আলোর দিশারির প্রত্যাবর্তন

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল

বঙ্গবন্ধুকন্যার আগমনের প্রতীক্ষায় প্রকৃতিও যেন অপেক্ষা করেছিল। বিকেল ৪টায় শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান যখন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করল, তখন অঝোর ধারার বৃষ্টি শান্তির বার্তা নিয়ে শেখ হাসিনাকে বরণ করে। লাখ লাখ বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের মাঝে তিনি খুঁজে ফেরেন স্বজনের মুখ। আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই’। মুহূর্তের মধ্যে সে ধ্বনি প্রকম্পিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র বাংলাদেশে।

১৭ মে ১৯৮১তে দেশরত্ন শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ছাত্রলীগ একটি লিফলেট বিতরণ করেছিল সেখানে লেখা ছিল-

“বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার মূর্তপ্রতীক/সংগ্রামী নেত্রী/ শেখ হাসিনা ওয়াজেদের/ স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের আহ্বান: প্রিয় ভাই ও বোনেরা, কঠিন দুঃসময়ের অন্ধকার পেরিয়ে আমরা আজ জাতীয় জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে উপনীত হয়েছি। আসছে ১৭ই মে লক্ষ শহীদের রক্তে কেনা বঙ্গবন্ধুহীন এই স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করছেন তাঁর আদরের কন্যা সংগ্রামী নেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালির মহান মুক্তি সংগ্রামের অঙ্গীকার নিয়ে জনতার মুক্তির পতাকা হাতে জনক-জননী, ভাই ও স্বজনের রক্তে ভেজা মাটিতে ফিরে আসছেন তিনি। জাতীয় জীবনের মহালগ্ন ১৭ই মে।”

প্রচারপত্রে আরও বলা হয়েছিল:

“…ক্ষমতার মোহে মদমত্ত একশ্রেণীর বন্দুকধারী ও তার চাটুকার রাজনৈতিক দলে চলছে বিলাসী উন্মত্ততা। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নানা প্রতিবন্ধকতা।…আজ এই সময়ের মুখোমুখি শেখ হাসিনার আগমন তাই আমাদের জীবনে তাৎপর্যমণ্ডিত। আমাদের প্রত্যাশা—জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের পথ প্রশস্ত করবে এ প্রত্যাবর্তন। বাঙালি জাতিকে তিনি নেতৃত্ব দেবেন জাতির জনকের আরাধ্য দ্বিতীয় বিপ্লবের মহান কর্মসূচি বাস্তবায়নে সৎ, বিপ্লবী, সুশৃঙ্খল, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনীর সংগঠন গড়ে তুলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন শোষণমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার মহাসংগ্রামে। আর তাই এ প্রত্যাবর্তন হোক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।”

সত্যিই তিনি সেদিন বাংলাদেশের জনগণের কাছে আলোকবর্তিকা হয়েই এসেছিলেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর দেশের ভাগ্যাকাশে একটি কালো অধ্যায় রচিত হয়। গণতন্ত্রের ঘটে অপমৃত্যু। সামরিক শাসন হয় জারি। বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেন।

১৯৭৬ সালের ২৯ এপ্রিল সায়েম জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েমকে জোর করে পদত্যাগ করিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের অধীনে বাংলাদেশে একটি ভোটারবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিতর্কিত এ নির্বাচনে জিয়াউর রহমান নিজেকে জয়ী ঘোষণা করে সেই সংসদেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত কলঙ্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে আইনি সুরক্ষা দিয়েই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের সময় বিদেশে অবস্থানের কারণে দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। জাতির ইতিহাসের এ কলঙ্কজনক ঘটনার সময় শেখ হাসিনার স্বামী বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন শেখ হাসিনা। তারপর ভারতে এসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর স্বদেশের মাটিতে তিনি ফিরে আসেন।

দেশরত্ন শেখ হাসিনার বাংলাদেশে ফিরে আসার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না। একদিকে পরিবারের সব সদস্যকে হারানোর শোক, অপরদিকে সেই খুনিদের হাতেই তখন রাষ্ট্রক্ষমতা। এমন বিপৎসংকুল পরিস্থিতিতে জীবনের মায়াকে তুচ্ছ করেই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই তিনি ফিরে এসেছিলেন। অন্ধকার থেকে মুক্তির আলোর দিশারি হয়েই প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।

জিয়া রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিদের নিয়ে সরকার গঠন করে পাকিস্তানিদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করতে থাকে। তাদের প্রধান টার্গেটই হয়ে দাঁড়ায় আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করা। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন, কাউকে ভয় কিংবা প্রলোভন দেখিয়ে দলে টেনে নেয়া, আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে দল-উপদল তৈরি করে কোন্দল সৃষ্টি করাসহ এমন কোনো কাজ নেই যা তারা করেনি।

