সাড়ে তিন বছরে একটি জাতিরাষ্ট্র গঠনের কারিগর

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

আমার সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অতি কাছ থেকে জেনেছি। মানুষ মুজিব এবং নেতা মুজিব হিসেবে দেখেছি। আবার তাকে ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবেও পেয়েছি। এই ইতিহাসস্রষ্টা মানুষটির জীবন ও কর্মের প্রকৃত মূল্যায়ন এখনও হয়নি। তার অতি নিন্দা হয়েছে। আবার অতি প্রশস্তি হয়েছে। তার মাঝখানে যে অতি বড়মাপের মানুষটি, তার যথার্থ পরিমাপ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। যেদিন তা সম্ভব হবে সেদিন আত্মবিস্মৃত বাঙালির আত্মসম্বিত ফিরে আসবে। তার আত্মপরিচয়ের জিজ্ঞাসা ও বিভ্রান্তি দূর হবে।

বেশ কয়েক বছর আগে ১৫ আগস্টের এক স্মরণসভায় আমন্ত্রিত হয়ে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেন শহরে গিয়েছিলাম। সেখানে এক ভারতীয় ছাত্র-গবেষকের সঙ্গে দেখা। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোক নন। নিজেকে কেরালার লোক বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। কোপেনহেগেনের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তার গবেষণার বিষয়টিও ছিল অভিনব। ভারতে মোগল শাসনের গোড়ায় কয়েক বছরের জন্য পাঠান শাসনের বৈশিষ্ট্য। যে ক’দিন কোপেনহেগেনে ছিলাম তার সঙ্গে বেশ কয়েক দফা আড্ডা হয়েছে। দেখলাম, তার গবেষণার একটা বড় স্থান দখল করে আছেন পাঠান সম্রাট শের শাহ।

ইতিহাসের এক আশ্চর্য চরিত্র এই শের শাহ। ছিলেন এক সাহসী পাঠান সামন্ত। দিলি্লর দ্বিতীয় মোগল সম্রাট হুমায়ুন যখন তাকে ভাই ডেকেছেন, এমন এক হিন্দু রানীর রাজত্ব রক্ষা করার কাজে সাহায্য জোগাতে সসৈন্যে দিলি্ল ছেড়েছেন, সেই সুযোগে শের খাঁ দিলি্ল দখল করে নিয়ে নিজেকে ভারতের সম্রাট ঘোষণা করেন। সম্রাট শের শাহ নাম গ্রহণ করেন। মোগল সম্রাট হুমায়ুন কয়েক দফা তার সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গিয়ে আর দিলি্লর দিকে এগোননি। শের শাহের মৃত্যুর পর তিনি দিলি্ল দখল করেন।
শের শাহ মাত্র সাড়ে তিন বছর দিলি্লর সিংহাসনে ছিলেন। তারপর এক দুর্গরক্ষার যুদ্ধে জ্বলন্ত গোলার আঘাতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মোগল হুমায়ুন আবার দিলি্ল দখল করে নেন। মাত্র সাড়ে তিন বছর রাজত্ব করলেও শের শাহ সাম্রাজ্য শাসনে এক বিস্ময়কর উদাহরণ রেখে গেছেন। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেন, পাঠান শের শাহ মাত্র সাড়ে তিন বছর নানারকম যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যেও জনহিতৈষণা ও জনকল্যাণের যে উদাহরণ রেখে গেছেন, তার তুলনা মোগল কোনো সম্রাটের দীর্ঘ শাসনামলেও পাওয়া যায় না। তারা শিল্পচর্চা, স্থাপত্য ও ভাস্কর্যে সারা ভারতে অনেক অবদান রেখে গেছেন; কিন্তু জনকল্যাণের কাজে শের শাহের ভূমিকা অতুলনীয়।
তিনি প্রথম ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত উঁচু এবং প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করেন, যা ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করে। এই বাদশাহি সড়ক পরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড নামে পরিচিত হয়। শের শাহ সর্বপ্রথম ভারতে ঘোড়ায় টানা ডাক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। সরাইখানা স্থাপন করেন এবং সাধারণের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেন। তিনি দরবারে উচ্চপদে অমুসলিম অফিসার নিয়োগের ব্যবস্থা করেন এবং মসজিদের পাশাপাশি মন্দির সংস্কারের জন্য অর্থ মঞ্জুর করেছিলেন।

