রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার সাফল্য ছিল আকাশচুম্বী। কিন্তু তাকে হাল ধরতে হয় এমন একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রের যার অর্থনীতি ছিল সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের হাল ধরতে গিয়ে তিনি দেশি- বিদেশী চক্রান্তকারীদের এবং তার নিজ দলের মধ্যেই গাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা সাম্রাজ্যবাদী চক্রদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং তার নিজ দলের একাংশের দুর্নীতিও তাকে পদে পদে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছিল। তবুও মাত্র সাড়ে তিন বছরের দেশ পরিচালনায় কিছু কিছু অভাবনীয় সাফল্যের জন্য তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে তার নাম লেখা থাকবে।
১) শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগের ফলে ১৯৭২ সালের ১২ই মার্চ ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। অথচ সে সময়ে অনেকেই আশংকা করেছিল যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী খুব সহজেই বাংলাদেশ ত্যাগ করবে না। ২) শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই একটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহন করতে সক্ষম হন। ১৯৭৩ সালের ১লা জুলাই থেকে এ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ৩) একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রন করা খুব একটা সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর চীনাপন্থী মুক্তিযোদ্ধারা এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তিসমূহ তাদের অস্র-শস্র সরকারের নিকট জমা দেয়নি। ফলে স্বাধীনতার পর পর দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটে। কিন্তু মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ১০ দিনের মধ্যে অস্র-শস্র জমা দেয়ার আহ্বান জানান। ফলে অনেকেই অস্রশস্র জমা দেওয়ায় দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি ঘটে। ৪) মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা পুরোপুরি ধবংস হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু সরকার অতি দ্রুত ভারতসহ বিভিন্ন বন্ধু রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে বিধ্বস্ত ও ধবংস প্রাপ্ত রাস্তাঘাট, সেতু,কালভার্টও বিমান বন্দর পুনরায় নির্মাণ করেন। রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সাহায্যে চট্টগ্রাম নৌবন্দরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনি করতিক পুতে রাখা মাইন অপসারন করে এ বন্দরটি পুনপ্রতিষ্ঠা করেন। ৫) স্বাধীনতা লাভের পর মুজিব সরকার একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। সরকারের হাতে কোন দেশীয় ও বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল ভীষণ দুর্বল। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের বিপুল পরিচিতি এ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতিকে পুনর্গঠনে বিরাট ভূমিকা রাখে। বিদেশী রাষ্ট্র ও দাতা সংস্থাসমূহ অকৃপণ হাতে বিভিন্ন দ্রব্য সামগ্রী প্রেরন করতে থাকে।
৬) বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালের ২৫ শে মার্চ পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান ব্যাংক বীমা প্রভৃতি জাতীয়করণ করেন। ৭) আওয়ামী লীগ সরকার ছিল একটি অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন। ব্যক্তিগতভাবে মুজিব ছিলেন সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষকে মূল্যায়ন করা এবং রাজনৈতিক বক্তব্য রাখাকে তিনি বরাবরই ঘৃণা করতেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটানোর জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি সংযোজন করেন যা উন্নত বিশ্বের প্রায় সকল দেশেই সমাদৃত। ৮) বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই বঙ্গবন্ধু জোট নিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী ছিল এবং অকৃত্তিম সমর্থন করেন। ৯) শেখ মুজিবের একটি বড় সাফল্য ছিল সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠান। জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হবার পূর্বেই এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করে তিনি দেশে ও বিদেশে গনতন্ত্রকামী মানুষের নিকট শ্রদ্ধা অর্জন করেন।
১০) বঙ্গবন্ধু সরকার ১০ মাসের মধ্যে একটি সংবিধান প্রনয়ন করে সারা বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল যেখানে পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর ৯ বছর পরেও তা করতে পারেনি। ১১) শেখ মুজিব সরকার শিক্ষা সংস্কারের জন্য ড. কুদরত-ই-হুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ‘কালা কানুন’ বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্ত শাসন প্রদান করেন যার সুফল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও ভোগ করছে। ১২) বঙ্গবন্ধু সরকার ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন। যাদের ১০০ বিঘার বেশী জমি আছে সেই বেশী জমি এবং নতুন জেগে উঠা চর বিনামুল্যে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়ার বিধান করেন। গ্রাম বাংলার ঋণ জর্জরিত কৃষকদের ঋণ মুক্তির জন্য খাই খালাসী আইন করেন যার ফলে ৭ বছর পরে মূল মালিক মহাজন থেকে তার জমি ফেরত পাবে।
১৩) বঙ্গবন্ধু সরকারই সর্বপ্রথম গ্রাম বাংলায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ‘পল্লী বিদুতায়ন বোর্ড' গঠন করেছিল। ১৪) বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ অতি দ্রুত সাফল্য লাভ করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত শতাধিক রাষ্ট্র এমনকি পাকিস্তানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ভারতের সাথে চুক্তির ফলে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল বাংলাদেশ লাভ করে এবং ফারাক্কা সমস্যা সমাধানের লক্ষে প্রথমিকভাবে বাংলাদেশ পানি বণ্টন চুক্তি অনুযায়ী ৪৪ হাজার কিউসেক পানি লাভ করে। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কোন সরকারই এতো বেশী পানি আনতে পারেনি। সুতরাং সন্দেহাতীতভাবে, যুদ্ধ পরবর্তী দেশ গঠনে মুজিব সরকারের সাফল্য ছিল অভাবনীয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন তার মত মহান ও অবিসংবাদিত নেতা ব্যতীত কখনো সম্ভবপর ছিল না। বঙ্গবন্ধুর শাসনামল সল্পকালীন হলেও সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এবং বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনে শেখ মুজিবের অবদান ছিল অপরিসীম। @খোরশেদ আলম, লেখক ও গবেষকই-মেইলঃ khurshadalam65@gmail.com