স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী বাংলার জনগণ পাকিস্তানি সামরিক শাসকের রক্তচক্ষুকে পরোয়া করছিল না। কারণ, তখন সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার নির্দেশেই চলছিল সবকিছু। উত্তাল মার্চের ঘটনাপ্রবাহে ভুট্টো বুঝতে পারছিলেন—পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এদিন মিছিল-সমাবেশে মুখর ছিল ঢাকাসহ সারা দেশ। স্বাধীন বাংলার দাবিতে অবিচল সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে সব ধরনের অসহযোগিতা অব্যাহত রাখেন। বঙ্গবন্ধুর ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে শরিক হয়ে এদিন হাইকোর্টের বিচারপতি ও প্রশাসনের সচিবসহ দেশব্যাপী সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বস্তরের কর্মচারীরা অফিস বর্জন করেন। এমন পরিস্থিতিতে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে একটি তারবার্তা পাঠিয়ে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সমঝোতার আহ্বান জানান।
তারবার্তায় ভুট্টো বলেন, ‘উদ্ভূত সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। আমরা আজ বিরাট সংকটের মুখোমুখি। দেশের ভবিষ্যৎ আজ অনিশ্চিত। এ ব্যাপারে আমাদের উভয়ের অনেক দায়িত্ব রয়েছে। ধ্বংস এড়ানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই আমাদের করতে হবে। যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে দেশকে রক্ষা করতেই হবে।’ তবে বাঙালির অধিকার আদায় না করে পাকিস্তানকে ‘এক রাখা’ যে সম্ভব নয়, সে কথা এদিন আবারও মনে করিয়ে দেন গণঐক্য আন্দোলনের নেতা এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান। করাচিতে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানই কার্যত এখন বাংলার সরকার। সেখানে সব সরকারি কর্মচারী ও সচিব তার নির্দেশ পালন করছেন। ঢাকায় শুধু সামরিক সদর দপ্তরে পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা ছাড়া না হলে দেশের দুই অংশকে এক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না।’ ন্যাপপ্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী হাই স্কুল মাঠে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বাঙালির স্বার্থের প্রশ্নে আপস করার দিন চলে গেছে। এই মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ থাকা উচিত নয়। জনগণ এখন নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।’আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, গণঅসহযোগ আন্দোলন এক নজিরবিহীন তুঙ্গে পৌঁছেছে। জনগণের সংগ্রাম সফল করার উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক কাজে নিয়োজিত সবাইকে কঠোর নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলবে হবে। ন্যাপ (ওয়ালী) পূর্ববাংলা শাখার সভাপতি মোজাফফর আহমদ, পাঞ্জাব আওয়ামী লীগ সভাপতি এম খুরশীদ, মুসলিম লীগপ্রধান মমতাজ দৌলতানার বিশেষ দূত পীর সাইফুদ্দিন এদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার ধানমন্ডির বাসভবনে পৃথক আলোচনায় মিলিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির এক সভায় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানানো হয়। গণআন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদের এক দিনের বেতন আওয়ামী লীগের ত্রাণ তহবিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। গণহত্যার প্রতিবাদে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর পাকিস্তান সরকারের এক চিত্রপ্রদর্শনীতে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। কুমিল্লা কারাগার থেকে পালাতে গিয়ে এদিন পুলিশের গুলিতে পাঁচ কয়েদি নিহত হয়। বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগার ভেঙে ২৪ কয়েদি পালিয়ে যায়, গুলিতে নিহত হন দুজন।