জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারাটি জীবন কেটেছে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জনগণের মাঝে কিংবা কারাগারে। ১৯৫৩ সালের ৫ মে বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন ২৮ এপ্রিল তাঁর একটি পুত্র সন্তান জন্ম হয়েছে। পরদিন পাবনায় জনসভা। মওলানা ভাসানীসহ ঢাকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন থেকে ঈশ্বরদী-গামী ট্রেনে ওঠার আগে একটি চিঠি ডাকে ফেলেন,
‘স্নেহের রেণু। আজ খবর পেলাম তোমার একটি ছেলে হয়েছে। তোমাকে ধন্যবাদ। খুব ব্যস্ত, একটু পরে ট্রেনে উঠব। ইতি তোমার মুজিব।’ [গোয়েন্দা রিপোর্ট, তৃতীয় খণ্ড পৃষ্ঠা ২৩৩]
৭১ পূর্ববর্তী সময়ে সন্তানদের কাছাকাছি থাকার সুযোগ কম পেলেও এক পলকে তাদের চোখের ভাষা পড়তে পারতেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারের রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘জামালের শরীর খারাপ, গলা ফুলে রয়েছে। এ বড় খারাপ ব্যারাম। রেণুকে তাই বললাম, ডাক্তার দেখাইও। স্কুলে যেতে পারবে না।’
এমন আত্মত্যাগ ও ভালোবাসার যুগপৎ দৃষ্টান্ত খুব বেশি নেই। ফলে পিতার আদর্শকে সম্পূর্ণ রূপে ধারণ করতে পেরেছেন বঙ্গবন্ধুর সন্তানেরা। ২৮ এপ্রিল তাদের একজন শেখ জামালের জন্মদিন।
কিশোর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের কিংবদন্তির নাম শেখ জামাল। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন কিশোর জামাল। তাঁর মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ঘটনা যেন রহস্য গল্পের দুঃসাহসী কোনো অভিযান!
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের জন্য পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ করার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান শেখ কামাল (এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন)। শেখ জামাল তাঁর মা, দুই বোন, শেখ রাসেল, ভগ্নীপতি এম এ ওয়াজেদ মিয়া ও অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে মগবাজারের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু ১২ মে পাকিস্তান বাহিনী সেখান থেকে সবাইকে গ্রেপ্তার করে ধানমন্ডির ৯-এ সড়কের (পুরনো ১৮) ২৬ নম্বর বাড়িতে গৃহবন্দী করে। শেখ জামাল তখন রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ৫ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত নেন। অসীম সাহসিকতার সাথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারকাটার বেড়া দেওয়া বন্দী শিবির থেকে বেরিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সকালে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব দেখতে পান জামাল ঘরে নেই। শেখ জামালের বয়স তখন মাত্র ১৭, গ্রেফতার করার আইনানুগ কোনো ভিত্তি ছিল না। তাই বেগম মুজিব ধারণা করেন পাকিস্তানিরা তাঁকে অপহরণ করেছে। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অপহরণের অভিযোগ তুললে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছিল পাকিস্তান সরকার।
পিতার মত দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে আগরতলা থেকে কলকাতা হয়ে কিশোর শেখ জামাল পৌঁছেন ভারতের উত্তর প্রদেশের কালশীতে। মুজিব বাহিনীর ( বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) তথা বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সের ৮০ জন নির্বাচিত তরুণের সঙ্গে ২১ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। চাচা শেখ আবু নাসেরের সাথে ৯ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর রণাঙ্গনে সাব-মেশিনগান হাতে শেখ জামালের আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়েছিল গার্ডিয়ান পত্রিকায়।
