১৯৭৩ সালে বসন্তের এক বিকেলে যুদ্ধ খেলা শুরু হয়, স্থান লন্ডন। প্রধান চরিত্র ছিলেন বাংলাদেশের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ জিয়াউর রহমান। ভারতের বিচক্ষণ গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে জানা যায়, পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডির সদর দফতরে জেনারেলরা হতাশা ও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে গোয়েন্দা প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করছেন কীভাবে শেখ মুজিবুর রহমানকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়। হত্যাকাণ্ডের গণ্ডগোলের মধ্যে একজন জেনারেলের সামরিক ক্ষমতা গ্রহণ ঘটতে পারে কিনা সে বিষয়েও সম্ভাব্য অপশনগুলো আলোচনা হয়েছে রাওয়ালপিণ্ডিতে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা গোপনে একটি জনপ্রিয়তা যাচাই ক্যাম্পেইন করতে চাইছিলো যাতে এই বিশেষ অপারেশনের প্রস্তুতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তার আগে তারা সাধারণ জনগণের মধ্যে মুজিবের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডা তৈরি করে।
.>
শশাঙ্ক ব্যানার্জীকে থামিয়ে দিয়ে জানতে চাইলাম, জিয়াউর রহমানকেই টার্গেট করে রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধু হত্যা পরিকল্পনার ছক আঁকছেন, ১৯৭৩ সালেই এই সিদ্ধান্তে তিনি কেমন করে পৌঁছেছিলেন?
ব্যানার্জী বলতে শুরু করলেন, ‘রাওয়ালপিণ্ডির সামরিক গোয়েন্দা ও জেনারেলরা অ্যাবোটাবাদের যে প্রশিক্ষণ শিবিরে ট্রেনিং নিয়েছেন জিয়াউর রহমানও একই স্থানে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় তাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে। তাছাড়া জিয়াউর রহমান এর আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেই কর্মরত ছিলেন। তাই পাকিস্তানি গোয়েন্দা ও জেনারেলদের জন্য জিয়াউর রহমান ছিলেন একটি ভালো অপশন। ১৯৭৩ সালের দিকে ভারতে একটি গুজব চলছিলো যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ, এই দুই সংস্থা মিলে শেখ মুজিবের হত্যার পরিকল্পনা করেছে। আর সেই সময়ে জিয়াউর রহমান ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাছাড়া ভারতীয় গোয়েন্দা সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছিলাম জিয়াউর রহমান ওয়াশিংটনে গিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি অ্যাটাশের সঙ্গে বৈঠক করেছেন, অথচ জিয়াউর রহমান আমার সঙ্গে (শশাঙ্ক ব্যানার্জী) লন্ডনে বৈঠকের সময় কিন্তু নিজে থেকে বলেননি তার সঙ্গে আইএসআই এর বৈঠক হয়েছে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে আমি জানতে চাইলে জিয়াউর রহমান স্বীকার করেন, তিনি পাকিস্তানি মিলিটারি অ্যাটাশের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।
অন্যদিকে ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ইন্দিরা গান্ধী সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গোপসাগরে নিক্সনের পাঠানো ৭ম নৌবহরের উপস্থিতি উপেক্ষা করে ভারতীয় বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে। মার্কিন বাহিনীর ৭ম নৌবহর একটি গুলি না ছুঁড়েও ফিরে যাওয়া ছিলো চীনের সামনে মার্কিনিদের বিশাল পরাজয়। তাই ইন্দিরা গান্ধীর আশীর্বাদপুষ্ট সরকারকে উৎখাত করতে পারলে নিক্সনের ব্যক্তিগত ক্রোধ কিছুটা হলেও কমবে’ বলছিলেন শশাঙ্ক ব্যানার্জী।
শশাঙ্ক ব্যানার্জীর মতে, লন্ডনে ‘স্যুটকেস ওয়ার গেইম’ বৃত্তান্তই মুজিব হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সহায়তা করেছে। লন্ডনের স্যুটকেস ওয়ার গেইমের বৃত্তান্ত শুরু করার আগে আরেকটু পেছন থেকে শুরু করলেন ব্যানার্জী।