১৯৬৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি শেখ মুজিব ক্যাম্পের বাইরে পায়চারি করছিলেন। সে সময় একজন পাঠান ক্যাপ্টেন গোপনে শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেন, দ্রুত ভেতরে চলে যাওয়ার জন্য। অল্পের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন। চরম নৃশংসতা ঘটে পরদিন সকালে। শেখ মুজিবের ক্যাম্প থেকে একটু দূরে থার্ড পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে বন্দি করে রাখা হয়েছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি অন্য ২২ জন অভিযুক্তকে। সেদিন ভোর সাড়ে ছয়টায় সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফ্ল্যাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হক টয়লেটে যাওয়ার জন্য বেরোচ্ছিলেন।
লুকিয়ে থাকা একজন পাকিস্তানি সামরিক গার্ড মাত্র সাত-আট ফুট দূর থেকে তাদের ওপর গুলি ছোড়ে। জহুরুল হক ও ফজলুল হক মাটিতে লুটিয়ে পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত করতে তাদের বেয়নেট চার্জ করা হয়। গুলির শব্দ শুনে সেনাবাহিনীর লোক ঘটনাস্থলে আসে। পাকিস্তানি হাবিলদার মঞ্জুরকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। (পরে তার কোনো বিচার করা হয়েছিল কিনা জানি না)। গুরুতর আহত অবস্থায় জহুরুল হক ও ফজলুল হককে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। ফজলুল হককে আগে অপারেশন করে বাঁচানো সম্ভব হলেও জহুরুল হককে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নি। সে সময় উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহের নার্স খাওলা খাতুন। সিরাজ উদ্দীন আহমেদ তার সাক্ষ্যে এভাবে লিখেছেন, ‘যদি একই সঙ্গে দুটেবিলে উভয়ের অপারেশন হতো হয়তো জহুরুল হককেও বাঁচানো সম্ভব হতো। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও একগুঁয়েমির জন্য তা সম্ভব হয়নি।’ (সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ভাস্কর প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ- ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা-২৪২)
সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃতদেহ তার ভাই অ্যাডভোকেট আমিনুল হকের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় নিয়ে আসা হয় ১৬ ফেব্রুয়ারি সকালে। হাজার হাজার মানুষ সারিবদ্ধ হয়ে জাতীয় বীরের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তার মৃত্যুতে শুরু হয় গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্ব। অপরাহ্ন ২টা ৩০ মিনিটে লাশ নিয়ে আসা হলো পল্টন ময়দানে জানাজা পড়ানোর জন্য। মওলানা ভাসানী জানাজা পড়ালেন। তার পর লাশ নিয়ে শুরু হলো মিছিল। তখন লাগাতার কারফিউ চলছিল। জনতা কারফিউ ভেঙে ফেললেন চোখের পলকে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। শান্ত রাজধানী আবার অশান্ত হয়ে পড়ে পরদিনই। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী থেকে খবর এলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রক্টর এবং রিডার ড. শামসুজ্জোহাকে সামরিক বাহিনী হত্যা করেছে। এমনিতেই সারা প্রদেশ ক্ষোভে টগবগ করছিল। এর মধ্যে ড. জোহার মৃত্যুর খবর পেয়ে সে আগুন দ্বিগুণ হয়ে গেল। মালিবাগ রেলক্রসিংয়ের কাছে কারফিউ ভেঙে বস্তির নারী-পুরুষ-শিশুসহ সাধারণ মানুষ পথে নেমে আসেন। যে যেখানে পেরেছেন আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিলেন। আর সমানে স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘চল চল ক্যান্টনমেন্ট চল। জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব।’
পরিস্থিতি দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। তাই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৭ ফেব্রুয়ারি বিরোধী নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান জানালেন। বৈঠকে যাওয়ার আগে নেতারা নিজেরা এক বৈঠকে মিলিত হন। আওয়ামী লীগ পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিল, আলোচনায় বসার আগে অবশ্যই সরকারকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবসহ সব বন্দিকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। ক্যান্টনমেন্টে বসে শেখ মুজিব তখন কী ভাবছিলেন তা কেউ জানেন না। অনেকেই তাকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন, প্যারোলে হলেও আইয়ুবের দরবারে যাওয়া জন্য। এই সংবাদ পেয়ে কোনোরকম শর্ত দিয়ে যেন তার স্বামী জেল থেকে বের না হন তা স্পষ্ট করে বলে পাঠিয়েছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। (এবিএম মূসা, মুজিব ভাই, প্রথমা, প্রথম প্রকাশ আগস্ট ২০১২, পৃষ্ঠা-৩৭)। দলের মনোভাবও এ রকম ছিল। তিনিও এ প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। আইয়ুব খান বুঝতে পারছিলেন যে, গণজাগরণ দানা বেঁধেছে। তিনি আর তা দমন করতে পারবেন না। ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াই তার জন্য উত্তম হবে। ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে আইয়ুব খান সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো তার পক্ষে অসম্ভব। তিনি রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘রাজনীতি হলো পাগলা গারদ।’ (সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, প্রাগুক্ত, ২৪৪)। ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান হঠাৎ ঘোষণা করলেন, আগরতলা মামলা তুলে নেওয়া হয়েছে। সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হলো। ২২ ফেব্রুয়ারি মধ্যাহ্নেই আগরতলা মামলার সব অভিযুক্তকে ছেড়ে দেওয়া হলো। লাখো মানুষ ছুটল সেনানিবাসের দিকে। সেদিনই জনতা শেখ মুজিবকে পল্টন ময়দানে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিপুল জনতার তুলনায় পল্টন ময়দান নেহাত ছোট হয়ে যায়। সিদ্ধান্ত হলো পরদিন রেসকোর্স ময়দানে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। একটি দৈনিক পত্রিকায় লেখা হয়, ‘পূর্ববাংলার মাটিতে অবশেষে বাস্তিলের কারাগার ধসিয়া পড়িয়াছে। জনতার জয় হইয়াছে। গণদাবির নিকট নতি স্বীকার করিয়া দোর্দ- প্রতাপশালী সরকার তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করিয়া পূর্ববাংলার অগ্নিসন্তান, দেশগৌরব আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানসহ এই মামলায় অভিযুক্ত সবাইকে কুর্মিটোলা সামরিক ছাউনি বন্দিনিবাস হইতে গতকল্য (শনিবার) মধ্যাহ্নে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হইয়াছেন’ (সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, প্রাগুক্ত, ২৪৫)।
২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ সব বাঙালির জন্য অনন্য একটি দিন। কারণ এ দিনই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালির জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া হয় ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি। তোফায়েল আহমেদে সেদিনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘সেদিনের রেসকোর্স যারা দেখেননি তাদের বলে বোঝানো যাবে না সেই জনসমাবেশের কথা। আমরা যখন সেখানে পৌঁছেছি তখন রেসকোর্স ময়দান ভরে গেছে। মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে অন্যদিকে রমনা পার্কে আশ্রয় নিয়েছে। ট্রেন, বাস, ট্রাক বোঝাই হয়ে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম থেকে লঞ্চে-স্টিমারে বরিশাল, খুলনা, যশোর থেকেও নেতাকর্মী শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ ছুটে এসেছে। ঢাকার মানুষ তো আছেই।
… বলছিলাম ২৩ ফেব্রুয়ারি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়ার দিন। একটা ছাত্রের জীবনে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে? বাংলার অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ নেতা শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিব যে মঞ্চে, যার সামনে দশ লাখেরও অধিক মানুষ, আমি সেই সভার সভাপতি। সেদিন ওই মঞ্চে বক্তব্য রেখেছিলেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, মতিয়া ছাত্র ইউনিয়নের সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক, মেনন, ছাত্র ইউনিয়নের মাহবুবউল্লাহ এবং এনএসএফের মাহবুবুল হক দোলন। আগেই বলেছি, আমি ছিলাম সভাপতি, নিয়ম অনুসারে সব বক্তার শেষেই আমার বক্তৃতা দেওয়ার কথা। কিন্তু নেতা বক্তৃতা দেওয়ার পর আমি বলব এবং আমার কথা কেউ শুনবেন এমন আশা করা ধৃষ্টতা। আমি কেন, আমার বন্ধু নেতারাও এটা ভাবেননি।
তাই শেখ মুজিবের ভাষণের আগে আমাকে দাঁড়াতে হলো। যাকে গণসংবর্ধনা দিচ্ছি তিনি ভাষণ দেবেন সবার শেষে সেটাই সাব্যস্ত হয়েছিল। আমার জন্য অবশ্য ভাষণ দেওয়াটা তেমন জরুরি ছিল না, এর চেয়ে অনেক বড় একটা দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করা হয়েছিল। সেটা হলো ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে জাতির অনুমোদন নিয়ে আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি উপাধি দেওয়া- যা তার নামের সঙ্গে অবিনশ্বর হয়ে থাকবে।
… সেই সময়ই আমি ঘোষণা করলাম- বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান, হাজার বছরের মহাপুরুষ নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, প্রবঞ্চিত বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করলাম। আজ থেকে তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
লাখ লাখ কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো- ‘জয় বঙ্গবন্ধু।’ (তোফায়েল আহমেদ, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু’, অনুলিখন : আবু আল সাঈদ, আগামী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা-৩৩)। আর এভাবেই ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি শেখ মুজিবুর রহমানের নামের অংশ হয়ে গেল। আর পরবর্তী সময়ে এটিই হলো বাঙালির ইতিহাসের সর্বোচ্চ উচ্চারিত শ্রদ্ধা মেশানো অবিস্মরণীয় এক নেতার অভিধা। যে অভিধা বাংলাদেশ এবং বিশ্বে সততই উচ্চারিত হয় গভীর শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায়। নিঃসন্দেহে ‘এই নাম স্বত্যোৎসারিত’। কেননা তিনিই যে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’। তিনিই যে বাংলাদেশ।
ড. আতিউর রহমান : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক এবং সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক | বিজনেস বাংলাদেশ ডটকম
বিজনেস বাংলাদেশ.কম.বিডি, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ লিঙ্ক