশে খুব খাদ্য সংকট। তখন বঙ্গবন্ধু নিজের বাড়ির গোলার ধান বন্ধুদের সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে এলাকাবাসীর মাঝে বিতরণ করেন। বাবাকে জানান, তাকে বেঁধে রেখে ডাকাত ধান লুট করে নিয়ে গেছে। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ঠিকই বুঝতে পারেন। তিনি কিশোর ছেলের এই জনদরদি স্বভাব উপলব্ধি করে মনে মনে খুশিও হন। ভৌগোলিকভাবেই গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও আশপাশ এলাকা জলমগ্ন থাকে বছরের অর্ধেকটা সময়। বহুকাল আগে থেকেই ওই অঞ্চলে ভাসমান চাষের রেওয়াজ রয়েছে। সেখানকার কৃষক পরিবারের সন্তান হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাল্যবেলা থেকে ওই প্রতিকূল পরিবেশের কৃষকদের দুঃখ-কষ্ট খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করার সুযোগ পান।

এই বাংলায় সব যুগেই কৃষকদের বিদ্রোহ করতে হয়েছে শাসকের বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধু তার নিজস্ব বিবেচনাবোধ আর বিচক্ষণতা দিয়ে আবিস্কার করেন এই বাঙালির প্রাকৃতিক ও কৃষিজ সম্পদকে কীভাবে ধ্বংস করছে পাকিস্তানিরা। ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে ময়মনসিংহে অবস্থিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেখানে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘সবুজ বিপ্লবের কথা আমরা বলছি। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের যে অবস্থা, সত্য কথা বলতে কি- বাংলার মাটি, এ উর্বর জমি বারবার দেশ-বিদেশ থেকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে ও শোষকদের টেনে এনেছে এ বাংলার মাটিতে। এত উর্বর এত সোনার দেশ যদি বাংলাদেশ না হতো, তবে এতকাল পরাধীন থাকতে হতো না। যেখানে মধুরা থাকে সেখানে মক্ষীরা উড়ে আসে। সোনার বাংলার নাম আজকের সোনার বাংলা নয়, বহুদিনের সোনার বাংলা। বাংলার মাটির মতো মাটি দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায় না- বাংলার সম্পদের মতো সম্পদ দুনিয়ায় খুঁজে পাওয়া যায় না। সে জন্য শোষকদের দল বারবার বাংলার ওপর আঘাত করেছে এবং তাদের শক্তি দিয়ে বাংলাকে দখল করে রেখেছে।

সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মনোযোগ ছিল কৃষির প্রতি। তার সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার মানুষের খাদ্যের জোগান দেওয়া। নানামুখী তৎপরতায় সে যাত্রায় সফল হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীন ভূখণ্ডের কৃষির গতিপ্রকৃতি পাল্টে দেওয়ার নানামুখী স্বপ্ন দেখেন। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে পরিবারপ্রতি জমির মালিকানা ৩৭৫ বিঘা থেকে কমিয়ে ১০০ বিঘায় নামিয়ে আনেন এবং ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। তিনি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাত থেকে ভূমির মালিকানা বের করে এনে ভূমিহীন ক্ষুদ্র কৃষকদের মাঝে তা বিতরণের উদ্যোগ নেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সমবায় চিন্তার পর এই বাংলায় সমবায় ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় রূপরেখা রচনা করেন বঙ্গবন্ধু। তার আদেশেই ব্যবস্থা রাখা হয় সমবায়ী পদ্ধতিতে কৃষকদের মধ্যে জমি বন্দোবস্তের। এ ক্ষেত্রে কৃষকদের সমবায় সমিতিগুলোর মাধ্যমে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনার ভিত্তিতে ঋণ ও অন্যান্য ইনপুটস সহায়তার কথাও বলা হয়। ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১৩৫-এ বঙ্গবন্ধুর কৃষি সংস্কারের দৃষ্টিভঙ্গির আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়, আর তা হলো : এতে নদী কিংবা সাগরগর্ভে জেগে ওঠা চর জমির মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে নিয়ে দরিদ্রতর কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থার বিধান। মহাজন ও ভূমিদস্যুদের হাত থেকে গরিব কৃষকদের রক্ষাই উদ্দেশ্য ছিল তার। সে কারণে হাটবাজারে ইজারাপ্রথার বিলোপ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কৃষিজপণ্যের খুদে বিক্রেতাদের শুল্ক্ক থেকে অব্যাহতি দিয়েছিলেন।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বহুকাল ধরেই ঘাঘর নদীতে নৌকাবাইচ হয়ে আসছে। আমরা চ্যানেল আইয়ের পক্ষ থেকে একবার ওই নৌকাবাইচ সরাসরি সম্প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিভিশনে ওই নৌকাবাইচ দেখেছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাতে তার বাল্যবেলায় বাবা বঙ্গবন্ধুর ওই নৌকাবাইচের সঙ্গে সম্পৃক্ততার স্মৃতি নিয়ে গল্প করেন। তিনি জানান, বঙ্গবন্ধু জীবদ্দশায় ঘাঘর নদীর নৌকাবাইচ আয়োজন করতেন। ঘাঘর নদীর ব্রিজের ওপর থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নৌকাবাইচ উপভোগ করতেন। পুরস্কার হিসেবে দূরদূরান্ত থেকে আসা মাঝিদের কাঁসার কলস উপহার দিতেন। বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বঙ্গবন্ধুর কৃষি ও গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ততার নানা কথা শুনেছি। তিনি কৃষিকে দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ হিসেবে দেখতেন বলেই এ দেশের কৃষিজীবী মানুষের ভেতরের শক্তিটি আবিস্কার করেছেন বারবার। বঙ্গবন্ধু কৃষির সমৃদ্ধির ভেতর দিয়েই আবিস্কার করতেন একটি সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়নচিন্তা, বিশ্ববিক্ষণ, সমাজচিন্তা ও দারিদ্র্যমুক্তি ছিল একই সূত্রে গাঁথা। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় দেওয়া তার বক্তৃতায় আমরা দেখি, যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার অদম্য তাড়না। তিনি এ দেশের এমন কিছু সংকট ও সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরেন, তা শুধু তখনকার প্রেক্ষাপট নয়, আজও দেশের এক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। তিনি তার বক্তৃতায় বলেন, ‘ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির ফলে খাদ্যের দাম গরিব দেশগুলোর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। অন্যদিকে ধনী ও উন্নত দেশগুলি হচ্ছে খাদ্যের মূল রফতানিকারক। কৃষি যন্ত্রপাতি ও উপকরণের অসম্ভব দাম বাড়ার ফলে গরিব দেশগুলোর খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টাও তেমন সফল হতে পারছে না।’

বঙ্গবন্ধুর জীবনের এই বিশাল ক্ষেত্রগুলো নিয়ে এখনও বিস্তৃত গবেষণার সুযোগ রয়েছে। তার উন্নয়নচিন্তা এই বাংলার জন্য সারাটি জীবন দিয়ে যাবে নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন বাস্তবায়নে হাত দিয়েছিলেন ১৯৭৫-এ এসে। যার বাস্তবায়ন এ দেশের মানুষের দেখার সুযোগ হয়নি। যাকে বলা হয় বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব। যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার। আর সংস্কারের প্রধান শক্তি হিসেবে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল সমবায়ের। কৃষি ও সমবায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই অভিযাত্রার স্মৃতি এখনও রয়েছে অনেক কৃষকের কাছে। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা রোধ, দুর্নীতি রোধ এবং জাতীয় ঐক্য গঠনে সমাজকে সচেতন করে তুলতে পারলেই সফল হবে দ্বিতীয় বিপ্লব। আর এই বাংলার কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীকে তার যথাযথ মর্যাদা দিতে পারলেই এই জাতি এগিয়ে যাবে কয়েক ধাপ। কিন্তু এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বহু আগেই যে দুষ্টচক্র বাসা বেঁধেছিল, বঙ্গবন্ধু জীবনের বিভিন্ন পর্যায়েই তা উপলব্ধি করেছেন। বঙ্গবন্ধু বারবার অকপট উচ্চারণে যে শত্রুর বিলোপ ঘটাতে চেয়েছেন। কিন্তু ১৯৭৫-এর আজকের এই তারিখেই থেমে যায় একটি দীর্ঘ স্বপ্নের যাত্রাপথ। বঙ্গবন্ধু ওই স্বার্থান্ধ, উচ্চাভিলাষীর একাংশের হাতে সপরিবারে শাহাদাতবরণ করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু চার দশকেরও বেশি আগে এই বাংলাদেশের ৫ শতাংশ ধনিক, ঘুষখোর দুর্নীতিবাজের যে শ্রেণির কথা বলেছিলেন, আজও সেই শ্রেণির বিলোপ ঘটানোর অপরিহার্যতা রয়েছে। আজও দিবালোকের মতো সত্য, কৃষি আর কৃষক নিয়ে তার সব উচ্চারণ।
শাইখ সিরাজ
সমকাল, ১৬ আগস্ট ২০১৯ লিংক 

আরও পড়ুন