বঙ্গবন্ধুর কাছে পাঠানো দুটি গোপন বার্তা

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহযোদ্ধা ও সংগ্রামী সহচর ছিলেন রুহুল কুদ্দুস সিএসপি, যিনি আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বঙ্গবন্ধুর পাশের কক্ষে বন্দি ছিলেন এবং মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের এম এ অর্থনীতিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট রুহুল কুদ্দুস ষাটের দশকে ইসলামাবাদে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট) থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ বাঙালিকে বঞ্চিত করে পশ্চিম পাকিস্তানের ৪৪ শতাংশ অবাঙালির জন্য সিংহভাগ বরাদ্দ করার (পাকিস্তানের মোট পাঁচটি প্রদেশে সমান সমান বরাদ্দ দেখিয়ে) কূটকৌশলের ভেদ ভেঙে দেন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ঐতিহাসিক ছয় দফার রূপরেখা প্রণয়নে ভূমিকা গ্রহণ করেন। সম্পর্কে তিনি আমার মামা হওয়ার ফলে সেই সময়ের বহু গোপন তথ্য সাক্ষাত্কার হিসেবে আমাকে দিয়েছেন। আগরতলা মামলা চলাকালে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তারা পাশাপাশি কক্ষে থাকার সুবাদে বঙ্গবন্ধু তাকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন এই আশঙ্কায় যে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তাকে হত্যা করতে পারে। তার চেহারা ও গোঁফের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হলে বঙ্গবন্ধুর এমন আশঙ্কা দৃঢ় হয়।

আগরতলা মামলায় জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু যখন পশ্চিম পাকিস্তানে বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য অবস্থান করছেন, তখন একপর্যায়ে রুহুল কুদ্দুস বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চাইলেন যে, ‘সেন্টো-সিয়েটোর ইন্ধন ও সমর্থন নিয়ে আইয়ুব খান যদি বাঙালির ওপর গণহত্যা চাপিয়ে দেয়, সে ক্ষেত্রে প্রতিবেশী বার্মা (মিয়ানমার) বা ভারতের সাহায্য-সমর্থনের নিশ্চয়তা আপনি পেয়েছেন কি না?’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমি যদি ফিরতে না পারি, তুমি ঢাকায় ফিরে শশাঙ্কের সঙ্গে গোপন বৈঠক করবে।’

পরদিন বৈঠকের পর রাতে রুহুল কুদ্দুসের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আসেন আইয়ুব খানের মুখ্য সচিব সৈয়দ ফিদা হাসান। তিনি বঙ্গবন্ধুর জন্য আইয়ুব খানের গোপন বার্তা নিয়ে আসেন। বার্তাটি হলো—প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনটি অর্ডিন্যান্স জারি করবেন। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে শিখণ্ডী প্রেসিডেন্ট করে অর্ডিন্যান্সগুলো আইয়ুব খান জারি করবেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ মুজিবুর রহমানকে অনতিবিলম্বে আসীন করার লক্ষ্যে অর্ডিন্যান্সগুলো জারি করতে আইয়ুব খান আগ্রহী হন। মূলত পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার লক্ষ্যে তিনি এটা করতে সম্মত হন। সংবিধান পরিবর্তন করে আইয়ুব খান নামমাত্র প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী প্রধানমন্ত্রী হবেন। প্রেসিডেন্টের সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তরিত হবে।

সেই রাতে সৈয়দ ফিদা হাসানকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অপেক্ষায় রেখে রুহুল কুদ্দুস সাহেব সানন্দচিত্তে বিজয়ীর বেশে ইস্ট পাকিস্তান হাউজে বঙ্গবন্ধুর কক্ষে গিয়ে তাকে গোপন বার্তাটি দেন। বঙ্গবন্ধু তার দিকে দুই-তিন মিনিট তাকিয়ে থাকলেন। তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ‘তোমরা ভুলে গেছ কদিন আগেও বাঙালির এই জাত দুশমন আইয়ুব খান বাঙালি জাতিকে ১০ বছর ধরে গোলাম করে রেখেছিল, আগরতলা মামলায় তোমাকে-আমাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিল। বাঙালির এই দুশমনকে তুমি বিশ্বাস করো? কাশ্মীরের শেরে কাশ্মীর শেখ আবদুল্লাহ যে ফাঁদে পা দিয়ে কেয়ামত পর্যন্ত তার জাতিকে গোলামির জিঞ্জিরে আবদ্ধ করে গেছে, আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে আমার বাঙালির গলায় গোলামির জিঞ্জির পরাতে পারব না।’

