বঙ্গবন্ধুর এখন এজেন্ডা কী হতো?

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর দেখেইবা জাতির পিতা কী বলতেন? বাংলাদেশ শুধু গোটা দেশকে এক সূত্রে গাঁথেনি, বিশ্বের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করেছে নিজেকে। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যদি তিনি যেতে পারতেন পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে? বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে তিনি ঘুরেছেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। মানুষকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন স্বাধীনতার মন্ত্রে। তাকে হত্যা করে স্বাধীনতার ধারা থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে আনার অপচেষ্টা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান এইচএম এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ও মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশকে প্রায় তিন দশক পিছিয়ে দিয়েছে।

করোনায় বিপর্যস্ত গোটা বিশ্ব। রাজনীতি, অর্থনীতি-সমাজ ও পরিবার- সবখানেই এ ভয়ংকর ব্যাধির ছোবল। কেবল বাংলাদেশেই প্রায় পাঁট কোটি ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন বিপন্ন। বঙ্গবন্ধুকন্যা অর্থনীতিতে ধস নামতে দেননি, বরং এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বেশি গতিশীল রাখতে পেরেছেন। আমাদের কৃষকরা করোনার বছরেও চার কোটি টনের বেশি চাল-গম-ভুট্টা ঘরে তুলেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪ হাজার ছয়০০ কোটি ডলারের বেশি। রপ্তানি বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি হারে। ২ কোটির বেশি মানুষ করোনার প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন নিয়েছে। দুই ডোজ পেয়েছে ৫০ লাখের বেশি মানুষ। চীন থেকে ভ্যাকসিন উপকরণ এনে বাংলাদেশে প্রসেস করার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে।

এমন কঠিন সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে সামাল দিতেন? তিনি ষাটের দশকে ছয় দফা কর্মসূচি দিয়ছিলেন, যা ছিল স্বাধীনতারই নামান্তর। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদরা বলেন, বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাড়ি-কমাও বাদ দিতে রাজি ছিলেন না। পাকিস্তানিরা সেটা বুঝে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুও জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে পাকিস্তানের অর্থনীতির তুলনায় সব গুরুত্বপূর্ণ সূচকে বাংলাদেশ অনেক ভালো অবস্থানে। অথচ ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় সে সময়ের পশ্চিম পাকিস্তান ছিল অর্থনীতিতে দ্বিগুণের বেশি শক্তিশালী।

বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর দেখেইবা জাতির পিতা কী বলতেন? বাংলাদেশ শুধু গোটা দেশকে এক সূত্রে গাঁথেনি, বিশ্বের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত করেছে নিজেকে। নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যদি তিনি যেতে পারতেন পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে? বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে তিনি ঘুরেছেন পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে। মানুষকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন স্বাধীনতার মন্ত্রে। তাকে হত্যা করে স্বাধীনতার ধারা থেকে বাংলাদেশকে সরিয়ে আনার অপচেষ্টা হয়েছিল। জিয়াউর রহমান এইচএম এরশাদ এবং খালেদা জিয়া ও মতিউর রহমান নিজামী বাংলাদেশকে প্রায় তিন দশক পিছিয়ে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই বাংলাদেশকে নতুন উচ্চতায় তুলে ধরতে পেরেছেন। বঙ্গবন্ধু যদি এমনটি দেখতে পেতেন!

শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মূল্যায়ন করতে গিয়ে অধ্যাপক নুরুল ইসলাম লিখেছেন-

“প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েও তিনি মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাশাপাশি স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা এবং সেইসঙ্গে বিভিন্ন ধরনের বিরোধী পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা সহজ কাজ ছিল না। দৃঢ় আত্মবিশ্বাস, দক্ষতা ও নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেই চেষ্টাই করেছিলেন।” [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : কাছ থেকে দেখা, পৃষ্ঠা ৯৬]

বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তিলাভ করেন। এর কিছুদিন পর অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম তার “অর্থনৈতিক নীতিমালা রচনা ও সেসবের ব্যাখ্যা দান করা’ টিমের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি লিখেছেন, যেকোনো জটিল নীতি-সংক্রান্ত বিষয় তিনি খুব দ্রুত ধরে ফেলতে ও উপলব্ধি করতে পারতেন। কীভাবে কাজটি করতে হবে, সে সিদ্ধান্তও নিতে পারতেন।” [পৃষ্ঠা ৯২]

