শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭২ সালে বিবিসি বাংলাকে সাক্ষাৎকার দেবার সময় তোলা ছবি)

বিবিসি বাংলার জরিপে শ্রেষ্ঠ বাঙালি: শেখ মুজিবুর রহমান – ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধির মাধ্যমে যিনি হয়ে উঠেছিলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

দু’হাজার চার সালে বিবিসি বাংলা একটি ‘শ্রোতা জরিপ’-এর আয়োজন করে। বিষয়টি ছিলো – সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি কে? তিরিশ দিনের ওপর চালানো জরিপে শ্রোতাদের ভোটে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ ২০জনের জীবন নিয়ে বিবিসি বাংলায় বেতার অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয় ২০০৪-এর ২৬শে মার্চ থেকে ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত।

বিবিসি বাংলার সেই জরিপে শ্রোতাদের মনোনয়নে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তাঁর জীবন-কথা।

শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠ ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগোষ্ঠিকে মুক্তি ও স্বাধীনতার পথ নির্দেশনা দিয়েছিল।

“…মনে রাখবা- রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।” ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেস কোর্স ময়দানের এক জনসভায় এই বজ্রঘোষণার মাধ্যমে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ই মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান ছিলেন গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার এবং মা সায়েরা খাতুন।

বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সায়েরা খাতুনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান।

ছবির উৎস,MUJIB100.GOV.BD

ছবির ক্যাপশান,বাবা শেখ লুৎফর রহমান এবং মা সায়েরা খাতুনের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান।

ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন তাঁর সাত বছর বয়সে।

খুবই অল্প বয়সে তিনি বিয়ে করেছিলেন সম্পর্কে আত্মীয় বেগম ফজিলাতুন্নেসাকে।

নয় বছর বয়সে তিনি ভর্তি হন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে এবং পরে ম্যাট্রিক পাশ করেন গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে।

গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে পড়ার সময় ১৯৩৯ সালে স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক এবং পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কাশ্মিরী বংশোদ্ভুত বাঙালি মুসলিম নেতা মি.সোহরাওয়ার্দী পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবনকে গভীরভাবে প্রাভাবিত করেছিলেন।

উনিশশ’ ৪২ সালে এট্রান্স পাশ করার পর শেখ মুজিব ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে যেটির বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল। এই কলেজ থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান (ছবি ১৯৪৯)

ছবির উৎস,MUJIB100.GOV.BD

ছবির ক্যাপশান,রাজনৈতিক জীবনে শেখ মুজিবকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। (ছবি ১৯৪৯)

তবে স্কুল জীবন থেকেই তিনি তাঁর নেতৃত্ব দেবার দক্ষতা প্রমাণ করেছেন।

তিনি ১৯৪৩ সালে যোগ দেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে এবং ১৯৪৪ সালে বর্তমান বাংলাদেশের কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের সম্মেলনে যোগদানের মধ্যে দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে অভিষিক্ত হন।

শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে এবং এ সময়েই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী নিযুক্ত হয়েছিলেন। ওই বছরই প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি মুসলিম লীগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

এসময় তিনি পাকিস্তানে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে বেঙ্গল মুসলিম লীগের হয়ে সক্রিয় আন্দোলনে অংশ নেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকেই ১৯৪৭ সালে তিনি বি.এ. পাশ করেন এবং ভারত ও পাকিস্তান পৃথক হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্মীদের বিক্ষোভে ‘উস্কানি’ দেবার অভিযোগ এনে কর্তৃপক্ষ তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করায় আইন পড়া তাঁর শেষ হয়নি।

কলকাতার বেকার হোস্টেল ছাত্রাবাস

ছবির উৎস,MUJIB100.GOV.BD

ছবির ক্যাপশান,কলকাতায় যে বেকার হোস্টেলে ছাত্রাবস্থায় থেকেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

তিনি ১৯৪৮ সালে জানুয়ারির ৪ তারিখে প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ যার মাধ্যমে তিনি একজন অন্যতম প্রধান ছাত্র নেতায় পরিণত হন। এ সময় তিনি ঝুঁকে পড়েন সমাজতন্ত্রের দিকে এবং মনে করতেন দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য একমাত্র পথ সমাজতন্ত্রের বিকাশ।

মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেবার পর এর বিরুদ্ধে যে গণ আন্দোলন শুরু হয়, সে আন্দোলনে একটা অগ্রণী ভূমিকা ছিল শেখ মুজিবের।

