মাতৃভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ও অবদান

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি তথা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে জীবনের মায়া ত্যাগ করে সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাংস্কৃতিক বৈষম্য এবং বাঙালির মাতৃভাষা সুরক্ষার আন্দোলনে তিনি কতটুকু ভূমিকা ও অবদান রেখেছিলেন, তা সবার জানা দরকার। জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি কারা ভোগ করেছিলেন। এমনকি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন চলাকালীন কারারুদ্ধ থাকা সত্ত্বেও মাতৃভাষা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় ভূমিকা ও অবদান রেখেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির প্রতি আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের পাশাপাশি ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর প্রথম আঘাত হানা, যা পূর্ববঙ্গের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা শুরুতেই উপলব্ধি করতে শুরু করে। এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল গোঁড়া ধর্মীয় ভিত্তির ওপর। এর পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী তাঁদের নিজেদের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার গভীর চক্রান্তে নেমেছিল, এমনকি উর্দুকে সব বিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করেছিল।

পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর ঢাকায় আয়োজিত এক সম্মেলনে গঠিত হয় গণতান্ত্রিক যুবলীগ। সম্মেলনে ভাষাবিষয়ক কিছু প্রস্তাব সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়, যা পাঠ করেন তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ওই প্রস্তাবে তিনি উল্লেখ করেন, ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের লেখার বাহন এবং আইন-আদালতের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হোক। সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, সে সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব জনগণের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক এবং জনগণের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গৃহীত হোক।’ পাকিস্তান সৃষ্টির পর এভাবেই সর্বপ্রথম মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার দাবি উচ্চারিত হয়েছিল। ভাষাসৈনিক গাজীউল হকের লেখা, ‘ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা’ পুস্তকে এর বর্ণনা পাওয়া যায়।

১৯৪৭ সালের শুরুতে কলকাতার সিরাজউদ্দৌলা হোটেলে এক গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় যুবনেতা শেখ মুজিবসহ কিছু নেতা অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। সাতচল্লিশের ডিসেম্বরে শেখ মুজিবসহ ১৪ জন ভাষাপ্রেমিক বাংলা ভাষা আন্দোলনসহ বিভিন্ন দাবি-সংবলিত ২১ দফা ইশতেহার প্রণয়নে ভূমিকা রাখেন, যা পুস্তক আকারে প্রকাশ হয়ে নামকরণ হয়—‘রাষ্ট্রভাষা ২১ দফা ইশতেহার—ঐতিহাসিক দলিল’। শেখ মুজিব তমদ্দুন মজলিসের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং এর পক্ষে গণস্বাক্ষর গ্রহণ করেন, যা আগামী প্রকাশনী প্রকাশিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. মাযহারুল ইসলামের গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে।

তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র-যুব আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভাষা আন্দোলনে মোগলটুলীর ১৫০ নম্বর বাড়িটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। এখান থেকে মাতৃভাষাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত প্রচার চালানো হতো। শেখ মুজিব, কমরুদ্দিন, জহিরুদ্দিন, নঈমুদ্দিন, শওকত আলী প্রমুখ ছিলেন এর সংগঠক। ১৯৪৮-এর ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের ১০ দফা দাবির মধ্যে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা আদায়ের জোরালো দাবি উত্থাপিত হয়, যার অন্যতম কুশীলব ছিলেন শেখ মুজিব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, তৎকালীন প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় (যা পড়ে বুয়েট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়) এবং ঢাকা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন ও দলে দলে যোগদানের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ১৯৪৮-এর ২৬ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক আবুল কাসেমের সভাপতিত্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক মাযহারুল ইসলাম বাংলা ভাষার পক্ষে অনুষ্ঠিত এই সফল সমাবেশের ব্যবস্থাপনা এবং সফলতার কৃতিত্ব দেন তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিবকে। শেখ মুজিবসহ প্রগতিবাদী ছাত্র ও যুব নেতারা এ সমাবেশে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার এবং সর্বাত্মক সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ১৯৪৮-এর ২ মার্চ ফজলুল হক মুসলিম ছাত্র হলে অনুষ্ঠিত মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিসের যৌথ সভায় নতুন করে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। শেখ মুজিব ছাড়াও এই সভায় উপস্থিত ছিলেন সামছুল হক, আবুল কাশেম, রনেশ দাস গুপ্ত, অজিত গুহ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা।