এমনই একটি বিষয় ১৯৯০ সালের মার্চ মাসে জেনেছিলাম খ্যাতিমান আইনজীবী ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন এবং ১৯৭৫ সালে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের কাছ থেকে। সিলেটের হরিপুর তেলক্ষেত্র উন্নয়নের ভার রাষ্ট্রপতি এরশাদ দেন ‘সিমিটার’ নামের একটি বিদেশি কোম্পানিকে। এর পরিবর্তে এ দায়িত্ব বাপেক্সকে অর্পণের দাবি নিয়ে ঢাকা-সিলেট পদযাত্রা শেষে যুব ইউনিয়ন একটি গণতদন্ত কমিশন গঠন করেছিল। দুজনেই ছিলেন তার সদস্য। ড. কামাল হোসেনের বাসায় কমিশনের বৈঠকে হাবিবুর রহমান কীভাবে বঙ্গবন্ধু শেল ওয়েল-এর গ্যাসক্ষেত্রের মালিকানা বাংলাদেশের অধীনে নিয়ে আসেন, সেটা বলেন এভাবে- শেল ওয়েল-এর লিজ ১৯৭৫ সালের আগস্টের প্রথমদিকে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু তারা বাংলাদেশ সরকারের কাছে লিজ নবায়নে আবেদন করেনি। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে অবগত করার পর সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাবিবুর রহমানসহ পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ‘লুকিয়ে’ পড়তে বলেন, যাতে শেল ওয়েল সময়মতো লিজ নবায়ন করতে না পারে। সে সময় বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম চড়া ছিল। ৯ আগস্ট (১৯৭৫) বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন- শেল ওয়েল-এর মালিকানাধীন পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র এবং তিতাস গ্যাস কোম্পানির মালিক আজ থেকে বাংলাদেশ।

এইচটি ইমাম ‘বাংলাদেশ সরকার : ১৯৭১-৭৫’ গ্রন্থে লিখেছেন, শেল ওয়েল কোম্পানিকে কিছু ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হয়, যার পরিমাণ ছিল ১৮ কোটি টাকারও কম। কিন্তু ২০১০ সালে এ সব গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন করা ও ভবিষ্যতে উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের মূল্য নিরূপণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। [পৃষ্ঠা ১৩৫]

খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. জিল্লুর রহমান খান লিখেছেন, ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে ঘাতকরা উদ্যত মারণাস্ত্র নিয়ে তার সামনে এলে বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, “যদি বাঙালিরা তাদের জাতির পিতাকে হত্যা করতে চায়, তিনি জীবন দিতে প্রস্তুত রয়েছেন। কিন্তু এর পরিণতি বাঙালিদের জন্য শুভ হবে না। তাদের জীবন কখনোই আগের মতো হবে না এবং তাকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে গণতন্ত্রকেও তারা হত্যা করবে এবং মানবিকতা বিদায় নেবে।” [বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সম্মোহনী নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার সংগ্রাম, পৃষ্ঠা ২৬১]

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে প্রাচুর্যের দেশ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ত্রিশ লাখ নারী-পুরুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ সম্পর্কে চরম তাচ্ছিল্যপূর্ণ ও অপমানসূচক মন্তব্য করেন- Bangladesh is an International Basket Case.-এর জবাব প্রদানের জন্য তিনি ওয়াশিংটনকেই বেছে নেন। ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন-

“ওয়াশিংটনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেউ কেউ বাংলাদেশকে International Basket Case বলে উপহাস করেন। কিন্তু বাংলাদেশ Basket Case নয়। দুই শ’ বছর ধরে বাংলাদেশকে লুট করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্পদেই শ্রীবৃদ্ধি করা হয়েছে লন্ডন, ডান্ডি, ম্যাঞ্চেস্টার, করাচি, ইসলামাবাদের।… আজও বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্পদ রয়েছে। একদিন আমরা দেখাবো বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।” [পৃষ্ঠা ১৯০]