১৮ ডিসেম্বর যুদ্ধের পোশাকেই শেখ জামাল ঢাকায় ফেরেন। সেদিন বিকেলে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাদের সিদ্দিকী বীর-উত্তম এর উদ্যোগে ঢাকার পল্টনে আয়োজিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জনসভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ জামাল।
দেশে ফিরে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য সন্তানদের মতো শেখ জামালও ছিলেন সংস্কৃতি-মনা। গিটার শেখার জন্য একটি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন। ভালো ক্রিকেটার ছিলেন। হকিও খেলতেন বেশ ভালো। আবাহনী ক্রীড়া চক্র প্রতিষ্ঠায় শেখ কামালের পাশাপাশি শেখ জামালেরও অবদান ছিল।
শেখ জামাল একজন সেনাসদস্য হিসেবে জীবন গড়তে চেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ২৯ জানুয়ারি যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বাংলাদেশে এলে সেনাবাহিনীতে যোগদানের প্রবল আগ্রহ দেখে শেখ জামালকে যুগোস্লাভ মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেন। যুগোস্লাভিয়ার মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। তাঁকে ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্টে প্রশিক্ষণের পরামর্শও দিয়েছিলেন মার্শাল টিটো। ব্রিটেনের স্যান্ডহার্স্ট একাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে ১৯৭৫ সালের ২৫ জুলাই দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর লং কোর্সের প্রথম ব্যাচের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে যোগদান করেন শেখ জামাল।
ক্যাপ্টেন নজরুলের অধীনে ‘কোম্পানি অফিসার’ হিসেবে তিনি পেশাগত জীবন শুরু করেন। মাত্র দেড় মাস কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। স্বল্প সময়ে অসাধারণ পেশাগত দক্ষতা, আন্তরিকতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সৌজন্য ও কর্তব্য নিষ্ঠার কারণে সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেছিলেন। রাষ্ট্রপতির সন্তান হয়েও অহংকারের লেশমাত্র ছিল না। গাড়ির সুবিধা ভোগ করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মায়ের নির্দেশে অন্যান্য তরুণ অফিসারদের মতো মোটরসাইকেলে করে ক্যান্টনমেন্টে যাতায়াত করতেন।
১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই শেখ কামালের বিয়ের দিন বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন তাঁর ছোটবোন খাদিজা হোসেন লিলির কনিষ্ঠ কন্যা রোজীর সঙ্গে শেখ জামালের বিয়ে দিবেন। রোজী অত্যন্ত স্নেহ করতেন বঙ্গবন্ধু। জন্মের পর নামকরণও করেছিলেন।
১৭ জুলাই শেখ জামালের সঙ্গে বদরুন্নেসা কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী রোজী জামালের বিয়ে হয়। ১ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে স্যান্ডহার্স্টে রেগুলার ক্যারিয়ার কোর্স করার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েও পরিবারের মায়ায় দেশ ছাড়েন নি জামাল। ১৪ আগস্ট রাতে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। বেগম মুজিবের স্নেহময় অনুরোধে ফিরে যাওয়া হয়নি।
কর্মজীবন শুরুর মাত্র দেড় মাস পর ও বিয়ের ২৮ দিনের মাথায় বিশ্ব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। ১৫ই আগস্টের কালরাতে ঘাতকের দল সপরিবারে হত্যা করে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে। শিশু রাসেলও বর্বর হায়েনাদের কাছ থেকে রক্ষা পায় নি। ঘাতক দল বাংলাদেশের বুকে এঁকে যায় অমোচনীয় কলঙ্কের দাগ। শেখ জামালের বয়স ছিল ২১ বছর ৩ মাস ১৮ দিন, রোজী জামালের ১৭ বছর।
শেখ জামাল মাত্র ২১ বছর বয়সে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন, দেশপ্রেম, মেধা, সারল্য ও সাহসিকতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাংলাদেশের তরুণদের জন্য আলোর দিশারী হয়ে থাকবেন তিনি।
লেখক: আবদুল্লাহ হারুন জুয়েল
বৃহস্পতিবার । ২৮ এপ্রিল ২০২২ । ১৫ বৈশাখ ১৪২৯ । ২৬ রমজান ১৪৪৩