বারট্রান্ড রাসেলের দারুণ ভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছাছাও। তাই সবার ছোট ছেলের নাম রেখেছিলেন রাসেল। তাদের বিশ্বাস ছিল রাসেলের মধ্যে তারা দেখতে পাবেন বিশ্ব শান্তির এক নেতাকে।
জন্মের অনেক আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল তার নাম রাখা হবে রাসেল। বঙ্গবন্ধু খুব শখ করে তার অনাগত সন্তান যদি ছেলে হয়, তাহলে তার জন্য এই নাম ঠিক করে রেখেছিলেন। ছেলের নামের মধ্যে প্রকাশ হবে বিশ্ব শান্তির বার্তা। তিনি নিজেও চিরকাল ছিলেন শান্তির পক্ষে। ঋতু পরিক্রমায় তখন বাংলার ঘরে ঘরে উঁকি দিচ্ছে নবান্নের আমেজ। একদিকে আবহমান বাংলার প্রকৃতিতে পাকা ফসলের ঘ্রাণ অন্যদিকে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চলছে আন্দোলন, সংগ্রামের প্রবল ঢেউ। চারদিকে প্রতিবাদ ফুঁসে উঠছে। তারা দেশে শান্তি চায়- তারা দেশে স্থিতিশীলতা চায়। বঙ্গবন্ধু নিজেও শান্তি আর স্থিতির পক্ষে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তার সেই আহ্বানে সাড়া দিতে নারাজ- তারা দেশে একটা অরাজক পরিবেশ তৈরি করে বিশৃঙ্খল অবস্থা জিইয়ে রাখতে চায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, এদের সঙ্গে বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়। তাই বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের জন্য একটা সুখী, সুন্দর আর শান্তির দেশ তৈরির স্বপ্ন দেখছিলেন। তার ধ্যানে, চিন্তায় আর স্বপ্নে বাঙালির জন্য পৃথক একটি রাষ্ট্র- যেখানে সব ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুখে-দুঃখে পাশাপাশি থাকবে। আর এটা সম্ভব কেবল শান্তির মধ্য দিয়ে।
রাসেলের জন্মের বছরখানেক আগে কিউবাকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলছিল স্নায়ুযুদ্ধ। সেই স্নায়ু যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে দেশে। কোথাও শান্তি নেই। বিশ্ব তখন অবধারিতভাবে অগ্রসর হচ্ছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে। চারদিকে তখন এক বৈরী পরিবেশ- দেশে দেশে যুদ্ধের দামামা বাজছে। এমন সময় বিশ্ব মানবতার প্রতিভূ হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেল। রাসেল শুধু দার্শনিকই ছিলেন না- ছিলেন পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতাও। রাসেল বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিশ্বের বাঘা বাঘা নেতাদের নিয়ে গঠন করলেন ‘কমিটি অব হানড্রেড’। এর মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধের শঙ্কা কমে গেল। বিশ্বের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন দার্শনিক রাসেলের দারুণ ভক্ত। বেগম ফজিলাতুন্নেছাও স্বামীর মতো রাসেল ভক্ত ছিলেন। রাসেলের দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি আর বিশ্বমানবতার নানা দিক তাকেও আন্দোলিত করেছিল- তাই তারা দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেদের আসন্ন সন্তান যদি ছেলে হয় তাহলে তার নাম রাসেলের নামে রাখবেন। তাদের বিশ্বাস ছিল রাসেলের মধ্যে তারা দেখতে পাবেন বিশ্ব শান্তির এক নেতাকে।
১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর- হেমন্তের একদিন, ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরের নিচতলায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, বড় বোন শেখ হাসিনার ঘরে পৃথিবীর সব আলোকে ম্লান করে শিশু রাসেল পৃথিবীতে নেমে এলো। যেন স্বর্গ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ প্রসারিত হয়ে নেমে এলো বঙ্গবন্ধুর সংসারে। বাবা-মা, ভাই-বোনের সংসারে আনন্দের হিন্দোল খেলা করতে শুরু করল। সবাই শিশু রাসেলকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠল। সংসারে সবার ছোট হওয়ায় একতরফা ভালবাসা আর আদরের ছিল রাসেল। বাবা, মা, ভাইবোন- সবার একচ্ছত্র আদরের ধন ছিল রাসেল।
