স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন ভূমির জনক বঙ্গবন্ধু

সম্পাদনা/লেখক: ইফতেখার মোহাম্মদ

১৭ মার্চ ১৯২০ সালে ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমাধীন টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর জীবনই ছিল সংগ্রামী ইতিহাসের। একদিকে সংগ্রামী নেতা, অন্যদিকে বিনয়ী ও ধার্মিক। সত্য উদ্ঘাটনে ও প্রতিবাদে ছিলেন লৌহমানব। সম্মান দিতে কখনো কার্পণ্য করেননি গুরুজনদের। সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে তিনটি বড় ধরনের জাতীয় সমস্যা ছিল তাঁর বড় বাধা, যা পর্যায়ক্রমে দক্ষতার সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে সক্ষম হয়েছেন।

ক. ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের বেড়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়া, খ. বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, গ. পাকিস্তান সরকারের দ্বিমুখী আচরণে (যেমন—৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যথাক্রমে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসনে জয়যুক্ত হয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা প্রকাশের কারণে ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সৃষ্টি ও লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম)। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু তাঁর সংগ্রামী জীবনে বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের কারণে তিনি অবিসংবাদিত নেতা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার ঘোষক এবং সর্বোপরি জাতির পিতা বিভিন্ন উপাধিতে ভূষিত হন। তাঁর রাজনৈতিক জীবনে কষ্টের শেষ ছিল না, যা সহজেই অনুমেয়। সমগ্র বাংলাদেশের বেশির ভাগ থানা, মহকুমা ও জেলায় হেঁটে, ঘোড়া ও গরুর গাড়িতে চড়ে, রিকশা, ভ্যান, সাইকেল, নৌকা ও জিপ গাড়িযোগে শত শত মাইল পাড়ি দিয়ে গণসংযোগ করেছেন। সে সময় রাস্তাঘাটে যানবাহনের তেমন সুযোগ ছিল না। মাতৃভাষা রক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে ২৩ বছরে জেল খেটেছেন প্রায় ১৪টি বছর। বেশ কয়েকবার জেল থেকে মুক্তি পেলেও পুনরায় জেলগেট থেকেই বিনা কারণে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার হতে হয়েছে বারবার। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত জেল-জুলুমের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন জীবনের স্বর্ণোজ্জ্বল অংশটুকু। বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমার জীবনের একমাত্র কামনা, বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায়, শিক্ষা পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়।

“বিশ্বখ্যাত যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউজউইক’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘শেখ মুজিব সুপারম্যান ও রাজনীতির কবি’।” তিনিই একমাত্র নেতা, যিনি একই সঙ্গে একটি স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন ভূমির জনক। ১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখলাম। ব্যক্তিত্বে ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয় পর্বতের মতোই। আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম।’ ‘মিসরের শ্রেষ্ঠ সাংবাদিক হাসনাইন হাইকেল বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নন, বাঙালি জাতির মুক্তির দূত। তাঁর বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাঙালির সভ্যতা ও সংস্কৃতির নব অভ্যুদয়মন্ত্র।’ মুজিব বাঙালির অতীত ও বর্তমানের শ্রেষ্ঠ মহানায়ক। ‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন লন্ডনের এক বাঙালি সাংবাদিকের কাছে লেখা শোকবাণীতে বলেন, ‘এটা আপনাদের কাছে অবশ্যই এক বিরাট ন্যাশনাল ট্র্যাজেডি। আমার কাছে এক পরম শোকাবহ পার্সোন্যাল ট্র্যাজেডি।’ আসলে জাতির পিতা বলতে এখানে নেশন-স্টেটের প্রতিষ্ঠাতাকে বোঝানো হয়েছে। যেমন—কামাল আতাতুর্ক নব্য তুরস্কের জনক, মহাত্মা গান্ধী নতুন ভারতের পিতা, শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মডার্ন নেশন-স্টেটের নির্মাতা এবং বাঙালি জাতির জনক।

বঙ্গবন্ধু বলতেন, আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে; আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই—এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমরা লেবাসসর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রাসুলে করিম (সা.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগদ্বাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বারবার যারা অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে, আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফিকদের বিরুদ্ধে। যে দেশে শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের ভাবনা ভাবতে পারেন তাঁরাই, ইসলামকে যাঁরা ব্যবহার করেন দুনিয়াটা শায়েস্তা করার জন্য।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যেমন একজন খাঁটি বাঙালি, তেমনি ছিলেন একজন ইমানদার মুসলমান। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে তিনি যে নির্বাচনী অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন, নির্বাচনের সেই অঙ্গীকার তিনি তাঁর সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বল্পকালীন শাসনামলে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জনমানুষের ইসলাম প্রচার ও প্রসারে যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, সমকালীন মুসলিম বিশ্বে এর দৃষ্টান্ত বিরল। নিচে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক গৃহীত কার্যক্রমের কয়েকটি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করা হলো:

১. ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এক অধ্যাদেশবলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন, ২. বাংলাদেশ সিরাত মজলিশ প্রতিষ্ঠা, ৩. বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড পুনর্গঠন (পূর্বে স্বায়ত্তশাসিত মাদ্রাসা বোর্ড ছিল না), ৪. বিশ্ব ইজতেমার জন্য টঙ্গীতে সরকারি জায়গা বরাদ্দ, ৫. কাকরাইলের মারকাজ মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য জমি বরাদ্দ, ৬. হজ পালনের জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা, ৭. ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.), শবেকদর, শবেবরাত উপলক্ষে ছুটি ঘোষণা এবং উল্লিখিত দিনগুলোতে সিনেমা হলে সিনেমা প্রদর্শন বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান, ৮. মদ, জুয়া, হাউজি ও অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধকরণ এবং শাস্তির বিধান, ৯. রেসকোর্স ময়দানের ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা বন্ধকরণ, ১০. রাশিয়ায় প্রথম তাবলিগ জামাত প্রেরণের ব্যবস্থা করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাশিয়ায় কমিউনিস্ট মতাদর্শের কারণে সেখানে বিদেশ থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি পেত না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম তাবলিগ জামাত প্রবেশের অনুমতির ব্যবস্থা করেছিলেন। ১১. আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরব বিশ্বের পক্ষে সমর্থন ও সাহায্য প্রেরণ, ১২. ওআইসি সম্মেলনে যোগদান ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ইত্যাদি। তা ছাড়া পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্রদের বিনা মূল্যে বই বিতরণ, যার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে এইচএসসি পর্যন্ত বিনা মূল্যে বই বিতরণ করার ব্যবস্থা করছেন বর্তমান সরকার। বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোজিত হলো ১,১১,৬০০ বর্গকিলোমিটার, যা ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামল থেকেই প্রক্রিয়াধীন ছিল, যেটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলেই গত ১৪ মার্চ ২০১২ সালে বাস্তবায়িত হলো। বাঙালি জাতি পেল বিশাল সমুদ্র জলসীমা। এটি আমাদের জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম উৎস।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সাড়ে তিন বছরের সংক্ষিপ্ত শাসনামলে ইসলামের খেদমতে যে অভূতপূর্ব নিদর্শন রেখে গেছেন, শুধু বাংলাদেশই নয়, গোটা বিশ্বেই এটি এক বিরল দৃষ্টান্ত। তবু এক শ্রেণির তথাকথিত লেবাসধারী মহল বঙ্গবন্ধুকে ইসলামবিদ্বেষী বলে চিত্রিত করার অপপ্রয়াস চালায়। অনুরূপভাবে বঙ্গবন্ধুর প্রতিষ্ঠিত দল আওয়ামী লীগকেও ওই স্বার্থান্বেষী মহল ইসলামবিদ্বেষী বলে জনসমক্ষে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। তবে যেকোনো অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য বেশি দিন স্থায়ী হয় না। তথাকথিত এই স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্তেই বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শাহাদাতবরণ করতে হয়েছে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ১৫ আগস্ট একটি কলংকিত অধ্যায়। যেদিন আমরা অপবাদ আর বিভ্রান্তির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত সোনার বাংলা গড়ে তুলতে পারব, সেদিনই সম্ভব হবে তাঁর অসামান্য ঋণের কিঞ্চিৎ পরিমাণ পরিশোধ করা। আমরা আল্লাহর দরবারে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গ এবং জেলহত্যার চার নেতাসহ ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। সব তথ্য এটাই প্রমাণ করে, সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু একজন দেশপ্রেমিক, জনদরদি ও ধর্মপ্রাণ মুসলিম নেতা, যিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার ঘোষক, বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির পিতা। ঘাতক কর্তৃক অকালমৃত্যুতে আজ বাঙালি জাতি শোকাহত। ১৫ আগস্ট বারবার ওই ভয়াবহ বেদনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মূল কথা হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র বাঙালি জাতির গর্ব, যিনি স্বাধীন জাতি ও স্বাধীন ভূমির জনক।

ডা. মো. ফজলুল হক
লেখক: সাবেক ডিন ও রেজিস্ট্রার,
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর

২০ আগস্ট, ২০১৯
দৈনিক কালের কন্ঠ

আরও পড়ুন