বঙ্গবন্ধুর শাসনামল : একটি নির্মোহ জাতীয় দলিল

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

পাঠক সমাবেশ-এর কর্ণধার সহিদুল ইসলাম বিজু সম্প্রতি আমার হাতে প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার একটি বই তুলে দিয়ে পড়ার অনুরোধ করেন। বইটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার—দেশ নির্মাণের মৌলিক রূপরেখা’। রচয়িতা মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। লেখককে ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও অন্যতম শীর্ষ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর নাম জানি। বইটি পড়ে রচয়িতার প্রতি সাধুবাদ জানাতে হয়। কারণ অনেক শ্রম ও অধ্যবসায় দিয়ে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকাজ সম্পাদন করেছেন। বইটিতে এমন সব দলিলপত্র, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নাল এবং বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখা ও তথ্য সূত্র সন্নিবেশিত হয়েছে, যা নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বড় রত্নসম্ভার; বিশেষ করে যারা স্বাধীনতা-উত্তর কালে বঙ্গবন্ধুর সরকারের ইতিবৃত্ত জানতে আগ্রহী।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ থেকে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। সময়টা নবীন বাংলাদেশের এমন এক সময়, যা আমাদের মতো যুদ্ধফেরত নবীন সংবাদকর্মীদের একদিকে আবেগে উচ্ছ্বসিত করেছে, আবার ভয়ংকর সব ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী হয়ে চরম হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। সে কারণে আগ্রহ সহকারে তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার বইটি পড়েছি। আমাদের প্রজন্মের স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছি গ্রন্থটিতে তুলে ধরা প্রতিটি অধ্যায়, দলিল ও দস্তাবেজ।

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক, শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তিনি প্রথম রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এবং স্বাধীনতা-উত্তর কালের সরকারপ্রধান। এমন এক সময় তিনি রাষ্ট্রের হাল ধরেন, যখন গোটা দেশ যুদ্ধবিধ্বস্ত, অর্থনীতি নাজুক, রাষ্ট্রীয় তহবিল শূন্য এবং যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। আরো গুরুত্বপূর্ণ যে স্বাধীনতার দেশি-বিদেশি প্রতিপক্ষরা ওই সময় এমন সব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল, যাতে স্বাধীনতা লাভ করা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেন মুখ থুবড়ে পড়ে। কিন্তু জাতির জনক ছিলেন অমিত বিক্রম, যিনি অনেক ঝড়ের মধ্যেও ভয়ংকর সব প্রতিবন্ধকতা পেরিয়েছেন দুঃসাহসী কাণ্ডারির মতো। ভাবতে বিস্মিত হতে হয়, তাঁরই সরকারের আমলে রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি মৌলিক ভিত ও আর্থ-সামাজিক রূপরেখার পত্তন ঘটে। সময়ের বিবেচনায় যা ছিল এক বিস্ময়কর সাফল্য।

মুক্তিযুদ্ধের মাঠ থেকে সবে ফিরতে শুরু করেছে মুক্তিবাহিনী, সহযোদ্ধাদের প্রায় সবার হাতে একটি করে রাইফেল, কারো হাতে স্টেনগান; প্রিয় সেই হাতিয়ার—যা আমাদের অকৃত্রিম বন্ধু হয়ে উঠেছিল মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে। সদ্যঃস্বাধীন দেশ, চারদিকে অসীম উন্মাদনা। মাত্র তিন সপ্তাহ আগে ঢাকার বুকে পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো দেশে ফিরে আসেননি। এত আনন্দ-উল্লাসের মধ্যেও তাই বিশাল এক শূন্যতা; বাঙালির স্বাধীনতা এলো কিন্তু স্বাধীনতার রূপকার, রাষ্ট্রের জনক নেই!

এদিকে পাকিস্তানের ঐতিহাসিক পরাজয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হলো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে। নতুন প্রেসিডেন্ট হলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ২১ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো ভুট্টো ঘোষণা দিলেন, শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু কবে, কখন—কিছুই জানানো হলো না।

মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের পাশাপাশি যুদ্ধ সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত থেকেছি। অতএব বঙ্গবন্ধু এভিনিউর বিপিআই, অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রেস ইন্টরন্যাশনাল নামের ছোট্ট সংবাদ সংস্থাটায় যোগ দিলাম। অফিসটি ছিল ব্যক্তিমালিকানার একটি ক্ষুদ্রায়তন পাকিস্তানি সংবাদ সংস্থা, ঢাকায় ব্যুরো অফিস। যেদিন কাজে যোগ দিলাম সেদিন ৮ জানুয়ারি ১৯৭২। ঘটনাক্রমে সেদিনই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু।

