১৯৭১ সালে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। স্বাধীনতা লাভের পরবর্তী সময়ে ভৌগোলিক অবস্থান, স্বল্প পরিসরের ভূখণ্ড এবং সীমিত অর্থনৈতিক সম্পদ ইত্যাদি বিভিন্ন নিয়ামক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণের সুযোগকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি মূলত বহিঃশক্তির প্রভাব থেকে দেশের সাবভৌমত্ব ও ভূখণ্ডকে রক্ষা করার মতো বিষয়েই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার পতনের সাথে সাথে এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের যে সকল দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছিল সে সকল দেশের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে নেহরু, জিন্নাহ এবং তাদের মতো অনেকেই নিজেদের দেশের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যে সুযোগ পেয়েছিল তা ১৯৭১ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য বর্তমান ছিল না।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের পূর্ব থেকেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সূচনা। প্রকৃতপক্ষে মুজিবনগর সরকারই প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে বাইরের রাষ্ট্রগুলোর সাথে যোগাযোগ শুরু করে। এই পর্যায়ে পররাষ্ট্রনীতির যে কার্যক্রম তা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয়ে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। এই পর্যায়ে গৃহীত পররাষ্ট্রনীতির প্রভাব স্বাধীনতার পরও পরিলক্ষিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ইন্দো-সোভিয়েত অক্ষ এবং চীন-আমেরিকা অক্ষের মধ্যে বিরাজমান ক্ষমতার লড়াই বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং পরবর্তী সময়ে গৃহীত পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। দেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্য হিসেবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের যেমন প্রয়োজন ছিল, তেমনি অপরিহার্য ছিল অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে বৈদেশিক ঋণ-সাহায্য লাভের মাধ্যমে ধ্বংসপ্রাপ্ত অর্থনীতির সংস্কার সাধন। স্বাধীনতার পর পরই সোভিয়েত বলয়ভুক্ত কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো থেকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করা হয়। কিন্তু কমিউনিস্ট বলয়ভুক্ত পূর্ব-ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর তুলনায় পশ্চিম ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি অনেক ধীরগতির ছিল।
রাষ্ট্র হিসেবে অভ্যুদয়ের পর পরই ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং তিনি পররাষ্ট্রনীতির নতুন দিকনির্দেশনা প্রদান করে বলেন, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলনীতি ঘোষণা করেন: আমরা একটি ছোট রাষ্ট্র, আমাদের সকলের সাথে বন্ধুত্ব হবে এবং কারো সাথে শত্রুতা নয়। এরই ধারাবাহিকতায় তত্কালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য তুলে ধরেন, বাংলাদেশ সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে স্বাধীন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করবে, যার ভিত্তি হবে অন্য রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সমতা, ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণ। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম দশকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার কর্তৃক গৃহীত পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই দশকেই বাংলাদেশ মূলত বিশ্বের বেশিরভাগ রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন কমনওয়েলথ, ইসলামি সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি) এবং জোটনিরপেক্ষ সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। এছাড়া বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহের নেতৃত্বও দান করে।
১৯৭৪ সালের ২৯ অক্টোবর আমেরিকার তত্কালীন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার ২ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসছিলেন। ৩০ অক্টোবর বিকাল ৫.৩০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে আমেরিকার সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার এবং বাংলাদেশের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দুই ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা। আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, সকলের প্রতি বন্ধুত্ব কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়—এটাই আমাদের বন্ধুসুলভ সর্বাঙ্গীণ পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন ঘটায়। একজন নেতা এবং বক্তা জাতির পিতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কতটা দূরদর্শী ও দায়িত্বপরায়ণ ছিলেন তা সে সময় বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কিসিঞ্জার সাংবাদিকদেরকে যা বলেছিলেন তা থেকে সুস্পষ্ট—শেখ মুজিবুর রহমান প্রগাঢ় ধ্যান-ধারণাসম্পন্ন ব্যক্তি। একটি জাতির স্থপতি এ জাতীয় ব্যক্তির সঙ্গে আমার কদাচিত্ সাক্ষাত্ হয়েছে এবং এজন্য আজকের এই সাক্ষাত্কার আমার জন্য ছিল এক অনন্যসাধারণ অভিজ্ঞতা।
স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধুর অবদান অনস্বীকার্য। এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় জেএন দীক্ষিত কর্তৃক রচিত Liberation and Beyond নামক গ্রন্থে। এই গ্রন্থে বাংলাদেশের জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্র চিত্রণের লক্ষ্যে Persona of Sheikh Mujibur Rahman নামে একটি বিশেষ অধ্যায় রয়েছে। এ অধ্যায়ে জেএন দীক্ষিত বলেছেন, শেখ মুজিব চেয়েছিলেন বাংলাদেশকে উপমহাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে। জনসংখ্যার দিক থেকে পাকিস্তান থেকে বৃহত্তর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় হয়ে উঠবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুসলিম রাষ্ট্র। এ কারণেই স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভে আগ্রহী হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। তারপর বাংলাদেশ হবে ইসলামি সংহতি পরিষদের (Organization of Islamic Conference— OIC) সদস্য এবং মুসলিম বিশ্বে লাভ করবে গৌরবজনক এক অবস্থান। দীক্ষিত আরও লিখেছেন, মুজিব চেয়েছিলেন বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্র এবং পশ্চিম এশিয়া ও গালফ অঞ্চলের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এক সেতুবন্ধ রচনা করুক (পৃষ্ঠা ২২৪)। এসব কারণেই শেখ মুজিব পাকিস্তানের স্বীকৃতি, ওআইসির সদস্যপদ এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া, আলজেরিয়া, মিসর ও সৌদি আরবের সঙ্গে অর্থনৈতিক এবং নিরাপত্তা সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছেন। শেখ মুজিব আরও চেয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যে ভূমিকা পালন করেছে এবং এর ফলে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর বাংলাদেশের যে মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক নির্ভরশীলতা গড়ে উঠেছে, তা সঠিকভাবে ব্যালান্স করার জন্য চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে, যদিও মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা মোটেই সুখকর ছিল না। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রাখতে এবং ইসলামি সৌভ্রাতৃত্বের লক্ষ্যে তিনি চেয়েছিলেন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি আরবের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। তাই বলা যেতে পারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন দক্ষ নেতার পাশাপাশি ছিলেন একজন দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক। তিনি ছিলেন আপসহীন একজন নেতা, একজন রাষ্ট্রনায়ক। তার পররাষ্ট্রনীতির দিকনির্দেশনা বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত করেছে। তাকে হত্যা করার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তা কোনো দিনও পূরণ হয়ার নয়।
লেখক: ড. মো. আব্দুল্লাহ হেল কাফী
অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়