পৃথিবীতে যত পরিবর্তন ঘটেছে তার পেছনে নিভৃতে কাজ করেছে মানুষের ত্যাগ। যে ত্যাগে ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে সামগ্রিক স্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। গবেষণা তেমনই একটি ত্যাগ। মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি মানুষের কল্যাণের মহান ব্রত নিয়ে বিজ্ঞান সাধনায় একটি মহতী পরিবার।
যাঁরা নিজেদের ভালোবাসার সঙ্গে বিজ্ঞানের এক নিবিড় বন্ধন গড়েছিলেন। মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে মানুষের ভেতরে মৌলিক চিন্তার উদ্ভব ঘটিয়েছেন। ১৯০৩ সালে মেরি কুরি স্বামী পিয়েরে কুরির সঙ্গে পদার্থবিদ্যায় এবং এককভাবে ১৯১১ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার জেতেন।
বিজ্ঞান সাধনায় নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি যে দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন তা ভাবতে গেলেই অভিভূত হতে হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন চিকিৎসার জন্য হাসপাতালগুলোতে এক্স-রে সরঞ্জামাদির অভাব অনুভূত হচ্ছিল, তখন এই দম্পতি ২২০টি রেডিওলজি স্টেশন গঠন করে প্রায় ১০ লাখ যুদ্ধাহত মানুষকে এক্স-রে করতে সহায়তা করেন। বিজ্ঞান, বিজ্ঞানী ও মানবসেবার দর্শনের এই ত্রিমাত্রিক বন্ধন আজও পৃথিবীর ইতিহাসকে নন্দিত করে চলেছে। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মেরি কুরি ও পিয়েরে কুরি দম্পতি বিজ্ঞান সাধনায় ত্যাগের মাধ্যমে এভাবে ক্রমাগতভাবে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় যে অবদান রেখেছিলেন, তা অবিস্মরণীয় করে রাখতে ‘জুলিও কুরি’ পুরস্কারের প্রবর্তন করা হয়। বিশ্ব শান্তি পরিষদ ১৯৫০ সাল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোধী, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে, মানবতার কল্যাণে, শান্তির সপক্ষে বিশেষ অবদানের জন্য স্মরণীয় ব্যক্তি ও সংগঠনকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে থাকে।
বঙ্গবন্ধুও ত্যাগ করেছেন। সেই ত্যাগের দর্শন বঙ্গবন্ধুর বহুমাত্রিক চিন্তা থেকে উৎসারিত হয়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছিল।
বঙ্গবন্ধু মানুষের কল্যাণে ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত ছিলেন, যা তাঁকে নিঃস্বার্থ এক মানুষে পরিণত করেছিল। সেই নিঃস্বার্থ মনে উদারতা জন্ম নিয়েছিল। সেই উদারতায় সব কিছুকে অনেক বড় করে দেখার মহতী শক্তি ছিল। যে শক্তি বঙ্গবন্ধুর আপন সত্তার বিকাশ ঘটিয়েছিল। যে সত্তা মৌলিকত্বের ধারণা দ্বারা পুষ্ট ছিল, শিকড়ের শক্তি থেকে উত্থিত ছিল। মৌলিকত্ব এ জন্যই বলছি, বঙ্গবন্ধু মানুষ, প্রকৃতি, দেশ ও পৃথিবীকে যেভাবে দেখেছেন, সেভাবে তাঁর মতো করে আর কেউ দেখতে পারেননি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র শুরুতেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তা-ই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এ নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে। ’ বঙ্গবন্ধু সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর মানুষের সংগ্রামের বিষয়ে সব সময় সচেতন ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯৫২ সালে চীনে অনুষ্ঠিত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি সম্মেলনে যোগদানের সময় তিনি বিভিন্ন দেশের শান্তিকামী এবং মুক্তিকামী নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের অধিকারের বিষয়ে তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। ‘আমার দেখা নয়া চীন’ বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘রাশিয়া হউক, আমেরিকা হউক, ব্রিটেন হউক, চীন হউক, যে-ই শান্তির জন্য সংগ্রাম করবে তাদের সঙ্গে আমরা সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে রাজি আছি, আমরা শান্তি চাই। ’ শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালির আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের তিনি যে মৌলিক ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন তা সারা পৃথিবীর শান্তি ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে এক অনন্য সম্পদে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূল উপজীব্য বিষয় ছিল ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয় এবং সকল বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান’, যা আজকের দিনেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রাসঙ্গিক ও অপরিহার্য উপাদানে পরিণত হয়েছে।