কাকতালীয়ভাবে আমার পূর্ণ পেশাগত জীবনের প্রথম ‘রিপোর্টিং অ্যাসাইনমেন্ট’ও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর সংগ্রহের কাজ দিয়ে। নিজের বাঁধভাঙা আবেগ, অতএব পৌঁছে গেলাম তেজগাঁও এয়ারপোর্টে লাখো মানুষের ভিড় ঠেলে। দেখলাম ইত্তেফাক, সংবাদ, আজাদ, অবজারভার, দৈনিক বাংলা, পূর্বদেশসহ প্রতিটি পত্রিকা থেকে সিনিয়র সংবাদকর্মীরা উপস্থিত। উপস্থিত মুজিবনগর মন্ত্রিসভার সব সদস্য, ছাত্র নেতৃবৃন্দ, মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সদস্যসহ বিদেশি কূটনীতিকরা।

কার্যত সেদিন থেকেই শুরু জাতির পিতার সাড়ে তিন বছরের শাসনকাল। প্রথম দিনই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রদর্শনের ব্যাখ্যা দিলেন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্সে সুস্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। ইন্দোনেশিয়ার পরই এর স্থান। মুসলিম জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের স্থান তৃতীয় ও পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে, আমাদের নারীদের বেইজ্জত করেছে। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে দিতে চাই যে আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’

বাংলাদেশ গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে ১৯৭২ সালের ৭ এপ্রিল। সেখানকার এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সবিস্তারে পাকিস্তানিদের হাতে ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ তুলে ধরলেন। দেশে ২৭৮ রেল ব্রিজ, ২৭০ সড়ক ব্রিজ ধ্বংস; খাদ্যের গুদামগুলো ধ্বংস, সমুদ্রবন্দরগুলোতে মাইন বসিয়ে রাখা, জাহাজ ডোবানো, ফ্যাক্টরি-কারখানা বন্ধ। অর্থাৎ বাঙালির ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম এই রাজনীতি-পুরুষকে সামলাতে হয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি ও অবকাঠামো, একই সঙ্গে পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া ছিটমহল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেদিনকার আমেরিকান পরাশক্তি ও কমিউনিস্ট চীনের অবস্থান। কারণ তারা পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে সব কৌশল রপ্ত করেও।

অতএব প্রবল বিরূপ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় বঙ্গবন্ধুর সরকারকে। এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, চাই যুদ্ধে বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন, চাই ভেঙে পড়া আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি, চাই পাকিস্তানের মাটিতে আটকে পড়া সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যসহ কয়েক লাখ বাঙালির আশু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। আর এসব জরুরি কাজ যখন একের পর এক করে যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধু, ঠিক তখনই সংক্ষিপ্ত করা হলো তাঁর জীবন।

যেকোনো সৎ পর্যবেক্ষকই স্বীকার করবেন, পঁচাত্তরের রক্তাক্ত পালাবদল বাংলাদেশের প্রথম সরকারের সংকট বা সীমাবদ্ধতার কারণে ঘটেনি। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির জনককে হত্যা করে ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলাদেশের জন্মকে নতুন করে চ্যালেঞ্জ করেছিল। নতুন বাংলাদেশের স্থিতিশীলতাই ওরা শুধু গুঁড়িয়ে দিতে চায়নি, একই সঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে চেয়েছিল বাঙালির ইতিহাসের গৌরবগাথা।

তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার বইটিতে এমন কিছু মূল্যবান দলিল-দস্তাবেজ যুক্ত হয়েছে, যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও তাঁর শাসনকালের, প্রায় প্রতিটি নীতিনির্ধারণী কর্মকে দালিলিকভাবে জানার সুযোগ সৃষ্টি করে। ১২ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু তাঁর মন্ত্রিসভা গঠন করেন। প্রথম বৈঠক বসে ১৩ জানুয়ারি। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার প্রথম সিদ্ধান্তগুলো ছিল তাৎপর্যময়। সিদ্ধান্তে ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত বকেয়া ও সুদসহ সব কৃষিজমির সব ধরনের খাজনা মওকুফ করা হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা…’কে জাতীয় সংগীত ও কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল…’কে রণসংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। শাপলাকে জাতীয় ফুল, দোয়েলকে জাতীয় পাখি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন জাতীয় পতাকার কিছুটা পরিবর্তন করে দেশের পতাকার নকশা গৃহীত হয়। ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বরকে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় ইত্যাদি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িক আবর্ত থেকে উদ্ধার করে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ ধারায় প্রবাহিত করেছিলেন; প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতিসত্তাকে রাষ্ট্র পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেই নিরিখেই তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে চলেছিলেন।

আরো একটি বিষয় লক্ষ করার মতো। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিপদের স্বরূপ বুঝতে হলে বাংলাদেশবিরোধী আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতার বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এই মহল পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধাচরণ করেছিল, এমনকি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে নীরব ভূমিকা পালন করেছিল। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনকের হত্যাকারীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছিল; যে সামরিক ও আধাসামরিক শাসকরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছিল, এই আন্তর্জাতিক মহল তাদেরও সমর্থন দিয়েছিল! মোটকথা, ১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানের আগের জায়গায় ফিরিয়ে দিতে সচেষ্ট হয়েছিল তারা। অতএব একের পর এক আঘাত চলেছিল রাষ্ট্রের মূল ভিত্তির ওপর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর।

অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ওপর সামরিক ও আধাসামরিক শাসকদের এই আঘাত চলতে থাকে প্রায় দুই যুগ। ভুললে চলবে না, ধারাবাহিক এই আগ্রাসনে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অনেকটাই পথভ্রষ্ট হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের গৌরব পর্যন্ত খণ্ডিত হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী এবং তাদের দোসররা বাঙালি জাতিসত্তার চৈতন্যের ব্যাপ্তি ও শক্তি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। কাজেই তাদের সাফল্য স্থায়ী হয়নি। ইতিহাসের নিজস্ব শক্তি আছে তার সত্যকে রক্ষা করার, অতএব সে তার আপন শক্তিতেই বিকশিত হয়েছে; বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ আবারও স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

স্বাধীনতা-উত্তর কালে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫-এর মধ্য আগস্ট পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর অনেক যুগান্তকারী ভাষণ ও কিছু কিছু অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সুযোগ ঘটে আমার। পরবর্তী সময়ে সেসব ভাষণ যখন পড়ি, বোঝার চেষ্টা করি, তখন অনুভব করি কতটা অন্তর দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি তাঁর দেশকে ভালোবেসেছিলেন। কতটা আবেগ ও উপলব্ধি দিয়ে তিনি তাঁর দেশকে সাম্যের রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধীরা, বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার বিরোধীরা বসে ছিল না। সদ্যঃস্বাধীন দেশের সরকার এবং নতুন রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করে দিতে সব ধরনের অস্ত্রের ব্যবহার করে চলছিল তারা। এই প্রচারণা শুধু লুকিয়ে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষ থেকেই আসেনি, এসেছে ‘অতিবিপ্লবী’ কিছু মহল থেকেও, যারা সময় বুঝে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চেয়েছে।

সদ্যঃস্বাধীন দেশের সরকারকে আঘাত করতে যে অস্ত্রটির ব্যবহার করা হয়েছিল, তা ভারত প্রসঙ্গ। বলা হচ্ছিল মিত্র বাহিনী, যারা মুক্তিবাহিনীর হাতে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, অনেকে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে, তারা বাংলাদেশের মাটি থেকে আর কখনোই ফিরে যাবে না। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য এই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রের হাল ধরেছিলেন বলেই এসব প্রচারণা বাস্তবে পরিণত হয়নি। মাত্র দুই মাসের মাথায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্য বাংলাদেশের মাটি থেকে নিজেদের দেশে ফিরে গেছেন।

আজ যখন ফেলে আসা সময়ের দিকে তাকাই তখন শুধুই মনে হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু পাকিস্তানি শৃঙ্খল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্তি দিতে একটি নতুন রাষ্ট্রেরই জন্ম দিতে চাননি, সেই রাষ্ট্রকে একটি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে, একটি শোষণমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের পূরণ দেখে যেতে পারেননি তিনি। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন এক রাষ্ট্রের, যা গতানুগতিক বা তাঁর ভাষায় ‘শোষকের গণতন্ত্র নয়’, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন পরিপূর্ণ জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের এবং সব অর্থে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের। কিন্তু সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসন, এমনকি তাঁর দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ষড়যন্ত্রকারীরা তখন চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছিল। এরই ফলে ঘটে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড, যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনককে যেমন হত্যা করা হয়, একই সঙ্গে রুদ্ধ করা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের স্বাভাবিক যাত্রাপথ।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন মনেপ্রাণে জাতীয়তাবাদী এবং খাঁটি মুসলমান, একই সঙ্গে ছিলেন পরিপূর্ণভাবে অসাম্প্রদায়িক। মনে পড়ে, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে তিনি যে বেতার ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামে বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য—লেবেলসর্বস্ব ইসলামে আমরা বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রসুলে করিম (দ.)-এর ইসলাম, যে ইসলাম জগতবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বরাবর যাঁরা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ-বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন, আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফিকদেরই বিরুদ্ধে।’

ইত্যাদি কারণে জাতীয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বা তাদের সমর্থক-অনুসারীদের আলাদা করে দেখার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। যে নামেই আবির্ভূত হোক না কেন, এরা যেকোনো উপায়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে উত্খাত বা আঘাত করতে বদ্ধপরিকর। সে কারণেই প্রয়োজন সংগত উপলব্ধির, প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় শক্তির সম্মিলন, একাত্তরের চেতনার লড়াই। এ লড়াই বাংলাদেশকে বাংলাদেশ রাখার, এ লড়াই বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের একার নয়, এ লড়াই বাংলাদেশের স্বাধীনতাপন্থী সবার।

লেখক : হারুন হাবীব
মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও গবেষক
কালের কণ্ঠ ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও পড়ুন