বিভিন্ন আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার জন্য ১৯৪৮ সাল থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে বহুবার কারাভোগ করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানী ১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার পর শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ ছেড়ে দিয়ে এই নতুন দলে যোগ দেন এবং তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান অংশের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নামে যে বিরোধী রাজনৈতিক মঞ্চ গঠিত হয়েছিল, তার মূল দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য অধিকতর স্বায়ত্তশাসন। এই জোটের টিকেটে ১৯৫৪র নির্বাচনে গোপালগঞ্জ আসন থেকে বিজয়ী হয়েছিলেন শেখ মুজিব। তাঁকে তখন কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।

১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জেতার পর শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে শপথ নিচ্ছেন। তাঁকে শপথ পড়াচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক। (১৫ই মে ১৯৫৪)

ছবির উৎস,MUJIB100.GOV.BD

ছবির ক্যাপশান,১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের টিকেটে নির্বাচনে জেতার পর শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে শপথ নিচ্ছেন। তাঁকে শপথ পড়াচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক।

কিন্তু নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকার ওই যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেয়।

এই অনুষ্ঠান তৈরির সময় ঢাকায় প্রবীণ সাংবাদিক আতাউস সামাদ বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন মি. সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে এসে শেখ মুজিব মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দলটিকে শক্তিশালী করেছিলেন।

উনিশশ’ ৫৫ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশেষ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে দলের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিব আবার দলের মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছিলেন।

পাকিস্তানে ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করা হয়। সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে সংগ্রামের কারণে তাঁকে কয়েক বছর আবার জেল খাটতে হয়েছিল।

এরপর ১৯৬১ সালে অন্যান্য সাধারণ ছাত্রনেতাদের নিয়ে গোপনে তিনি স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ নামে এক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করা।

১৯৬২ সালে এক জনসভায় আইয়ুব খানের শাসনের বিরোধিতা করে ভাষণ দিচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। (ছবি ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯৬২)

ছবির উৎস,MUJIB100.GOV.BD

ছবির ক্যাপশান,১৯৬২ সালে এক জনসভায় আইয়ুব খানের শাসনের বিরোধিতা করে ভাষণ দিচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

বিবিসি বাংলাকে আতাউস সামাদ বলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার দায়িত্ব নেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে “ছয় দফা দাবি” পেশ করেন।

“শেখ সাহেব সাহস করে ছয় দফা ঘোষণা করলেন, তাও করলেন তিনি লাহোরে। পশ্চিম পাকিস্তানে একটা সম্মেলনে গিয়ে তিনি ওই ছয় দফা ঘোষণা করলেন, যার ফলে ওঁনাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে যে মামলাটি হয় তাতে এক নম্বর আসামী করা হলো ১৯৬৮ সালের ৩রা জানুয়ারি,” বলেন আতাউস সামাদ।

এই মামলায় বলা হয়েছিল শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোগী বাঙালি কর্মকর্তারা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা শহরে ভারত সরকারের সাথে এক বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছে।

ওই মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশব্যাপী যে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয় তা এক সময় গণ আন্দোলনে রূপ নেয়। সেই গণ আন্দোলন বা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান চরম রূপ ধারণ করলে পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত এই মামলা প্রত্যাহার করে নেয় এবং শেখ মুজিবসহ অভিযুক্ত সকলকে মুক্তি দেয়া হয়।

Sheikh Mujibur Rahman after getting his title 'Bangabandhu'.

mujib100.gov.bd
এটা আমি বলব একটা পালাবদল। কারণ পল্টনে তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়ার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা।
কামাল হোসেন
রাজনীতিক

“ওঁনাকে ছাড়ানোর জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল যেটা ছাত্রদের ১১ দফায় রূপ নিয়েছিল, সেইখান থেকে মুক্তি পাওয়ার পরদিনই তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হলো,” বলেন আতাউস সামাদ।

রেস কোর্স ময়দানে ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ এক বিশাল জনসভায় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়েছিল।

উনিশশ’ ৭০-এর নির্বাচনে শেখ মুজিব তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টিকে মূল বক্তব্য হিসাবে তুলে ধরেছিলেন, বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন সাংবাদিক আতাউস সামাদ। তিনি বলেন শেখ মুজিবুর রহমানের অনেকগুলো নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। তিনি দেখেছেন সব জায়গাতেই তাঁকে ছয় দফা নিয়ে কথা বলতে।

