‘আব্বা, বালি চলো’

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

বয়স মোটে আড়াই বছর। এই বয়সে কেউ জেলখানা বোঝে না। ছোট্ট রাসেলও বুঝত না। বাবাকে এত ঘন ঘন জেলে থাকতে হয়েছে যে জেলখানাকেই ধরে নিয়েছিল বাবার বাড়ি। ষাটের দশকের একটা বড় অংশ কারাগারে থাকার কারণে নিজের সন্তানদের বেড়ে ওঠাটা পর্যন্ত দেখতে পারেননি বাবা শেখ মুজিব। আমৃত্যু এই আক্ষেপ তাঁকে যন্ত্রণা দিয়েছে

বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে, সুযোগ পেলেই দেখা করতে আসতেন পুত্র-কন্যা ও সহধর্মিণী। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তাঁদের

kalerkanthoদেখা করতে আসার মর্মস্পর্শী বর্ণনা পাঠকের মন আর্দ্র করে বারবার। বিশেষ করে শিশু রাসেলের ‘আব্বা আব্বা!’ ডাক যেন কানে বাজতেই থাকে। কারাগারে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়াটা রাসেলের কাছে ছিল উত্সবের মতো।

‘আব্বা, আব্বা’ চিৎকারে সেই উচ্ছ্বাস বঙ্গবন্ধুর অন্তরে যে তীরের মতো বিঁধত, যেকোনো বাবাই তা উপলব্ধি করতে পারবেন। বাড়িতে কী করছে না করছে, কার কার বিরুদ্ধে নালিশ, ঈদে কী খেলনা চায়—সবই বাবা শেখ মুজিবকে শুনতে হতো কারাগারের বিষণ্ন দেয়ালের মাঝে, বুকভরা হাহাকার চেপে, হাসিমুখে। জীবনীতে আবেগের বর্ণনাটা হয়তো চেপে গেছেন ইচ্ছার বিরুদ্ধেই। তথাপি ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়ে ভেতরের পিতৃত্বের হাহাকার কে না শুনতে পাবে!

পুত্র-কন্যাদের কাছে না পাওয়ার এই আক্ষেপ, চোখের সামনে তাদের স্কুলে যাওয়া, বায়না, খেলাধুলা—এসব দেখতে না পারার আক্ষেপ খুব বিচলিত করত শেখ মুজিবকে। তাই রোজনামচায় পরিবারের সঙ্গে কোনো সাক্ষাতের বর্ণনাই বাদ যায়নি।

আধাঘণ্টার উষ্ণতা

বয়স আড়াই হলে কি হবে, বাবাকে না দেখা পর্যন্ত রাসেলের মুখে হাসি নেই। দেখা করার কক্ষটি ছিল ছোট। পাশে অষ্টপ্রহর প্রহরী। সময় মোটে আধাঘণ্টা। প্রতিটি সেকেন্ড পিতৃস্নেহ উপচে দেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা বঙ্গবন্ধুর। সব বাচ্চাকে চুমু খেতেন তিনি। মন তো কারোরই ভরে না। জেলের নির্ধারিত জায়গায় বাবা না আসা পর্যন্ত ছোট্ট রাসেল পুরো সময়টা জানালার দিকে তাকিয়ে থাকত অপলক। তাকে বোঝানো হলো, কারাগারটাই বাবার বাড়ি। বাবাকে এখানেই থাকতে হবে। কী নির্মম সেই উপলব্ধি!

জেলবন্দি পিতার কাছে গেলে আর কাউকে পরোয়া করত না ও। একছুটে গলা ধরে ঝুলে পড়ত। তারপর আবার নেমে গিয়ে শুরু করত খেলা, অভিনয়। পোষা খরগোশটা কিভাবে দাঁড়াত, কিভাবে সেটা মরে গেল, কে কে তাকে মেরেছে—ফিরিস্তির শেষ নেই তার!

