যুবক-বয়সে-বঙ্গবন্ধু

উন্নত দেশ, শান্তির মানুষ ও বঙ্গবন্ধুর ভাবনা

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

‘কেমন বাংলাদেশ চাই’ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টিভি ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।

‘বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনের বীজ রোপিত হয়েছিল স্বাধীনতার আগে। যখন উত্তাল পূর্ববাংলা জেগে উঠেছিল নিজেদের অধিকার আদায়ে মিছিলে মিছিলে রাজপথ উত্তপ্ত করে, তখনই বঙ্গবন্ধু পেশ করেন তার ঐতিহাসিক ছয় দফা। এই ছয়দফাই বস্তুত বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনের উর্বর বীজতলা। তারও আগে নতুন চীনের তৃতীয় জন্মবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধুর বাংলা ভাষায় প্রদত্ত ভাষণের মাধ্যমে প্রকটিত ও প্রকাশিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের উষ্ণ প্রস্রবণ তার উন্নয়ন দর্শনের অঙ্কুরোদগমে জাগিয়ে তোলে প্রাণ। ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত বিলের মাধ্যমে জন্ম নেওয়া চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থার ইতিহাসেই লেগে আছে বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন-দর্শনের সূচনা-পদক্ষেপ। তাই বলা যায়, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের উন্নয়ন-দর্শন ১৯৫০ হতে ১৯৭০ শেখ মুজিবের প্রাজ্ঞ চেতনায় উন্মেষকাল অতিক্রম করে যা পরবর্তী সময়ের অভিজ্ঞতা ও সময়ের সম্ভাবনা গায়ে মেখে আরও নিরেট এবং নিখাদ হয়ে উঠে।

১৭ মার্চ ১৯২০ সালে বাংলার স্বাধীন রক্তিম সূর্যের অভ্যুদয় ঘটে, ১৭ মার্চ যেন বাংলার স্বাধীন রক্তিম সূর্যের উদয়। বঙ্গবন্ধুই বাঙালির স্বাধীনতার মহানায়ক। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার জন্ম না হলে বিশ্বের মানচিত্রে আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেতাম না।

সারা পৃথিবীর সর্বমহলের কাছে অন্যতম গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যম বিবিসি ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের দিন তাদের নিজস্ব জরিপ পদ্ধতি ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে ঘোষণা করে।

মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। তিনি বাংলাদেশের জনগণকে নিজ সন্তানের মতোই ভালোবাসতেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের ‘আপনার সবচেয়ে বড় যোগ্যতা কী’ এ প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি।’ ডেভিড ফ্রস্টের ‘আপনার বড় দুর্বলতাটা কী’- এ প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে বেশি ভালোবাসি।’

এ কথার মাধ্যমে জনগণের প্রতি জাতির পিতার অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের প্রতি বিশ্বাসেরও বিষয়টিও সুস্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুর সমগ্র জীবনটাই ছিল যেন মানুষকে ভালোবাসার। দেশকে ভালোবাসতে হবে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে, এটা ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের অন্যতম দর্শন।