বিশ্বের মুক্তিকামী, নিপীড়িত, শ্রমজীবী ও দুঃখী মানুষের প্রাণের নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। শান্তি, সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাঁর চিন্তা ও দর্শন মানুষের মধ্যে প্রেরণা জুগিয়েছে। জেল, জুলুম, অত্যাচারসহ অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিনি। কিন্তু কখনো থেমে যাননি, আপস করেননি। বিশ্বরাজনীতি প্রসঙ্গে অসীম সাহসী ও অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে। ’
শোষিত ও নিপীড়িত জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তথা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেনশিয়াল কমিটির সভায় বাঙালি জাতির মুক্তি আন্দোলন এবং বিশ্বশান্তির সপক্ষে বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের জন্য শান্তি পরিষদের মহাসচিব রমেশ চন্দ প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। পৃথিবীর ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্লাজায় উন্মুক্ত চত্বরে আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের বিশাল সমাবেশে বিশ্ব শান্তি পরিষদের তৎকালীন মহাসচিব রমেশ চন্দ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক পরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন : ‘শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন, আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধুও বটে। ’ স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো রাষ্ট্রনেতার সেটিই ছিল প্রথম আন্তর্জাতিক পদক অর্জন।
পদক পেয়ে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়ভাবে বলেন, “যে পটভূমিতে আপনারা বিশ্বশান্তি আন্দোলনের সহকর্মী প্রতিনিধিরা আমাকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করেছেন, এই সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়। এ সম্মান বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতাসংগ্রামের বীর সেনানীদের, ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক সমগ্র বাঙালি জাতির। এটা আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের। ” বাংলাদেশের চরম দুঃসময়ে বিশ্ব শান্তি পরিষদ যেমন আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল, এ দেশের মানুষও ঠিক একইভাবে বিশ্বশান্তি আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে এসেছে।
বিশ্ব শান্তি পরিষদ প্রদত্ত ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদক ছিল জাতির পিতার বিশ্বমানবতার প্রতি কর্ম, ত্যাগ ও ভালোবাসার স্বীকৃতি। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর মৌলিক দর্শন ও অবদানের মূল্যায়ন। জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তি ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক সম্মান। এ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জনের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু থেকে হয়েছেন বিশ্ববন্ধু। বঙ্গবন্ধুর কর্ম ও ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত এই পদকটি ছিল একটি সদ্যঃস্বাধীন রাষ্ট্রের এক তাৎপর্যপূর্ণ কূটনৈতিক বিজয় ও সাফল্য। এ পদকপ্রাপ্তি আন্তর্জাতিকভাবে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশকে পৃথিবীর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। স্বাধীন বাংলাদেশের দ্রুত আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তি অর্থবহ ভূমিকা রেখেছে।
অন্ধকারকে পরাজিত করে আলোর পথে যাত্রা চলছে। সেটি দিনে দিনে আরো আলোকিত হয়ে উঠছে। সেই আলোয় এখনো অম্লান হয়ে আছে জুলিও কুরি শান্তি পদক অর্জনের স্বীকৃতি। হয়তো সেই অর্জনের শক্তি ইতিবাচক শক্তিতে পুঞ্জীভূত হয়ে পদ্মা সেতুর মতো আরো অনেক অর্জনের উজ্জ্বল আলোয় বাঙালির অগ্রযাত্রাকে নতুন দিনের পথ দেখাচ্ছে, দেখাবে। তবে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগের দর্শনকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরতে হবে।
লেখক : ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী
অধ্যাপক, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
কালের কণ্ঠ, ২৩ মে, ২০২২ লিঙ্ক