বাংলাদেশে শিল্প খাত শক্তিশালী হচ্ছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান বাড়ছে। ২০২১ সালের ৩০ জুন ব্যাংকগুলোতে জমা অর্থের পরিমাণ ছিল অন্তত ১৪ লাখ কোটি টাকা। এক কোটি টাকা বা তার বেশি অর্থ জমা আছে এমন বেসরকারি অ্যাকাউন্ট ছিল প্রায় ১ লাখ। ২০০০ সালে ‘ব্যাংকিংয়ের তিন দশক’ নামে একটি বই লিখি, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র উল্লেখ করে বলেছি- ব্যাংকগুলোতে এক কোটি টাকা বা তার বেশি জমা আছে ১৮ শ’ অ্যাকাউন্টে। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কত- এ ঘরের সামনে লেখা ছিল- ‘শূন্য’। এখন করোনাকালে রিজার্ভ ৪ হাজার ছয় শ’ কোটি ডলার।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা অর্থনীতির সঙ্গে যুক্তদের জন্য প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছেন। এর বড় অংশ দেয়া হবে সহজ শর্তে, নামমাত্র সুদে ব্যাংক ঋণ হিসেবে। কিন্তু সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডি ব্যাংকিং কর্মকাণ্ডে যুক্তদের শঙ্কা উল্লেখ করে ৩ আগস্ট বলেছে- “ঋণের একটি অংশ উৎপাদনশীল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিবর্তে অন্য খাতে, এমনকি শেয়ার বাজারে খাটানো হতে পারে। কেউ কেউ ঋণ আদৌ ফেরত দেবেন না।”

এ বিষয়ে সতর্ককতা অবশ্যই কাম্য। বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছেন, এ দেশের কৃষক-শ্রমিকরা দুর্নীতি করে না। তারা মুক্তিযুদ্ধে বিপুল অবদান রেখেছে। শ্রমে-ঘামে স্বদেশ গড়ে তুলছে। প্রবাসে যেসব কৃষক পরিবারের সন্তান গিয়েছে, তারা রক্ত জল করা অর্থ দেশ পাঠায়। অপরদিকে মুষ্টিমেয় লোক রপ্তানি করা পণ্যের সব বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনে না। আমদানির নামেও অর্থপাচার করে। এদের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি সতর্ক হবেন?

বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, যার চার কর্মসূচির একটি ছিল দুর্নীতির মূলোৎপাটন। করোনাকালেও যারা স্বাস্থ্যসেবা খাতে গুরুতর অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িত কিংবা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান-চাল ও সবজি কিনে চড়া দামে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা করছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিতে চাইতেন বঙ্গবন্ধু? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন প্রায় ৫ কোটি ছাত্রছাত্রী, এদের মধ্যে ২ কোটির বেশি ছাত্রী।

১৯৭১ সালে তিনি বলেছিলেন, নির্যাতিত নারীরা যেন সন্তানের পিতৃপরিচয় দেয় ‘শেখ মুজিবুর রহমান’। নারী শিক্ষার প্রসার এবং দেশের শিল্প খাতের শ্রমিককের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠই নারী, এ চিত্র তার জন্য অশেষ আনন্দ নিয়ে আসত, সন্দেহ নেই। করোনাকালেও রপ্তানি বেড়েছে ১৫ শতাংশ। কিন্তু যে শিল্পের প্রাণ নারী, তাদের ধনবানরা নানাভাবে যে কষ্ট দিচ্ছে, তিনি এর প্রতিকারে কী পদক্ষেপ নিতেন?

১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুসহ যাদের হত্যা করা হয়েছে, বিনম্র শ্রদ্ধা তাদের প্রতি। তাদের আত্মদান বৃথা যায়নি। ঘাতকরা রেহাই পায়নি শাস্তি থেকে। তবে এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কুশীলবরা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। জীবিত কিংবা মৃত, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে কার কতটা দায় সেটা অবশ্যই বের করা চাই।

লেখক: অজয় দাশগুপ্ত, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক

নিউজ বাংলা ২৪, ১৬ আগস্ট, ২০২১, লিঙ্ক

আরও পড়ুন