বঙ্গবন্ধু গড়তে চেয়েছিলেন সুস্থ সবল, বৈষম্যহীন জ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধু তারই উদ্ভাবিত ওই উন্নয়ন দর্শন বাস্তবে রূপ দিতে অন্যতম মৌল-উপাদান হিসেবে সমবায়ের অন্তর্নিহিত শক্তি পুরোমাত্রায় ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। আর সে কারণেই মালিকানার নীতি বিষয়ে সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হলো গুরুত্বক্রম অনুসারে রাষ্ট্রে মালিকানা ব্যবস্থা হবে : প্রথমত, রাষ্ট্রীয় মালিকানা; দ্বিতীয়ত, সমবায়ী মালিকানা এবং তৃতীয়ত, (নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে) ব্যক্তিগত মালিকানা। বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখতেন গ্রামীণ সমাজে সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশের প্রতিটি গ্রামে গণমুখী সমবায় সমিতি গঠন করা হবে, যেখানে গরিব মানুষ যৌথভাবে উৎপাদন যন্ত্রের মালিক হবেন; যেখানে সমবায়ের সংহত শক্তি গরিব মানুষকে জোতদার-ধনী কৃষকের শোষণ থেকে মুক্তি দেবে; যেখানে মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা গরিবের শ্রমের ফসল আর লুট করতে পারবে না; যেখানে শোষণ ও কোটারি স্বার্থ চিরতরে উচ্ছেদ হয়ে যাবে।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ, বয়স-পেশা নির্বিশেষে সব মানুষের সুযোগের সমতার অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শনে নীতি-নৈতিকতার নিরিখে সব মানুষ মানুষ হিসেবে সমান। যে কারণে ’৭২-এর সংবিধানে জনগণই প্রজাতন্ত্রের মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সমাজতন্ত্রের কথা স্পষ্ট করেছেন তিনি- যা রাষ্ট্রের মালিকানায় শিল্প ও কৃষির সমবণ্টন, রাষ্ট্র কর্তৃক সবার খাদ্য নিশ্চিতকরণের উপায় হিসেবে অনুসৃত হতো। যদিও বঙ্গবন্ধু নিজে কোনো কমিউনিস্ট ভাবধারার ছিলেন না, তবুও তিনি অনুধাবন করেছিলেন শ্রমিক শ্রেণির উন্নয়নের জন্য, সমাজতন্ত্রের প্রতিফলন তার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ঘটাতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার বিষয়ে জোড় দিয়েছিলেন- যার মূলনীতি হলো ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার। এর মাধ্যমে সব ধর্মের মানুষের মধ্যে একটা সমপ্রীতির বন্ধন তৈরি করার প্রয়াস আছে, যাতে উন্নত দেশ গঠনের কাজে সবাই এক হয়ে কাঁধে কাঁধ মেলাতে পারে।

বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ করা হয়েছিল।

এটি ছিল রাজনৈতিক বিভ্রান্তির এক সর্বোত্তম উদাহরণ। জেনারেল আইয়ুবের পরিকল্পনা ছিল, ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানকে ভাগ করা হচ্ছে, এমন অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করা। সে লক্ষ্যে সরকার নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি গণমাধ্যম প্রতিদিনই এ জাতীয় খবর প্রকাশ করছিল, যাতে দেশের সাধারণ মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। সে সময় রেডিও ও টেলিভিশন সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ছিল।

তিনি এমন একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক মহাকাব্য নির্মাণ করে গেছেন, লাখো বাঙালি শুধু যার স্বপ্নই দেখতেন। এমন স্বপ্ন যে সত্যি হতে পারে, সাধারণের পক্ষে তা বিশ্বাস করা ছিল কঠিনতর। যেহেতু শেখ মুজিব ছিলেন মানুষের মনের নেতা, অন্তরের মানুষ তাই মামলায় তাকে আটকানো গেল না সর্বস্তরের জনগণ এই মামলার সঙ্গীসহ শেখ মুজিবকে মুক্ত করে আনলেন।

পিতার দেওয়া উন্নয়ন-দর্শন বাস্তবায়নে তার প্রিয় কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা বদ্ধপরিকর। তার যোগ্য ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বনেতাদের কাছে পেয়েছে সমীহ এবং জাতির জনকের কন্যা তার পিতার উন্নয়ন-দর্শন বাস্তবায়ন করে আজ বিশ্বের একজন প্রভাবশালী নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা ও স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিশ্বের মুক্তিকামী নিপীড়িত মেহনতী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। শান্তি, সাম্য, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। জেল, জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন সহ্য করেছেন।

বিশ্ব শান্তি পরিষদের শান্তিপদক জাতির পিতার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ।

এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, আন্তর্জাতিক সম্মান। তার এই পদকপ্রাপ্তি সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশকে অন্যান্য রাষ্ট্র, জাতিসংঘসহ বিশ্ব সংস্থার কাছ থেকে স্বীকৃতি ও সদস্য পদ লাভ ত্বরান্বিত হয়েছিল। আজকের এই দিনে একবুক শ্রদ্ধা নিয়ে স্মরণ করি পিতা তোমাকে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। ওই দিন ভোর রাতে ঘতকরা সপরিবারে হত্যা করে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। এমনকি তার শিশুপুত্র শেখ রাসেলকেও তারা রেহাই দেয়নি। আজও সেদিনের সেই নৃশংস হত্যাকা-ের কথা ভুলতে পারেনি বাংলার জনগণ। বঙ্গবন্ধু আজ তার প্রিয় কন্যা শেখ হাসিনার কাছেই অধিক নিরাপদ এবং অধিক সুসংহত।

ডা. আরিফ যোবায়ের,
সদস্য, যুব ও ক্রীড়া উপকমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ

আলোকিত বাংলাদেশ ২৫ মে, ২০২১ লিঙ্ক 

আরও পড়ুন