“ছয় দফা না বলে আঙুল তুলে বলতেন আমার দাবি ‘এই’ অর্থাৎ দেশ স্বাধীন করতে হবে,” বলেছিলেন মি. সামাদ। এই দাবিকে শেখ মুজিব ব্যাখ্যা করেছিলেন ”আমাদের বাঁচার দাবি” হিসাবে।

শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ড. কামাল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”১৯৬৯ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি পল্টনে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়ার মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হয় জনগণের কত কাছাকাছি তিনি চলে এসেছেন। এটা আমি বলব একটা পালাবদল। কারণ এই বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়ার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠলেন জনগণের অবিসংবাদিত নেতা।

“আরেকটি হচ্ছে নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। নির্বাচনের সিদ্ধান্ত, নির্বাচনের ফলাফল স্পষ্টই প্রমাণ করেছিল যে বাঙালির তিনি একমাত্র মুখপাত্র। এটা কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক ভিত্তিকে অনেক শক্ত করে দিয়েছিল বলে আমি মনে করি,” বলেছিলেন ড. কামাল হোসেন।

এই ছয় দফা দাবির পক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন দেশব্যাপী শুরু হয়েছিল তীব্র গণ আন্দোলন ।

রাজনৈতিক ভাষ্যকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের তিনটি বড় গুণ ছিল তিনি ছিলেন অত্যন্ত সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং আপোসহীন।

শেখ মুজিবুর রহমান

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,শেখ মুজিবুর রহমান

“পাকিস্তান রাষ্ট্রে প্রধান দ্বন্দ্ব কী সেটাকে তিনি খুব সঠিকভাবে চিহ্ণিত করতে পেরেছিলেন। অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই তিনি জেনে নিয়েছিলেন যে বাঙালির সঙ্গে পাকিস্তানের দ্বন্দ্বটাই ছিল প্রধান দ্বন্দ্ব। তাঁর মধ্যে অসাধারণ একটা আকর্ষণী শক্তি ছিল- ক্যারিশমা। তিনি জনগণকে বুঝতেন, জনগণের সঙ্গে মিশতে পারতেন, তাদের ভাষা জানতেন, তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন।”

মি. সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় শেখ মুজিব যখন ঘোষণা করলেন যে এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে “বাংলাদেশ” নামে অভিহিত করা হবে, তখন পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্তারা তাঁকে একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার তকমা দিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে ওই নির্বাচনী ফলাফল পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে মেরুকরণ তৈরি করল। পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো, শেখ মুজিবের স্বায়ত্বশাসনের নীতির প্রবল বিরোধিতা করলেন।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা বুঝতে পারল যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানের দলকে সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না।

তাজউদ্দীন আহমেদ এবং আওয়ামী লীগের সাতজন নারী নেত্রীর সঙ্গে ১৯৭০এ নির্বাচনের ফলাফল রেডিওতে শুনছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

ছবির উৎস,MUJIB100.GOV.BD

ছবির ক্যাপশান,তাজউদ্দীন আহমেদ এবং আওয়ামী লীগের সাতজন নারী নেত্রীর সঙ্গে ১৯৭০এ নির্বাচনের ফলাফল রেডিওতে শুনছেন শেখ মুজিবুর রহমান।

ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এক জনসভায় শেখ মুজিব স্বাধীনতার ডাক দিলেন এবং জনগণকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হবার আহ্বান জানালেন। যার মধ্যে দিয়ে শুরু হল বাংলাদেশের নয় মাস ব্যাপী সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম।

শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সম্পর্কে আতাউস সামাদ বলেছিলেন, “রেস কোর্সে তিনি এমন একটা বক্তৃতা দিলেন যা সবার মন ছুঁয়ে গেল, সবাই ওঁনার নির্দেশ মানতে লাগল। ওঁনার নামেই স্বাধীনতা যুদ্ধ চলল নয় মাস।”

শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে এবং ফয়সালাবাদের একটি জেলে কড়া নিরাপত্তায় রাখা হলো। এরপর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২-এর দশই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

রেস কোর্সে শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ

ছবির উৎস,MUJIB100.GOV.BD

ছবির ক্যাপশান,রেস কোর্সে শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ

অল্পদিনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি থাকার পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।

শেখ মুজিব ১৯৭২ সালে বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের কথা।