স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের তখন ত্রাহি অবস্থা। দলের ভাঙন রোধ করে ঐক্যবদ্ধ রাখাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতেই সর্বসম্মতভাবে দলের দায়িত্ব তুলে দেয়ার সিন্ধান্ত হয়। সেই মোতাবেক ১৯৮১ সালের ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দলের জাতীয় কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত করা হয়। তারপর আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দল দিল্লি গিয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করে দেশে ফেরার চূড়ান্ত দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয়। সেদিনটি ছিল ১৭ মে ১৯৮১।

শুধু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীই নয়, গণতন্ত্রমনা প্রতিটি নাগরিকের মধ্যেই এক উত্তেজনাকর আবেগময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ১৭ মে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে ঢাকা নামেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। সামরিক শাসকের সকল রক্তচক্ষু ভয়কে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে নিজের জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়েই তিনি ফিরে এলেন। পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা বেগম ফজিলাতুননেছা, তিন ভাই শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেলসহ পরিবারের কোনো সদস্যই জীবিত ছিল না। ৩২ নং সড়কের বাড়িটি এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল। জিয়া সরকার বাড়িটিকে তালা মেরে বন্ধ করে দিয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাসটাকেই ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুকন্যার আগমনের প্রতীক্ষায় প্রকৃতিও যেন অপেক্ষা করেছিল। বিকেল ৪টায় শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমান যখন বাংলাদেশের মাটি স্পর্শ করল তখন অঝোর ধারার বৃষ্টি শান্তির বার্তা নিয়ে শেখ হাসিনাকে বরণ করে। লাখ লাখ বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের মাঝে তিনি খুঁজে ফেরেন স্বজনের মুখ। আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে ওঠেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই’। মুহূর্তের মধ্যে সে ধ্বনি প্রকম্পিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমগ্র বাংলাদেশে।

বিমানবন্দর থেকে সংবর্ধনাস্থল মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত পুরো রাস্তা ছিল লোকে লোকারণ্য। ১৫ লাখেরও বেশি লোকের সমাগম হয়েছিল সেদিনের সংবর্ধনায়। চারদিকে গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত ঢাকা শহর। ‘শেখ হাসিনা ভয় নাই, আমরা আছি লক্ষ ভাই’, ‘শেখ হাসিনা কথা দিলাম, মুজিব হত্যার বদলা নেব’, ‘ঝড়-বৃষ্টি আঁধার রাতে, আমরা আছি তোমার সাথে’, ‘বঙ্গবন্ধুর রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘আদর্শের মৃত্যু নাই, হত্যাকারীদের ক্ষমা নাই’ ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘ শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম’।

তিনি জনতার সমুদ্রে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন- “আজকের জনসভায় লাখো লাখো চেনামুখ আমি দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। ভাই রাসেল আর কোনোদিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন। …বাংলার মানুষের পাশে থেকে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নেয়ার জন্য আমি এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।”

সেই থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পথচলা শুরু। স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে তীব্র গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে স্বৈরশাসক জিয়া ও এরশাদের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেন। মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়সহ গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বহুবার গৃহবন্দিসহ কারাবরণও করতে হয়েছে। তবুও তিনি অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে একচুলও পিছপা হননি।

দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত চারবার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। প্রথমবার ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত। দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালের ৫ জানুয়ারি সরকার গঠন করে একটানা তিন মেয়াদে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এক যুগেরও বেশি সময় দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল, বিশ্বের কাছে অপার বিস্ময়। খাদ্যঘাটতির দেশ আজ খাদ্য রপ্তানির সক্ষমতা অর্জন করেছে। নারীর ক্ষমতায়ন, সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণ, শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর শান্তি প্রতিষ্ঠায় দক্ষতা, ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়াসহ একাধিক কাজে বিশ্বে বাংলাদেশ পৌঁছে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়।

বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ অসংখ্য ফ্লাইওভার, রেল পরিষেবা গতিশীল করা, শতভাগ নীরবছিন্ন বিদ্যুৎসেবা, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারেরও বেশি, জিডিপি ৮.১৫ শতাংশ উন্নতি করে লক্ষ্যমাত্রা ২০৪১ সালে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। পিতার মতো দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে আত্মমর্যদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। যার সবকিছুই সম্ভব হয়েছে দেশরত্ন শেখ হাসিনার গতিশীল ও ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্বের কারণে। তিনি ফিরে এসেছিলেন বলেই আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

তাপস হালদার: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।

haldertapas80@gmail.com

আরও পড়ুন