আজ ঐতিহাসিক ১০ জানুয়ারি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন ও দিল্লি হয়ে আজকের এই দিনে তিনি তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় পরিপূর্ণতা লাভ করে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি জান্তা সরকার কর্তৃক গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সেই বার্তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। সে রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সরকার তাকে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি করে রাখে। এর আগে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি হানাদার সামরিক বাহিনী শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠীর পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। মুক্তিকামী মানুষ তার ডাকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি স্বাধীনতার লক্ষ্যে জাতিকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশনা দেন।
মুক্তযুদ্ধ চলাকালীন দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে বঙ্গবন্ধুর বিচারের আয়োজন করে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পরিচালিত সামরিক আদালতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কারাগারের যে সেলে রাখা হয়েছিল, তার পাশেই তার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। যদিও বিশ্বজনমতের চাপে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার ফাঁসি কার্যকর করতে সাহস করেনি। বাঙালির স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি ছিলেন প্রত্যয়দৃঢ় ও অবিচল। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে পিআইএর একটি বিশেষ বিমানে লন্ডনে পৌঁছান। ওই দিন লন্ডনে পৌঁছে এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, ‘আমি আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।’
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। ওইদিন লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে তিনি ঢাকায় ফেরেন। ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর কমেট জেট বিমানে সকাল ৮টা বেজে ২ মিনিটে তিনি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে নামেন। দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুকে অভূতপূর্ব সংবর্ধনা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি যখন অবতরণ করে তখন বিমানঘাঁটিতে ভারতের ত্রিবর্ণরক্ষিত জাতীয় পতাকা ও বাংলাদেশের সবুজ পটভূমিকায় লাল ও সবুজ রঙের জাতীয় পতাকা উড়ছিল। সেনাবাহিনীর ব্যান্ডে দুই দেশের জাতীয় সংগীত ‘জনগণ মন’ ও ‘সোনার বাংলা’ বাজতে থাকে। তার আগমনের পরে ভারতীয় স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর ১৫০ জনের সম্মিলিত দল গার্ড অব অনার পরিদর্শন করে। বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’, ‘জয় হিন্দ’ ধ্বনি দিয়ে তার প্রীতিভাষণ শেষ করেন। কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরিচয়পর্ব শেষ হওয়ার পর শেখ মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্যারেড গ্রাউন্ড অভিমুখে যাত্রা করেন।
প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও হাজার হাজার নর-নারী পথের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থেকে ‘জয় বাংলা’ ও ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানান। বিমানঘাঁটি থেকে দুই কিলোমিটার দূরে প্যারেড গ্রাউন্ডে যখন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে শেখ মুজিব এসে পৌঁছান তখন মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখর হতে থাকে। বাংলাদেশের স্রষ্টার ভাষণ শোনার জন্য সমবেত হাজার হাজার নর-নারীর কণ্ঠে শুধু ‘মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শোনা যায়। বিমানঘাঁটিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, চেকস্লোভাকিয়া, মঙ্গোলিয়া, পূর্ব জার্মানি, ভুটানসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
দেশে ফেরার আগে দিল্লি বিমানবন্দরে রাখা সংক্ষিপ্ত সেই ভাষণ শুরুর সময়ে বিদেশের মাটিতে বক্তৃতার কারণে রীতি অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু ইংরেজিতে ভাষণ শুরু করেন। তিনি ‘ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান’ বলে তার বক্তৃতা শুরু করতেই জনতা বঙ্গবন্ধুকে বাংলায় ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ জানান। স্বাধীন বাংলার পাশে থাকা ভারতীয় জনগণ শুনতে চাইলেন স্বাধীন বাংলার রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখে বাংলায় উচ্চারিত ভাষণ। ভারতীয় জনতার ওই দাবি শুনে স্মিত হেসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাতেই ভাষণ দেওয়ার অনুরোধ জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও। জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি তখন বাংলায় তার ভাষণ দেন। দিল্লি বিমানবন্দরে রাখা সংক্ষিপ্ত ভাষণে বাংলাদেশের জনগণ ও তার জন্য অকুণ্ঠ সমর্থন দেওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনগণের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
সেদিনের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের সরকার, সেনাবাহিনী এবং ভারতীয় জনসাধারণের সর্বাত্মক সাহায্য ও সহানুভূতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছিলেন- ‘ …আমি সকল প্রকার সাহায্য সহানুভূতি আশা করি এবং এও আশা করি, দুনিয়ার শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক যে মানুষ আছে তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষকে সাহায্য করার জন্য।’ বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি সেক্যুলারিজমে, আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি সোশ্যালিজমে। আমাকে প্রশ্ন করা হয়, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আপনার আদর্শে এত মিল কেন? আমি বলি, এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষ্যত্বের মিল, এটা বিশ্বশান্তির মিল।’
১০ জানুয়ারি ভারতীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ বিমানে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণের পর সেখান থেকে জনতার ভিড় ঠেলে তাকে বহনকারী খোলা ট্রাকটি তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছতে আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছিল। রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছে আবেগাপ্লুত বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যারা বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের আত্মার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। লক্ষ মানুষের প্রাণদানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও। আমার বাংলায় আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। খেয়ে পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালিরা একবারই মরতে জানে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের কাছে নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাবার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। তাদের আরও বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।’
দেশে ফেরার আগে লন্ডন ও দিল্লিতে বঙ্গবন্ধুর যাত্রাবিরতি ও ঘটনাবলি ইতিহাসের অনবদ্য অধ্যায়। দেশে ফিরেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন তিনি। সেখানেও এই বাংলার সাধারণ মানুষকে নিয়েই শুরু হলো তার নতুন লড়াই। কিন্তু যে বাঙালির কাছে প্রাণের আবেগ নিয়ে তিনি ফিরে আসতে পারলেন, সেই জাতি তাদের মুক্তিদাতা প্রাণের মুজিবকে রক্ষা করতে পারল না। বিশ্বাসঘাতক কুচক্রীদের দ্বারা দেশ স্বাধীনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় তিনি সপরিবারে নিহত হলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবারও পাকিস্তানি ভাবাদর্শে পেছনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ। তারপর দীর্ঘ সামরিক-বেসামরিক দুঃশাসনের কাল পার করে আজকে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বিশ্ববাসীর কাছে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
আব্দুর রহমান
সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ
সমকাল, ১০ জানুয়ারি ২২ লিঙ্ক