সৈয়দ ফিদা হাসানের সঙ্গে আলোচনায় রুহুল কুদ্দুস ‘লারকানা ষড়যন্ত্র’ বিষয়ে অজানা আরো বহু গোপন তথ্য জানতে পারেন। ষাটের দশকে ইসলামাবাদে সৈয়দ ফিদা হাসান ও তিনি একত্রে চাকরি করার সূত্রে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। সে কারণে সৈয়দ ফিদা হাসান তার কাছে অতি গোপনীয় সব বিষয় ফাঁস করে দেন।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কুদ্দুস সিএসপি এবং বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত খুলনার এম এন এ মহসীন সাহেব সাতক্ষীরার ভোমরা বর্ডারসংলগ্ন মাহমুদপুর গ্রাম দিয়ে বিনা পাসপোর্টে ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ মঙ্গলবার কলকাতায় যান। রুহুল কুদ্দুস সিএসপি ও মহসীন সাহেব ৯ মার্চ মঙ্গলবার কলকাতায় পৌঁছে ধর্মতলার একটি হোটেলে ওঠেন, যার মালিক ছিলেন যশোরের এক হিন্দু ভদ্রলোক। উক্ত হোটেল থেকে তিনি ট্রাংকল বুক করে লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসের মিনিস্টার (১৯৬৯-৭২ পর্যন্ত লন্ডনে পদায়নরত) শ্রী শশাঙ্ক শংকর ব্যানার্জীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। উল্লেখ্য, শ্রী ব্যানার্জী ১৯৬২-৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাসের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর পদে চাকরি করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে বহু বিষয়ে তারা মতবিনিময় করেন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গড়ে তোলেন। ফোনে তিনি জানান, পরদিন যেন তিনি আবার লন্ডনে ফোন করেন। ১০ মার্চ বুধবার রাত ৮টায় রুহুল কুদ্দুস সাহেব লন্ডনে তাকে আবার ফোন করেন।

তিনি তাকে তৎক্ষণাৎ জানান যে, তারা দুজন ঐ রাতেই যেন ট্রেনে করে দিল্লি রওনা হয়ে যান। দিল্লি পৌঁছে তাকে ফোন করলে তিনি পরবর্তী করণীয় জানাবেন। ১২ মার্চ শুক্রবার সকালে মহসীন সাহেব ও রুহুল কুদ্দুস সাহেব দিল্লি পৌঁছে রাত ১০টায় লন্ডনে শ্রী শশাঙ্ক শংকর ব্যানার্জীকে ফোন করেন। তিনি তাকে জানান, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী খুব ব্যস্ত বলে তার সঙ্গে তাদের দেখা হবে না। তবে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন যে, তারা যেন তার পরিকল্পনামন্ত্রী শ্রী ডি পি ধরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি শ্রী ধরের ফোন নম্বর রুহুল কুদ্দুস সাহেবকে দিয়ে বলেন০, ফোন করামাত্র তার স্টাফ পাঠিয়ে তাদের অফিসে তাদের নিয়ে যাবেন এবং তার সঙ্গে আলোচনা বৈঠকের ব্যবস্থা করবেন।

১৩ মার্চ শনিবার বেলা ১১টায় ভারতের পরিকল্পনামন্ত্রী শ্রী ডি পি ধরের পিএসের সঙ্গে রুহুল কুদ্দুসের কথা হয় এবং ঐ দিন রাত ১০টায় শ্রী ধর তার বাসায় নৈশভোজের আমন্ত্রণ জানান। তার বাসায় নৈশভোজের পর মহসীন সাহেবকে সেখানে বসিয়ে রেখে শ্রী ধর শুধু রুহুল কুদ্দুস সাহেবকে অন্য একটি বড় কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে তিনি ৫০-৬০ জনকে বড় লম্বা টেবিলের চারপাশে দুই সারিতে উপবিষ্ট দেখতে পান। শ্রী ধর তাদের ঢাকার অবস্থা, বাংলাদেশের অবস্থা এবং ঢাকার রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিফ করার অনুরোধ করেন। সব শেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বঙ্গবন্ধুর কী বার্তা তা পড়ে শোনাতে বলেন। সেখানে উপস্থিতদের মধ্যে সাউথ ব্লকের ঝানু ঝানু সচিব ও তিন বাহিনীর প্রধানসহ সিনিয়র ৪০-৪৫ জন সামরিক কর্মকর্তা সিভিল ড্রেসে উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া ২০-২৫ জন সিনিয়র মন্ত্রী হাজির ছিলেন বলে তিনি অনুমান করে নিয়েছিলেন।

