১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাঙালি জাতি হারিয়েছিল তাদের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেদিন এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের আরো যাঁরা শিকার হয়েছিলেন তাঁরা হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্য। এমনকি সেদিনের পাশবিক হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও। আর তাই ১৫ আগস্টের এই হত্যাকাণ্ড ইতিহাসের সব নির্মমতাকে হার মানিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু একটি সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকীতে একটি মডেল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে আজও বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাভরে তাঁকে স্মরণ করে। তিনি চিরকাল বাঙালির স্মরণের সরোবরে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর অবদানের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করেছি, তা ভবিষ্যতে শোষণহীন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ আমাদের কাছে শুধু আদর্শ হিসেবে না থেকে তা উন্নয়নের মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আমাদের আর্থ-সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক উন্নয়নে পাথেয় হিসেবে কাজ করবে।
অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার অনুসারী ও প্রবর্তক বঙ্গবন্ধু ধর্মান্ধতাভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে ছিলেন প্রচণ্ড সোচ্চার। তিনি ছিলেন মানবতা, মনুষত্ব ও সততার প্রতীক; বিশ্বের মধ্যে সাহসী ও অকুতোভয় রাজনৈতিক নেতা; শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি; রাজনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী ও স্বপ্নদ্রষ্টা; জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক, বাহক ও প্রবর্তক; ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতি ও উন্নয়নের বিরুদ্ধে শক্তিবীর ও আদর্শিক রাজনৈতিক নেতা; বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও অবিভাজ্য বাঙালি জাতিসত্তা সৃষ্টির অনবদ্য ও অদ্বিতীয় নেতা; ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থার জনক; জাতি গঠনে অনমনীয় ও কঠোর প্রত্যয়ী; গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের ধারক ও বাহক। তিনি ছিলেন দেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের প্রতীক, মানবতার প্রেমিক; সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি (BBC বাংলা বিভাগের জরিপের প্রতিফলন) স্বাধীনতার ইতিহাসের সৃষ্টিকারী; একটি পতাকা, একটি মানচিত্র ও একটি দেশের অবিস্মরণীয় প্রতীক; একটি সফল আন্দোলন ও বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠার জনক; একটি জাতির উত্থান, স্বাধীনতার সোপান ও রাষ্ট্রের স্থপতি; বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহাকাব্যের মহানায়ক; অগ্নিঝরা স্বাধীনতার প্রতীক; মুক্তিযুদ্ধের অদ্বিতীয় ও অকৃত্রিম সংগঠক; সমতা ও সমাজবাদী সমাজ গঠনের বিমূর্ত প্রতীক; বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা; প্রগতিশীল আদর্শের অদ্বিতীয় ধারক ও বাহক এবং নির্মোহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৬-৫৭ সালে আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় তিনটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু বাঙালি জাতির দেশ গঠনের দূরদর্শী লক্ষ্যে অবলীলাক্রমে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন; তিনি ছিলেন জাতীয় ঐক্য ও সংহতির প্রতীক; অসাধারণ সাংগঠনিক দক্ষতা ও কৌশলের অধিকারী; সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিভাবক (জনগণের); হতদরিদ্র, দুঃখী ও শ্রমিক শ্রেণির মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু ও ভালোবাসার প্রতীক; আদর্শের ধারক, বাহক ও বাস্তবায়নের মূর্তপ্রতীক; উন্নয়ন ও প্রগতির দার্শনিক ও রাজনৈতিক শক্তি; শ্রেণিহীন সমাজ গড়ার কারিগর; গভীর মানবিক ও সংগ্রামী বৈশিষ্ট্যের অধিকারী; গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার শক্তিশালী সংগঠক; খোলামেলা মনের মানুষ; সাংগঠনিক দক্ষতা; মোহনীয় বাচনভঙ্গি; কথা বলার দৃঢ়তা ও দীপ্ততা, গণমানুষের প্রতি তাঁর অনুভূতি; কথার তীক্ষ্ণতা; মোহনীয় ব্যক্তিত্ব; প্রতিরোধ ক্ষমতা; সাহসী পদক্ষেপ ও ভূমিকা; দায়িত্বশীলতা; প্রতিবাদ করার ভাষা ও ক্ষমতা; আত্মবিশ্বাস; মানুষকে কাছে টানার আকর্ষিত ক্ষমতা; দর্পণ ও দর্পণ শক্তির অধিকারী; দূরদর্শিতাসম্পন্ন স্বাধীনতার দ্রষ্টা; ধর্মনিরপেক্ষতার প্রদর্শক; আদেশ প্রদানের ক্ষমতা; গণমানুষের জন্য জীবনদানের প্রত্যয় ও অঙ্গীকার; নির্ভীক ও অকুতোভয় পদক্ষেপ নেওয়ার সাহস; ঘোষণা দেওয়ার ক্ষমতা; বিশ্বাসযোগ্যতা; সুদক্ষতা; কার্যসিদ্ধিমূলক কর্মপরিকল্পনা ও তার প্রায়োগিক ক্ষমতা; মানুষকে কাছে টানার চুম্বকশক্তি; শ্রেণিহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার; সমতা ও সাম্যতার প্রতীক; যেকোনো বিষয়কে সমন্বয় করার দক্ষতা; ভালোবাসা ও আবেগকে যৌক্তিক রূপায়ণের ক্যাপাসিটি; উঁচু দরের কূটনৈতিক ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মহানায়ক। বঙ্গবন্ধু শুধু একজন রাজনৈতিক নেতা ও রাষ্ট্রনায়ক নন; বরং ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত, শোষণমুক্ত জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রতীক।
যারা বঙ্গবন্ধুর অবদান অস্বীকার করে তারা মূলত এ দেশের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে এবং তারা এ দেশে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার পরিবর্তে সাম্রাজ্যবাদী ঘৃণ্য শক্তির ষড়যন্ত্রের প্রতীক। অন্যদিকে রাজাকার, আলবদর ও যুদ্ধাপরাধীদের ধারাবাহিক গণহত্যা ও মানুষের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্রকারী। তারা বাংলাদেশে বিশ্বের তল্পিবাহক ও তাঁবেদার পৃষ্ঠপোষক সরকার ও রাষ্ট্রনায়ক দেখতে চায়, যা প্রকারান্তরে নির্ভরশীল সরকার গঠনের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা, জননেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় সাম্রাজ্যবাদীর সেই প্রত্যাশা গুঁড়িয়ে দিয়ে Vision-2021-এর রূপরেখা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তাঁর সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় ছাড়িয়ে গেছে ৩৩ বিলিয়ন US dollar, যাঁর সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭.৫ শতাংশ। Human Development Index-এ পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তান এবং মিয়ানমার বাংলাদেশ থেকে বেশ পিছিয়ে। অন্যদিকে বেহফবৎ উবাবষড়ঢ়সবহঃ ওহফবী-এ দক্ষিণ ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থানে। একইভাবে গড় মৃত্যু, মাতৃমৃত্যু এবং নবজাতক ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস করার ক্ষেত্রে এবং SDG লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে, আর যে কারণে গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা পেয়েছেন জাতিসংঘের একাধিক পুরস্কার, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘The Champion of the Earth’| আর এসবই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে সমাপ্ত করার দৃঢ়প্রত্যয় ও প্রয়াস।
ড. খোন্দকার মোকাদ্দেম হোসেন,
উপ-উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
২৫ আগস্ট, ২০১৯ , দৈনিক কালের কন্ঠ