১৯৪৮-এর ১ মার্চ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রদত্ত বিবৃতিতে ১১ মার্চের হরতাল যেকোনো মূল্যে সফল করার আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান, তমদ্দুন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাসেম, মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদিন আহমেদ ও আবদুর রহমান চৌধুরী। ১১ মার্চ সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই হরতাল প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চিন্তাকে নাড়া দেয়। এই হরতাল চলাকালে শেখ মুজিব পুলিশি হামলায় আহত ও গ্রেপ্তার হন। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা অলি আহাদ তাঁর লিখিত গ্রন্থে উল্লিখিত ঘটনায় শেখ মুজিবের সাহসী ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। সম্ভবত শেখ মুজিবই প্রথম রাজবন্দি, যিনি পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে মাতৃভাষা আন্দোলনের জন্য সর্বপ্রথম গ্রেপ্তার হন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ১৯৪৮-এর ১৫ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের আট দফা চুক্তি অনুসারে শেখ মুজিবসহ অন্য ভাষাসংগ্রামীরা কারামুক্ত হন। ভাষাসংগ্রাম আরো তীব্র করার লক্ষ্যে ১৬ মার্চ (৪৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় শেখ মুজিবের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ ভবন অভিমুখে (পুরনো জগন্নাথ হল ছাত্রাবাস) বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয় ভাষাসহ অন্যান্য দাবি পেশ করার লক্ষ্যে।

পর দিন ১৭ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুসারে ওই দিন দেশব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মূলত ভাষার দাবিতে সফল ধর্মঘট পালিত হয়। দৃঢ় প্রত্যয়ী এবং আন্দোলন প্রশ্নে অবিচল শেখ মুজিব ক্রমেই ছাত্র-যুবসমাজের মধ্যে ব্যাপক পরিচিতি পেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় ১৯৪৯-এ শেখ মুজিব দুবার কারারুদ্ধ হন। ভাষা আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখনো তিনি কারাগারে ছিলেন। কারা অভ্যন্তরে থেকেও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা পাঠাতেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন চলাকালীন বাঙালিদের কাছে অন্যতম জনপ্রিয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলা ভাষার বিপক্ষে বিবৃতি দিলে আন্দোলন কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়। মুক্তিলাভের পর শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দীকে তাঁর মত পরিবর্তন করিয়ে বাংলা ভাষার পক্ষে নতুন করে বিবৃতি প্রদানে বাধ্য করেন, যা শেখ মুজিবের পক্ষেই সম্ভব ছিল বলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অভিমত ব্যক্ত করেন। বায়ান্নর ২৯ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এ বিবৃতি প্রকাশিত হয়। এ বিবৃতি ভাষাসংগ্রামীদের নতুন করে অনুপ্রাণিত করে। ১৯৫৩-এর একুশের প্রথম বার্ষিকী উদ্যাপনে শেখ মুজিব অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। আরমানীটোলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার জোর দাবি জানান।

নবগঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৫ শতাংশের ভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও এর স্থলে সংখ্যালঘু মাত্র ৫ শতাংশের ভাষা উর্দুকে অযৌক্তিক ও অনৈতিকভাবে চাপিয়ে দেওয়ার ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি ক্রমেই ঐক্যবদ্ধ হয়। মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায় বায়ান্নতে রক্ত ঝরে ঢাকার রাজপথে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার মহান আন্দোলনই বাঙালি জাতিকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা তথা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। মাতৃভাষা আন্দোলনের এবং পর্যায়ক্রমে চলমান প্রতিটি আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সুযোগ্য নেতৃত্ব আমরা দেখতে পাই।

লেখক: হাসান-উজ-জামান, মহাসচিব, হিউম্যান রাইটস ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ ও যুগ্ম মহাসচিব, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ
কালেরকণ্ঠ, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

আরও পড়ুন