বাচ্চারা দেখতে চাইত কোথায় তিনি থাকেন। কিন্তু ভেতরে ঢোকার তো অনুমতি নেই। জবাবে মুজিব বলতেন, ‘বড় হও, মানুষ হও, দেখতে পারবা। ’

একাকী সঙ্গীবিহীন জীবনে ওই আধাঘণ্টাটুকু শেখ মুজিবের কাছে ছিল সাত রাজার ধন। বিদায়ের ঘণ্টা বাজলে চেঁচামেচি জুড়ে দিত রাসেল। নির্ঘাত তখন মুখ লুকিয়ে রাখত জেল কোড নামের বড্ড নির্দয় শব্দটা। বাবাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইত না। গাড়ির কথা বলে, উপহারের কথা বলে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে কোনো রকমে জেলখানা থেকে বের করে আনা হতো তাকে। বাবা বলতে এতই পাগল ছিল যে মায়ের কথাও শুনত না রাসেল।

একবার এসে রাসেলের আবদার, ‘আব্বা, বালি চলো’। দুঁদে রাজনীতিবিদ অসহায় এ কথার সামনে। উত্তর নেই কারো মুখে। বাবা বোঝান, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো। ’

আব্বার বাড়ি

কারাগারে ট্রাক আসা-যাওয়া করত। সেগুলো দেখলেই শিশু রাসেল ধরে নিত, তার বাবা আছে ভেতরে। আব্বার গাড়ি বলে চেঁচিয়ে উঠত। পরে ভুলও ভাঙত। জুড়ে দিত কান্নাকাটি। তারপর ফের প্রতীক্ষা। কখন আসবে ‘আব্বার গাড়ি’।

কড়াকড়ির মধ্যেও সন্তানদের সঙ্গে মাঝে মাঝে ঘণ্টাখানেকের জন্য দেখা করার অনুমতি মিলত। অন্তত দুই সপ্তাহ অন্তর। আর এতে একসময় অভ্যস্ত হয়ে মুজিব লিখেছেন, রাসেল প্রথম দিকে তার বাবার কারাগারজীবন নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করলেও পরে দেখা গেল সে মেনে নিয়েছে কারাগারেই তার পিতাকে থাকতে হবে, এখান থেকে মুক্তি নেই, এমনকি ঈদের দিনেও। কারাগারটা তাই তার কাছে ছিল ‘আব্বার বাড়ি’।

‘মারব! মারব!’

শিশু রাসেল ছিল অস্থির। ভীষণ চঞ্চল। দিন দিন দুরন্তপনা বাড়তে থাকে আরো। জেলখানায় এলেই শুরু হয় ছোটাছুটি। ঠিক যেন নিজের বাড়িতেই এসেছে। বাবা আছে যেখানে, সেখানে এমন দস্যিপনা তো করাই যায়। কখনো বাবার কোলে, কখনো মায়ের কোলে উঠে বসে। আবার কখনো নিজেই আপনমনে ঘুরে বেড়ায়। বোনদের ওপর, বিশেষ করে শেখ রেহানার সঙ্গে খুনসুটি লেগেই থাকত। রাগ উঠলে ঝাল মেটাত তার ওপরই। রেহানার অনুযোগ শুনে মুজিবের প্রশ্ন, ‘তুমি রেহানাকে মারো?’ রাসেলের অকপট উত্তর, ‘হ্যাঁ মারি তো!’ বাবা মুজিব মাথায় হাত বুলিয়ে বোঝান, ভবিষ্যতে এটা করা যাবে না। তখনো রাসেল চটপট বলে উঠত, ‘মারব! মারব!’ ‘কথা একটাও মুখে রাখে না,’ মুজিবের পর্যবেক্ষণ।

মা যখন আব্বা

একবার শেখ মুজিব অবাক। ছেলে কারাগারে এসেছে। কিন্তু বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কয়েকবার ‘আব্বা, আব্বা’ বলে আবার ছুটে গেল মায়ের কাছে। অভিমান করা শিখে গেছে তত দিনে। সবাই অবাক। বেগম ফজিলাতুন্নেছাকেই ‘আব্বা আব্বা’ বলে ডাকা শুরু করেছে রাসেল। জানালা দিয়ে আসা মুক্ত বাতাসও যেন হুট করে নীরব হয়ে গেল সেই ডাক শুনে। বাড়িতে রাসেল সারাক্ষণ ‘আব্বা, আব্বা’ বলে কাঁদে। বাধ্য হয়ে বেগম মুজিব তাই রাসেলকে বলেছেন, সে যেন এখন থেকে মাকেই ‘আব্বা’ বলে ডাকে। শেখ মুজিবের ওপর কপট রাগ দেখিয়ে রাসেল মুখ ঘুরিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে বলে, ‘তুমি আমার আব্বা। ’ শেখ মুজিবের মনে তখন ঠিক কতগুলো শেল আঘাত করেছিল, কে গুনবে সেটা!