বঙ্গবন্ধুর দুই চোখের মণি ছিল রাসেল। তিনি যতটুকু সময় ঘরে থাকতেন রাসেলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতেন। রাসেলের সঙ্গে কথা বলতেন, গল্প করতেন। রাসেল গল্প শুনতে খুব পছন্দ করত। বঙ্গবন্ধু সব সময় রাসেলের আবদার রাখার চেষ্টা করতেন। বঙ্গবন্ধু ঘরের সবাইকে ডেকে বলতেন, শোন, রাসেল যা বলবে তোমরা সেটা মেনে চলবে। রাসেলকে কখনোই কষ্ট দেবে না তোমরা।
ছোট্ট রাসেল সব সময় বাবাকে কাছে পায় না। পাবেই বা কোত্থেকে! বাবাকে যে রাজনীতির কারণে বেশিরভাগ সময় ঘরের বাইরে কাটাতে হয় নতুবা জেলে থাকতে হয়। আর এ কারণে মা ফজিলাতুন্নেছা বেগমকে বাবা বলে ডাকে সে। শিশু রাসেলের কাছে বাবা যখন বাইরে কিংবা জেলে থাকে তখন মা’ই তার বাবা।
দুই
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী নেতা। রাজনীতি গবেষকরা প্রায় সময়ই এ কথা বেশ জোর দিয়েই বলেন বঙ্গবন্ধু নাকি আগে থেকে সব কিছু বুঝতে পারতেন। এ কথা যদি সত্য হয়, তাহলে খুব বলতে ইচ্ছে করে, তবে কি বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় বুঝতে পেরেছিলেন সব কিছু! না হলে এভাবে কেন সবাইকে বলবেন, তোমরা রাসেলকে কষ্ট দেবে না!
রাসেল জন্মের দু বছর পরের ঘটনা। ১৯৬৬ সাল। বঙ্গবন্ধু তখন ছয় দফা আন্দোলনে রাজবন্দী হিসেবে জেলে। বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় ছোট ছেলেকে কাছে না পাওয়ার তীব্র বেদনা বঙ্গবন্ধু ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার লেখার ভেতর দিয়ে। রাসেলকে কতটা আদর করতেন তিনি, সেটা লেখার সেই অংশ পড়লেই অনুভব করা যায়। ছোট্ট রাসেল কি আর অত শত বোঝে! সে তার বাবাকে দেখতে জেলখানায় গেছে। জেলখানা কী জিনিস সেটা তার বোঝারও কথা না। জেলখানায় বাবাকে দেখতে গিয়ে রাসেল বাবার কাছে বায়না ধরত, বাবা, চলো বাড়িতে।
শিশু রাসেলের মনে হয়েছে, জেলখানা আর ঘরবাড়ি বুঝি একই জিনিস। বঙ্গবন্ধু রাসেলের সেই অনুভূতিকে তার জাদুমাখা গদ্যে অসাধারণ মমতায় তুলে ধরেছেন যা পাঠ করলে চোখের অশ্রু ধরে রাখা কঠিন। বঙ্গবন্ধু লিখছেন- ‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, ‘‘আব্বা বাড়ি চলো’’। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো’’। ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’
তিন
বঙ্গবন্ধু খুব আদর করতেন রাসেলকে। বাবার সেই আদর বেশি দিন রাসেলের ভাগ্যে জোটেনি। উনিশশ পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট আগস্টের মধ্যরাতে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি পাকিস্তানি প্রেতাত্মা-হায়েনারা নৃশংসভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ধানমান্ডির বত্রিশ নম্বরের বাড়িতে। তারা সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা করেছিল। সেদিন এই বিশ্বাসঘাতকের দল বাংলাদেশকে শুধু অন্ধকার পথে ধাবিত করেছিল তা নয়, তারা সেদিন বিশ্বশান্তি আর মানবতাকেও ভূলুণ্ঠিত করেছিল। সেদিন বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি নিয়ে ছোট্ট রাসেল ঘাতকদের কাছে আশ্রয় চেয়েছিল- তারা তাকে সেই আশ্রয় দেয়নি। শিশু রাসেলের নিষ্কলুষ, কোমল দেহকে সেদিন ঘাতকেরা বুলেটে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি হাসু আপার কাছে যাব-’ শিশু রাসেলের ভালবাসার এই আর্তিকেও সেদিন স্তব্ধ করে দিয়েছিল নিষ্ঠুর জল্লাদরা।
মাহবুব রেজা: শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
নিউজ বাংলা ২৪, ১৮ অক্টোবর, ২০২০ লিঙ্ক