১৪ মার্চ রবিবার ভোর সাড়ে ৬টায় একজন সেনা অফিসার এসে রুহুল কুদ্দুস সাহেবকে ডেকে তোলেন এবং এত ভোরে ঘুম থেকে তোলার জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়ে বলেন যে, তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সামরিক ভ্যানে একজন ভিআইপি অপেক্ষা করছেন। রুহুল কুদ্দুস সাহেব চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। ততক্ষণে তার কক্ষের দরজার সামনে এসে দাঁড়ান মি পি এন হাকসার। বঙ্গবন্ধুর দূত রুহুল কুদ্দুস সাহেবকে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা পৌঁছে দিতে আসেন তার মুখ্য সচিব পি এন হাকসার (’৭১ সালে যার সঙ্গে প্রবাসী সরকারের মুখ্য সচিব হিসেবে কুদ্দুস সাহেবের নিয়মিত বৈঠক হয়েছে)। বঙ্গবন্ধুর কাছে ইন্দিরা গান্ধীর অতি গোপনীয় সংক্ষিপ্ত ইংরেজি বার্তাটি দিয়ে হ্যান্ডশেক করে মি পি এন হাকসার চলে যান। বঙ্গবন্ধুর কাছে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বার্তাটি ছিল এরূপ :‘শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভারত থেকে ঝড়ের বেগে সামরিক ও বেসামরিক সব সাহায্য ও সহযোগিতা যাবে। ভারতে ট্রেনিং ক্যাম্প হবে। ট্রেনিং চলবে। প্রবাসে (কলকাতায়) বাংলাদেশের রাজধানী হবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে লন্ডনে যেভাবে ফ্রান্সের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেভাবে ভারতে বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে ভারত সর্বাত্মকভাবে ও প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালনের সর্বোচ্চ নিশ্চয়তা প্রদান করছে।’ ১৪ মার্চ রবিবার দুপুর ১২টায় কলকাতাগামী ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সের একটি বিশেষ বিমানে তাদের তুলে দেওয়া হয়। কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে অবতরণের পর ভারতীয় বিশেষ সংস্থার দুজন কর্মকর্তা তাদের বাংলাদেশের ভোমরা সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছে দেন। ১৬ মার্চ রাত ১১টায় তারা ঢাকায় পৌঁছে সরাসরি ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

বঙ্গবন্ধু তাদের দুজনকে পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেন। প্রায় পাঁচ মিনিট তিনি তাদের বুকে জড়িয়ে ধরে থাকেন। তারপর তাদের নিয়ে দোতলার ছাদে উঠে যান। সেখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু তাদের মুখ থেকে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বার্তাটি শোনেন। শোনার সঙ্গে সঙ্গে রুহুল কুদ্দুস সাহেবকে ডান বুকে ও মহসীন সাহেবকে বাঁ বুকে জড়িয়ে ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে বঙ্গবন্ধু জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ।’ তারা তিন জন দুই রাকাত করে নফল নামাজ আদায় করলেন এবং বঙ্গবন্ধু তাদের দুজনকে আল্লাহর নামে কসম করালেন যে, মৃত্যু পর্যন্ত তারা এই বার্তার গোপনীয়তা ভঙ্গ করবেন না। বঙ্গবন্ধুর এই দুই বিশ্বস্ত অনুসারী মৃত্যু পর্যন্ত এই কসম ভঙ্গ করেননি। আমার মামা, রুহুল কুদ্দুস তার মৃত্যুর আগে তার গুলশানের বাসায় আমাকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে এই গোপন দূতিয়ালির তথ্য প্রকাশ করেন। তবে শর্ত দেন যে, তার মৃত্যুর পর এই সাক্ষাত্কার প্রকাশ করা হবে। মহসীন সাহেব ও রুহুল কুদ্দুস সাহেব দুজনেই মৃত্যুবরণ করেছেন। আল্লাহ তাদের দুজনকে বেহেশত নসিব করুন।

মুসা সাদিক
স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট এবং সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার। ‘বাংলাদেশ উইনস ফ্রিডম’ গ্রন্থের রচয়িতা।

ইত্তেফাক, ২৯ মার্চ ২০২২,

আরও পড়ুন