রাসেলের মুখে স্লোগান

১৯৬৭ সাল। ছয় দফা নিয়ে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ফুলকি উড়তে শুরু করেছে। আব্বাকে একদিন দেখতে এসে রাসেল চমকে দিল সবাইকে। স্লোগান দিল ছয় দফার পক্ষে। ‘ছয় দফা মানতে হবে—সংগ্রাম, সংগ্রাম!’ শেখ মুজিব তো অবাক, ‘ও শিখল কোথা থেকে?’ আসলে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আর সাধারণ সম্পাদকের আগ্রহে খোদ শেখ মুজিবের বাসাতেই হয়েছিল ওই সভা। সেখানে কর্মীদের স্লোগান শুনে শিখেছে রাসেল। আড়াই-তিন বছরের বাচ্চার আধো আধো ওই বুলিই যেন তাত্ক্ষণিক একগাদা শক্তি জুগিয়েছিল শেখ মুজিবুর রহমানকে। মুখে অবশ্য বলেছিলেন, “আব্বা, আর তোমাদের দরকার নেই এই পথের। তোমাদের আব্বাই ‘পাপের’ প্রায়শ্চিত্ত করুক। ”

হায় ঈদ!

আইয়ুব খানের শাসনামল। শেখ মুজিব যথারীতি কারাগারে। ঈদটা মুজিব সাধারণত ছেলে-মেয়ে নিয়ে মায়ের কাছেই কাটাতেন। কারাবন্দি অবস্থায় ঈদের আগে আগে বন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে। সেই আশায় স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে, ছোট ভাই—সবাই এসেছিলেন কারাগারে। কিন্তু সরকারের কড়া নির্দেশ, ঈদে মুক্তি দেওয়া যাবে না মুজিবকে। সবাই বুঝলেও ছোট্ট রাসেল তো আর রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝে না। পিতা মুজিবেরও বুক ফেটে যায়। বিদায় নিতে হবে রাসেলের কাছ থেকে। নিরুপায় তিনি কাগজে কলম দিয়ে ঢেলে দেন বুকের কষ্টগুলো—‘দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখে নাই। ’

শেখ মুজিব রাজনীতির পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের যাবতীয় ব্যাপারেই নজর রাখতেন। ঈদের সময় নিজে কারাগারে থাকলেও বাচ্চাদের যেন কোনো কিছুর কমতি না হয় সে কথা বলতেন বেগম মুজিবকে। স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘বাচ্চাদের সব কিছু কিনে দিও। ভালো করে ঈদ করিও। না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে। ’ স্ত্রীর সঙ্গে আলাপচারিতায় বলেছেন, ‘চিন্তা করিও না, জীবনে বহু ঈদ আমাকে এই কারাগারে কাটাতে হয়েছে, আরো কত কাটাতে হয় ঠিক কি। ’

সেবার অন্যদের দেখাদেখি রাসেলও হাত তুলে বিদায় নিল। সম্ভবত তত দিনে তার মনটাও বাবার মতো দৃঢ় হতে শুরু করেছিল। ধরেই নিয়েছিল, বাবাকে জীবনভর এখানেই থাকতে হবে। আগে বাবাকে ঘরে নিয়ে যেতে চাইত, কিন্তু পরে বুঝে নিয়েছে যা বোঝার। সে আর বায়না ধরে না।

রাজনৈতিক পরিচয় আর ইতিহাসের আড়ালে মানুষ বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভাবা হয় না অনেকের। কারাগারে থাকার সময় শেখ মুজিব আর শেখ রাসেলের এই বন্ধন চিরায়ত পিতা-সন্তানের সম্পর্ককে হৃদয়ে দাগ কেটে দেখিয়ে দেয়। অন্য সন্তানরা বড় হয়েছে, তাদের পড়াশোনার খবর রাখতেন নিয়মিত। গলা ধরে ঝোলার মতো বয়সে না থাকলেও তাদের প্রতি স্নেহ কি আর এতটুকু কমে!

গ্রন্থনা : অমর্ত্য চৌধুরী

সূত্র : শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’

কালের কণ্ঠ, ১৩ জানুয়ারি, ২০২০ লিঙ্ক 

আরও পড়ুন