কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন
জিয়া এবং মোশতাক উভয়েই যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল কুশীলব ছিল সে যুক্তির পক্ষে যেসব প্রমাণ রয়েছে তার অন্যতম প্রমাণ এই অধ্যাদেশ বা আইন। জিয়া-মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যার অংশীদার না হলে কেন তারা বন্দুকধারী খুনিদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, তাদের পুরস্কৃত করেছিল, কেনইবা তাদের উঁচু কূটনৈতিক পদে চাকরি দিয়েছিল? এ প্রশ্নের জবাব নিশ্চয় খুনি জিয়া এবং খুনি মোশতাকের পক্ষে যারা কথা বলার চেষ্টা করে, তাদের কাছে নেই।

বিশ্বের ঘৃণ্যতম কালো কানুনগুলোর অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশের খুনি মোশতাক ও জিয়া প্রণীত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা আইন। আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সভ্য সমাজের অভ্যুদয়ের পর কোনো দেশে এ ধরনের কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি। আর রাষ্ট্রপ্রধান হত্যার ব্যাপারেতো নয়ই।

পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করা হয়েছে। যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের অনেকেই ছিলেন মানবিক গুণাগুণের অধিকারী আর তাই মানবতাবিরোধীরাই তাদের হত্যা করেছে।

খ্রিস্ট জন্মের আগে জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করেছিল তারই অতি আপনজন ব্রুটাস। রোমান কর্তৃপক্ষের প্রিয়জন হওয়া সত্ত্বেও তার বিচারের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ব্রুটাস পালিয়ে যাওয়ায় এবং পরে আত্মহত্যা করায় তার বিচার করা যায়নি। গত দুই শতকে যেসব রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করা হয়েছে তার মধ্যে ছিলেন মার্কিন মানবতাবাদী প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন যিনি কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসদের মুক্ত করার জন্য গৃহযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, আর সে কারণেই তাকে হত্যা করেছিল জন উইলকিস বুথ নামের এক অভিনেতা। ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল তার সঙ্গে ষড়যন্ত্রে ছিল ৮ জন।

হত্যার পর পরই বুথ পালিয়ে যেতে সক্ষম হওয়ায় তাকে খোঁজার জন্য শুরু হয় দেশব্যাপী অভিযান, ঘোষণা করা হয় তাকে খুঁজে পেতে ১ লাখ ডলার পুরস্কার। তাকে খুঁজে পেলেও সে আত্মহত্যা করার কারণে তারও বিচার সম্ভব হয়নি, তবে তার সঙ্গে যে ৮ জন ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল তাদের বিচার হয় এবং এক মহিলাসহ ৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয় লিংকন হত্যা বিচারের জন্য গঠিত মিলিটারি কমিশন।

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি ভারতের অহিংসবাদের নায়ক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করে হিংসার চরম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিল নাথুরাম গডসে নামের এক হিংসাবাদী। গান্ধীজি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর বলেছিলেন তার হত্যাকারীকে ক্ষমা করতে। কিন্তু আইনের কঠোর হাত নাথুকে ক্ষমা করেনি, দিয়েছিল মৃত্যুদণ্ড।

পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জন কেনেডি হত্যারও বিচার হয়েছিল, বিচার হয়েছিল ইন্দিরা, রাজিব হত্যার। তাদের সবার হত্যার পরও সাংবিধানিক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়নি, সাংবিধানিক নিয়মেই তাদের উত্তরসূরিদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম হয়েছে বাংলাদেশে যেখানে সব খুনি এবং ষড়যন্ত্রকারীদের আইনের হাত থেকে রক্ষা করার অপপ্রয়াস হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম কুশীলব খুনি মোশতাক প্রথমে ১৯৭৫-এর ২৬ সেপ্টেম্বর খুনিদের রক্ষা করার জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বাংলাদেশকে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে এ ধরনের কালো আইনপ্রণেতা দেশের তালিকাভুক্ত করে।

মোশতাক বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি, পারেনি তার উত্তরসূরি বিচারপতি সায়েমও। বঙ্গবন্ধু হত্যার আসল খলনায়ক খুনি জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে, যে কিনা ঘটনার আগে ছিল ক্ষমতার আড়ালে। জিয়া ক্ষমতায় যেয়েও অধ্যাদেশটি বাতিল করেনি বরং এক কদম এগিয়ে সব বন্দুকধারী খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে পদোন্নতিসহ লোভনীয় কূটনৈতিক পদে পদায়ন করে। জিয়ার কাজ সেখানেই শেষ হয়নি, সে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনি মর্যাদা দিয়ে পঞ্চম সংশোধনী আইন প্রণয়ন করে।

তথাকথিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ যে শুধু বন্দুকধারী খুনিদের জন্য রক্ষাকবচ তৈরি করা হয়েছিল, তা নয় এতে সুরক্ষা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িত সব ষড়যন্ত্রকারীদেরও। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যারাই বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে বা কোনো ট্রাইব্যুনালে দেওয়ানি বা ফৌজদারি কোনো ধরনের মামলা হবে না, কোনো ধরনের শৃঙ্খলাভঙ্গমূলক মামলা কোনো আদালত বা কর্তৃপক্ষের কাছে করা যাবে না, কোনো সামরিক আদালতে বা কোর্ট মার্শালে বিচার হবে না, কোনো বিভাগীয় বিচার হবে না, কোনো দেওয়ানি মামলাও হবে না।