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জন্য জোটবিরোধী নীতি তৈরিতে মনোযোগ দিয়েছিলেন। যুদ্ধকালীন যেমন ভারত ও রাশিয়া হয়ে উঠেছিলো বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু, তেমনি যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের ক্রম বিকশিত জোটবিরোধী নীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে বঙ্গবন্ধু ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ কর্নেল জিয়াউর রহমানকে তার ব্যক্তিগত প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৭৩ সালে ওয়াশিংটনে পাঠান। জিয়াউর রহমান ৬ সপ্তাহের যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় পেন্টাগন, সিআইএ এবং স্টেট ডির্পাটমেন্টের প্রধানদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পথে জিয়াউর রহমান লন্ডনে তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনের অ্যাটাশে শশাঙ্ক এস ব্যানার্জীর সঙ্গে দেখা করেন।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি, ফারুক রহমানের একটি স্যুটকেস ও কর্নেল ব্যাটন টি গচ্ছিত ছিলো শশাঙ্ক ব্যানার্জীর কাছে। লন্ডন থেকে ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে ফারুক রহমান তার একটি স্যুটকেস ও কর্নেল ব্যাটন রেখে যান শশাঙ্ক ব্যানার্জীর কাছে। জিয়াউর রহমান মূলত লন্ডন সফরকালে ফারুক রহমানের স্যুটকেসটি ফেরত নিতে গিয়ে ব্যানার্জীর সঙ্গে দেখা করেন। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক ব্যানার্জী জিয়াউর রহমানের ওয়াশিংটন সফরের আদ্যোপান্ত জানতে পারেন বলে জানান। ব্যানার্জী জিয়াউর রহমানের কাছে জানতে চাইলেন,‘ একজন উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকতা হয়েও তিনি কেন ফারুক রহমানের মতো অধীনস্ত কর্মচারীর স্যুটকেস নেওয়ার মতো তুচ্ছ কাজ করতে যাচ্ছেন?’ জবাবে জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, কর্নেল ফারুক আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই তার স্যুটকেসটি আমি নিজ হাতে পৌঁছে দিতে চাই।’ তখনই শশাঙ্ক ব্যানার্জী সামরিক ক্যুর মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা দখল করার গোপন ইচ্ছার বিষয়টা বুঝতে পারেন। ওয়াশিংটন সফরকালে পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে জিয়াউর রহমানের কী ধরনের কথা হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে জিয়াউর রহমানকে খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল বলেও বলেন ব্যানার্জী। একটি দেশের আর্মির ডেপুটি চিফ অব স্টাফকে এভাবে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে তাকে রীতিমত জেরা করে প্রশ্ন করার কারণে শশাঙ্ক ব্যানার্জী নিজেও প্রায় অজ্ঞান হবার যোগাড় হয়েছিলেন বলে জানান। ব্যানার্জী যা বলেছিলেন সেটা একজন সিনিয়র সামরিক অফিসারের তাঁকে গুলি করে মেরে ফেলার মতো উস্কানিমূলক বলেই মনে করেন শশাঙ্ক ব্যানার্জী। তবে শশাঙ্ক ব্যানার্জীর খোঁচাখুচির জবাবে জিয়াউর রহমান স্মিত হেসে জবাব দিলেন,‘আপনার ইশ্বর প্রদত্ত উর্বর কল্পনা শক্তি আছে, একটি স্যুটকেস নিয়ে আপনি আমার সঙ্গে রসালো যুদ্ধ খেলা খেললেন।’
জিয়াউর রহমানের সঙ্গে লন্ডনের কথোপকথনের বিস্তারিত নিয়ে শশাঙ্ক ব্যানার্জী দিল্লিতে একটি রিপোর্ট পাঠান। তবে তিনি যে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলোচনার বিস্তারিত দিল্লিতে পাঠাবেন এই বিষয়টি জানানোর পর জিয়াউর রহমান বলেছিলেন, ‘আপকে পাস ইতনা খিয়ালি পোলাও হ্যায়?’ আপনার ফরেন সার্ভিসে কাজ না করে গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করা উচিত ছিলো মিস্টার ব্যানার্জী।
শশাঙ্ক ব্যানার্জীর রিপোর্টের ভিত্তিতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানকে সতর্ক করে বার্তা পাঠানোর পর শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, জিয়াউর রহমান ও ফারুক রহমান আমার ছেলের মতো, ছেলেরা কখনও পিতা-মাতাকে হত্যা করে না।
শশাঙ্ক ব্যানার্জী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে ১৫ আগস্টে হত্যার পর জিয়াউর রহমানের নিজেকে জেনারেল পদে উন্নীত করতে বেশি সময় লাগেনি, ১৯৭৬ সালে নভেম্বর মাসেই সামরিক একনায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন। স্যুটকেস ওয়ার গেইম পূর্ণতা পেলোএভাবে।
বাংলা ট্রিবিউন
আগস্ট ১৫ , ২০১৬
লিংকঃ http://www.banglatribune.com/national/news/131423/