কিন্তু স্বাধীনতার পর দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ে ক্রমশ বাড়তে থাকা অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাল দিতে শেখ মুজিব তাঁর ক্ষমতা বাড়াতে থাকলেন। ১৯৭৫-এ কয়েকটি দল মিলে গঠন করা হলো বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা সংক্ষেপে বাকশাল নামে রাজনৈতিক দল। বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বদলে শেখ মুজিব নিজেকে আমৃত্যু রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন।

পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২-এর দশই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গেলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

ছবির উৎস,BETTMANN/GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২-এর দশই জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে যান শেখ মুজিবুর রহমান।

বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান প্রচারের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন তার মূল্যায়নে বলেছিলেন, “আমার কাছে মনে হয়েছে, গণতন্ত্র অর্থাৎ পশ্চিমী ধাঁচের যে গণতন্ত্র, যার উপর বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন গড়ে উঠেছিল, সেই অবস্থান থেকে তিনি ক্রমাগত সরে এসেছিলেন।

“একদলীয় যে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, তা নির্দ্বিধায় বলা যায় গণতন্ত্র পরবর্তী ব্যবস্থা। সারা দেশে যখন একটা চরম বিশৃঙ্খলা, সেই সময় অন্তত আমার কাছে মনে হয় যে, বঙ্গবন্ধু এমন একটা ভাবনায় পরিবেষ্টিত থাকতেন যে, গোটা পরিস্থিতিটি তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ঢাকার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের যে বাড়িটি থেকে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন, যে বাড়ি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করেছিল ১৯৭১ সালে ২৫শে মার্চের রাতে, স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ১৯৭৫-সালে ১৫ই অগাস্টের রাতে সেই বাড়িতেই সেনাবাহিনীর একদল সদস্যের হাতে নিহত হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে।

৩১শে জানুয়ারি ১৯৭২ ঢাকা স্টেডিয়ামে শেখ মুজিব।

mujib100.gov.bd
অনেক নেতাকে আমরা পেয়েছি। কিন্তু জনগণের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, জনগণের ভাবনা, চেতনা, অভিলক্ষ্য, স্বপ্ন সবকিছুকে ধারণ করতে পেরেছিলেন একজনই- তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।
সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
অধ্যাপক

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মূল্যায়নে: ”বঙ্গবন্ধু দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তার যে উদ্ভব সেটির চূড়ান্ত পর্যায়ে ‘অনুঘটক নেতৃত্বের’ ভূমিকা পালন করেছিলেন। কাজেই তিনি ইতিহাসের সঙ্গেই লগ্ন হয়ে আছেন। বাঙালির ইতিহাসের সঙ্গে।”

অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, “১৯৪৭ থেকে ‘৭১ এই সময়টুকুতে অনেক নেতাকে আমরা পেয়েছি। যাদের অবদান কম নয়। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে জনগণের মুখপাত্র হয়ে ওঠা, জনগণের ভাবনা, চেতনা, অভিলক্ষ্য, স্বপ্ন সবকিছুকে ধারণ করতে পেরেছিলেন একজনই- তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।”

Presentational grey line

বিবিসি বাংলার যেসব শ্রোতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির আসনে বসিয়েছিলেন, তাদের কয়েকজন বলেছিলেন কেন তারা শেখ মুজিবকে ভোট দিয়েছিলেন।

মণিকা রশিদ– নাগাসাকি, জাপান: “তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণ মন্ত্রের মত সমগ্র বাঙালি জাতিকে পৃথিবীর একটি সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে খালি হাতে লড়াইয়ে নামতে এবং সেই লড়াইয়ে জিততে উদ্বুদ্ধ করেছিল। আজ আমরা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে যে যেখানেই বসে যা কিছু করছি বা বলছি, তার কোনটাই সম্ভব হতো না যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়টাতে না পেতাম।”

শহীদুল হক– ধানমণ্ডি, ঢাকা: “একটা দেশের স্রষ্টা যিনি সমগ্র দেশের মানুষকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন। আজকে মানুষের স্বাধীনভাবে বাঁচার একটা স্পৃহা আছে। আমরা যে স্বাধীন এই উপলব্ধিটা কিন্তু এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকেই।”

জিনাত হুদা– কভেন্ট্রি, ব্রিটেন: “বাঙালি জাতি যদি হয় একটি স্বপ্নের নাম, আকাঙ্ক্ষার নাম, সংগ্রামের নাম এবং সফলতার নাম, তবে তার রূপকার শেখ মুজিব।”

BBC ১৭ মার্চ ২০২০ LINK 

আরও পড়ুন