অধ্যাদেশে বলা হয়েছিল সেই দিনের ঘটনাবলির জন্য যারা পরিকল্পনা করেছিল, ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, প্রস্তুতিপর্বে অংশীদার ছিল অথবা কার্যকর করিয়েছিল তাদের সবার জন্যই এই অধ্যাদেশ প্রযোজ্য হবে। অধ্যাদেশের দ্বিতীয় পর্বে খুনিদের নাম উল্লেখ করা হয়। অধ্যাদেশের ভাষা থেকে এটি পরিষ্কার যে, শুধু বন্দুকধারী খুনিরাই নয়, এই অধ্যাদেশ দ্বারা রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে সব ষড়যন্ত্রকারী, নীলনকশাকারী, পরিকল্পনাকারী এবং সেগুলো বাস্তবায়নে যাদের ভূমিকা ছিল। এ ধরনের আইন করে বাংলাদেশকে প্রবেশ করানো হয়েছিল বিচারহীনতার সংস্কৃতির ধারক দেশে আর এ কারণে খুনি এবং ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার ২১ বছর বিলম্বিত হয়।

জিয়া এবং মোশতাক উভয়েই যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল কুশীলব ছিল সে যুক্তির পক্ষে যেসব প্রমাণ রয়েছে তার অন্যতম প্রমাণ এই অধ্যাদেশ বা আইন। জিয়া-মোশতাক বঙ্গবন্ধু হত্যার অংশীদার না হলে কেন তারা বন্দুকধারী খুনিদের বিচারের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল, তাদের পুরস্কৃত করেছিল, কেনইবা তাদের উঁচু কূটনৈতিক পদে চাকরি দিয়েছিল? এ প্রশ্নের জবাব নিশ্চয় খুনি জিয়া এবং খুনি মোশতাকের পক্ষে যারা কথা বলার চেষ্টা করে, তাদের কাছে নেই। জিয়া তথাকথিত রাষ্ট্রপতি পদটি জবরদখল করার পর ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি আরও পাকাপোক্ত করার জন্য সেটিকে আইনে রূপান্তরিত করেছিল। জিয়া তার পঞ্চম সংশোধনী আইনের মাধ্যমে (যে আইনকে পরবর্তীকালে সুপ্রিমকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন) এই কালো আইনকে সংবিধানের অংশে পরিণত করার অপচেষ্টা করেছিল, যা ধোপে টেকেনি।

পরবর্তীতেকালে আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর দেশকে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নিয়েছিল তার অন্যতমটি ছিল ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধু এবং জেল হত্যার বিচারের পথ খুলে দেয়া, সেই উদ্দেশ্যেই আওয়ামী লীগ সরকারের সে সময়ের আইনমন্ত্রী, প্রয়াত অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু সংসদে ইনডেমনিটি আইন বাতিলের জন্য বিল উত্থাপন করলে তা ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়, বাতিল হয়ে যায় কলঙ্কিত ইনডেমনিটি আইন। আইনটি বাতিলের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দুজন খুনি হাইকোর্টে রিট করলে মহামান্য হাইকোর্ট ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন এই মর্মে রায় দেন যে, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা আইন কখনও বৈধ ছিল না, যার অর্থ এই যে, এগুলো শুরু থেকেই অচল, অপ্রয়োগযোগ্য ছিল।

উল্লেখযোগ্য যে আইনটি বাতিল করে সংসদে আইন পাস হওয়ার কয়েকদিন আগেই লালবাগ থানায় বঙ্গবন্ধু হত্যার এজাহার দায়ের করা হয়েছিল। এটিও উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের দিনই ধানমন্ডি থানায় এজাহার দায়ের করার চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু থানা পুলিশ এই বলে মামলা ফিরিয়ে দিয়েছিল যে “আপনারাও বাঁচেন, আমাদেরও বাঁচতে দেন। এই মামলা করলে আমাদের সকলের কল্লা যাবে।”

অধ্যাদেশ বা আইনটি রহিত করার পরে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং জেল হত্যামামলা চালানো সম্ভব হয়, দেশ বেঁচে যায় বিচারহীনতার কলঙ্কময় অধ্যায় থেকে। এরপর বন্দুকধারী খুনিদের বিচার হয়েছিল বটে কিন্তু পেছনের খলনায়কদের অর্থাৎ যারা পরিকল্পনায়, নীলনকশা প্রণয়ন, ষড়যন্ত্র এবং ষড়যন্ত্র কার্যকর করার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিল তাদের মৃত্যুজনিত কারণে বিচার হলো না। আরও কয়েকজন রয়ে গেছে আইনের আওতার বাইরে এবং তাই আজকের গণদাবি এসব কুশীলবদেরও মুখোশ উন্মোচন করার জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী কমিশন।

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।

আরও পড়ুন