কোপেনহেগেনের ভারতীয় ছাত্র-গবেষক আমাকে সম্রাট শের শাহের জীবনের বৈশিষ্ট্যগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন_ নেহরুর মতে, আধুনিক ভারতের স্থপতি ছিলেন সম্রাট আকবর। আমার মতে, এই স্থপতি ছিলেন শের শাহ। মাত্র সাড়ে তিন বছর দিলি্লতে ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে সামাজিক উন্নয়নের যে ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন, পরবর্তীকালে মোগল সম্রাট আকবর সেই উন্নয়নের সাহায্য নিয়েই একটি ঐক্যবদ্ধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় সমর্থ হয়েছিলেন।
এই গবেষক ভারতীয় ছাত্রটির নাম আমার মনে নেই। দীর্ঘকাল আগের কথা। এবার কোপেনহেগেনে গিয়ে তার খোঁজ করেছিলাম। পাইনি। হয়তো বহু আগে স্বদেশে চলে গেছেন। তার একটি কথা আমার মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, শের শাহের জীবন ও সাম্রাজ্য পরিচালনা পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি একটি বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, মধ্যযুগের এই পাঠান সম্রাটের জীবন ও জনহিতৈষণার সঙ্গে এ যুগের এক বাঙালি জননায়কের আশ্চর্য মিল রয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নব্য বাংলার স্থপতি।
শের শাহের মতো বঙ্গবন্ধুও মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন। শের শাহ তার শত্রুর হাতে প্রাণ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুও স্বাধীনতার শত্রুদের হাতে শাহাদাতবরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে শের শাহের মতো বাঙালির স্বাধীন নেশন স্টেটের যে শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দিয়ে গেছেন, সেই ভিত্তির ওপরই গত চার দশকের বেশি সময় ধরে দেশটি নানা ঝড়ঝঞ্ঝার মুখে টিকে আছে এবং নানা সামাজিক অবক্ষয়ের মধ্যেও তার অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা বাড়ছে।
ওই ভারতীয় ছাত্র-গবেষকের মতে, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন এবং সেই রাষ্ট্রের শক্ত ভিত্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর একটি অসাধারণ সাফল্য। এই সাড়ে তিন বছরে তিনি বাঙালির প্রথম স্বাধীন নেশন স্টেটকে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপহার দেন। পাকিস্তানি হানাদারদের দ্বারা বিধ্বস্ত দেশটির সামাজিক ও আর্থিক অবস্থা পুনর্গঠন করেন। হানাদারদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত নদীপথের বিরাট ব্রিজগুলো দ্রুত মেরামত করে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করেন। যুদ্ধ-পরবর্তী সামাজিক অরাজকতা ও সন্ত্রাস দমন করেন, যা নয়াচীনে কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় বসার পর একনায়ত্ববাদী শাসনে দীর্ঘদিনেও সম্ভব হয়নি। চীনের মতো লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতিও তিনি ঘটতে দেননি।
শেখ মুজিব ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র চীন ও সৌদি আরব ছাড়া বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায় করেন বাংলাদেশের জন্য। তার চাপেই ভারত মাত্র তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে তার সব সৈন্য সরিয়ে নেয়। পাকিস্তানের ক্রমাগত বিরোধিতার মুখেও বাংলাদেশ জাতিসংঘ ও কমনওয়েলথের সদস্য হয়। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে শীর্ষ নেতৃত্ব গ্রহণ করে। বাংলাদেশের মানুষকে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে না খাইয়ে মারার সর্বশেষ চাল চেলেছিল পাকিস্তানি শাসকরা। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ়তার মুখে তা ব্যর্থ হয়।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হওয়ার প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদাররা চট্টগ্রাম পোর্টের সমুদ্রসীমায় ব্যাপকভাবে শক্তিশালী মাইন স্থাপন করে যায়। উদ্দেশ্য ছিল, বিদেশ থেকে খাদ্য সাহায্য নিয়ে কোনো জাহাজ যাতে চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে না পারে। ফলে খাদ্যাভাবে দেশটিতে যাতে অনাহারে মৃত্যু শুরু হয়। প্রথমে ভারতীয় মাইনবিধ্বংসী জাহাজ এসে মাইনগুলো ধ্বংস করার চেষ্টা করে; কিন্তু তাদের জাহাজই ধ্বংস হয়ে যায়।
এই মাইন অপসারণ ও ধ্বংস করার উন্নত ব্যবস্থা ছিল আমেরিকার হাতে। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্নকারী নানা শর্ত দিতে থাকে। তার মধ্যে একটি ছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধের মিত্র ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্রতার বলয় থেকে বাংলাদেশের বেরিয়ে আসা। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়তার সঙ্গে এই শর্ত মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং মস্কো চট্টগ্রাম থেকে এই মাইন অপসারণে সাহায্য জোগাতে সম্মতি জানায়। এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশিংটনের চাণক্য বুদ্ধির টনক নড়ে এবং তারা চট্টগ্রাম বন্দরকে মাইনমুক্ত করার জন্য নিঃশর্তভাবে এগিয়ে আসে।

কোপেনহেগেনের গবেষক বন্ধুটির বক্তব্য ছিল, নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখনও এগিয়ে চলেছে। এটা সম্ভব হতো না, যদি মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শক্ত হাতে একটি নতুন রাষ্ট্রের অসাম্প্রদায়িক ভিত্তি তৈরি করে না দিয়ে যেতেন। আমি এখনও তার সঙ্গে সহমত পোষণ করি। বর্তমানে গ্গ্নোবাল ফান্ডামেন্টালিজমের যে দানবীয় উত্থান সারা মধ্যপ্রাচ্যকে কিলিং ফিল্ডে পরিণত করেছে, যার থাবা থেকে পাকিস্তানও মুক্ত থাকতে পারেনি, বাংলাদেশ যে সেই হিংস্র থাবাকে অনেকটাই প্রতিহত করতে পেরেছে, তার মূল কারণ বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-সাধনা এবং তার ভিত্তিতে রাষ্ট্রের ভিত্তি শক্ত করার জন্য তার আত্মদান।

বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা করার ফলে বঙ্গবন্ধুকে অনেক সময় বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো মুসলিম দেশের নেতাদের কাছ থেকে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি তার যথাযোগ্য জবাব দিয়েছেন। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে সৌদি আরবের তৎকালীন বাদশাহ ফয়সল বঙ্গবন্ধুকে এক একান্ত আলাপে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি কি নিজেকে মুসলমান মনে করেন, না কেবল বাঙালি? বঙ্গবন্ধু জবাব দিয়েছিলেন, আমি বাঙালি মুসলমান। কেবল মুসলমান তো কোনো জাতি পরিচয় নয়। যদি পরিচয় হতো তাহলে সৌদি আরবের মানুষ তো নিজেদের পরিচয় দিত কেবল মুসলমান। নিজেদের সৌদি বলে পরিচয় দিত না।

বাদশাহ ফয়সল বঙ্গবন্ধুকে আরও বলতে চেয়েছিলেন, পাকিস্তানের মতো একটি মুসলমান রাষ্ট্র ভেঙে ফেলা উচিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু তাকে সবিনয়ে উত্তর দিয়েছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে একই ধর্ম, একই ভাষা এবং একই কালচার অনেকগুলো মুসলিম দেশের। তারা কেন আলাদা আলাদা রাষ্ট্র হয়ে আছে? এমনকি পরস্পরে যুদ্ধবিগ্রহ করছে? বাদশাহ ফয়সল এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। এই বাদশাহ ফয়সলও মার্কিন সিআইএর চক্রান্তে ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে আপন ভাইপোর অস্ত্রাঘাতে নিহত হন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, পরবর্তী বছরের মধ্যে তিনি আল আকসা মসজিদকে ইসরায়েলের দখলমুক্ত করবেন এবং সেখানে গিয়ে জুমার নামাজ পড়বেন। সিআইএ তার এই হুমকি বরদাশত করেনি।
বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে আমার একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার সবসময় মনে হয়েছে, ব্যক্তিগত বিশ্বাসে তিনি ছিলেন একজন ধর্মানুরাগী; কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ। আমি তার সঙ্গে ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় গিয়েছিলাম। এক শুক্রবারে জুমার নামাজে মাত্র তিনজন রাষ্ট্রনায়ক আলজিয়ার্সের বড় মসজিদে একসঙ্গে নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। একজন সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সল, অন্য দু’জন মিসরের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদাত এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কী বিস্ময়কর ললাটলিখন! এই তিনজন রাষ্ট্রনায়কই ঘাতকের হাতে মৃত্যুবরণ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু যখন ইরাক সফরে যান তখন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম তাকে সোনালি কালিতে ছাপা একখণ্ড কোরআন উপহার দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রায়ই দেখেছি, তার ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে সকালে ফজরের নামাজ শেষে ওই কোরআন পাঠ করতে এবং যে পর্যন্ত পড়েছেন সেখানে একটি কাগজের টুকরো দিয়ে চিহ্ন রাখতে। ধর্মে তার অটুট বিশ্বাস ছিল বলেই হয়তো বলতে পেরেছেন, ‘আমি প্রথমে বাঙালি, তারপর মুসলমান। একটি আমার পরিচয়, অন্যটি আমার বিশ্বাস।’

আরও পড়ুন