► বু বলে ডাকতেন প্রতিবেশী জোহরা খাতুন
► ইলিশ ভাজার স্বাদ ভোলেননি জোবেদা খাতুন
► শেখ হাসিনা ও শেখ কামালকে সঙ্গ দিয়েছেন আবদুর রহমান
► অনেক স্মৃতি আগলে রেখেছেন বানিজা বেগম
১৯৫৪ সাল। বঙ্গবন্ধু তখন পূর্ব বাংলায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রী। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে থাকেন ৩ নম্বর মিন্টো রোডে সরকারি বাসভবনে। আদমজীর দাঙ্গার জেরে ১৯ মে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে করাচিতে ডেকে পাঠায় কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেখানে যান। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনায় সমঝোতা না হওয়ায় ২৯ মে তাঁরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা করেন। পৌঁছান পরদিন ৩০ মে দুপুরে। তার আগেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে জারি করেন গভর্নরের শাসন। আর ওই দিন সন্ধ্যায় মিন্টো রোডের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাবেন, কোথায় থাকবেন, তা নিয়ে বঙ্গবন্ধু ব্যাকুল হয়ে পড়েন। বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলে যান স্ত্রীর জন্য একটি বাড়ি ভাড়া করে দিতে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব ওই যাত্রায় উঠেছিলেন নাজিরাবাজার লেনের ৭৯ নম্বর বাড়িতে।
সেখানে তিনি ছেলে-মেয়েদের নিয়ে প্রায় আড়াই বছর ছিলেন। স্মৃতিময় সেই বাড়ির খোঁজে কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মামুন সম্প্রতি নাজিরাবাজার লেনে গিয়ে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে তৈরি করেছেন বিশেষ এই প্রতিবেদন।
৭৯ নাজিরাবাজার : পুরনো ঢাকার অপরিসর একটি গলি নাজিরাবাজার লেন। এই লেনের ৭৯ নম্বর বাড়িটি ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের ফুপু আসিয়া খাতুনের। স্বামী শামিউল্লাহ খান মারা যাওয়ার পর নিঃসন্তান আসিয়া খাতুন এই বাড়িতে তিন ভাতিজা মোহাম্মদ সুলতান (ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক), আবদুল মজিদ ও মোহাম্মদ হানিফকে নিয়ে বসবাস করতেন। মোহাম্মদ হানিফের মা মুন্নী বেগম মারা যাওয়ায় তাঁরা এই ফুপুর কাছে বড় হন। নাজিরাবাজার লেনের এই বাড়িটির দুটি অংশ ছিল। প্রায় ছয় কাঠা জমির ওপর একপাশে দ্বিতল একটি বাড়িতে সন্তানসম ভাতিজাদের নিয়ে বাস করতেন আসিয়া খাতুন। আরেক অংশে দুই রুমের একতলা বাড়িতে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিব তাঁর সন্তানদের নিয়ে ওঠেন। গত বুধবার সরেজমিনে নাজিরাবাজার লেনে গিয়ে দেখা যায়, ওই বাড়িটি আর নেই। সেখানে পৃথক তিনটি ভবন গড়ে উঠেছে।
আসিয়া খাতুনের মৃত্যুর পর ওই জমি পান তিন ভাতিজা। বর্তমানে সেখানে মোহাম্মদ হানিফের অংশে তাঁর ছেলে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণ করেছেন। মাঝের অংশে আবদুল মজিদের ছেলেরা আরেকটি ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। বাকি অংশে মোহাম্মদ সুলতানের ছেলে মোহাম্মদ সাদেক মিঠু তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করে সেখানে বাস করেন।
মোহাম্মদ সাদেক মিঠু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিণী বেগম মুজিব যে একতলা বাড়িতে এসে ওঠেন, সেই বাড়ির বেশি ভাগই আমাদের দিকে পড়ে। প্রায় ২৫ বছর আগে বাড়িটি ভাঙা হয়। ’
বঙ্গমাতা যেভাবে নাজিরাবাজার লেনে আসেন : বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার আগ মুহূর্তে তাঁর স্ত্রীর জন্য ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ইয়ার মোহাম্মদ খান ও হাজি হেলাল উদ্দিনকে একটি বাড়ি ভাড়া করে দিতে বলেছিলেন। এর পাঁচ দিন পর ইয়ার মোহাম্মদ খানও গ্রেপ্তার হন।
তবে জেলে যাওয়ার আগে পুরনো ঢাকার বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠজনদের বঙ্গমাতার জন্য বাড়ি ভাড়া করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে যান ইয়ার মোহাম্মদ খান। তখন পুরনো ঢাকার ব্যবসায়ী হাজি মনির হোসেন (ঢাকা চেম্বারের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম), তাঁর ভাগ্নিজামাই পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত সদস্য হেদায়েতুল ইসলাম (পরে বিডি মেম্বার), তাঁর চাচাতো ভাই তরুণ চান মিয়া এবং মোহাম্মদ হানিফের বড় ভাই আরেক তরুণ মোহাম্মদ সুলতানের মাধ্যমে আসিয়া খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের জেলজীবন, তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের অসহায় অবস্থা এবং ভয়ে তাঁদের কেউ বাড়িভাড়া দিচ্ছে না জেনেও সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে দৃঢ়চিত্তের আসিয়া খাতুন বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ওই বাড়ি ভাড়া দেন।
এ প্রসঙ্গে হেদায়েতুল ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ শাহীনুল ইসলাম বনি তাঁর বাবার স্মৃতিচারণা উদ্ধৃত করে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জীবিতাবস্থায় বাবার মুখে শুনেছি, হাজি মনির হোসেনের (তাঁর বাবার চাচা শ্বশুর) একটি জিপ কাম ট্রলি গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের ৭৯ নাজিরাবাজার লেনের এই বাড়িতে আনা হয়। ওই গাড়ির ড্রাইভার ছিলেন ময়না। বাবাও সঙ্গে ছিলেন।’
তিনি আরো জানান, ১৯৭২ সালের ১৬ এপ্রিল তাঁর বড় বোন জাহান আরার বিয়ের অনুষ্ঠানে তাঁদের বাড়িতে আসেন বঙ্গমাতা, শেখ কামাল, শেখ রাসেল ও আওয়ামী লীগ নেত্রী রাফিয়া আক্তার ডলি।
তাঁর বাবা হেদায়েতুল ইসলাম ৯৭ বছর বয়সে ২০১৪ সালে মারা গেছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ছিল।
বঙ্গমাতাকে ‘বু’ বলে ডাকতেন প্রতিবেশী জোহরা খাতুন : নাজিরাবাজার লেনে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী হিসেবে পরিচিত ছিলেন জোহরা খাতুন। নাজিরাবাজার লেনে তিনি ‘ভুট্টোর নানি’ নামে বেশি পরিচিত। পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন তিনি। মারা যাওয়ার আগে নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশীদের কাছে আবেগাপ্লুত হয়ে প্রায়ই বঙ্গমাতা, তাঁদের দুই সন্তান শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতেন।
জোহরা খাতুন ছিলেন ১১ নম্বর কাজী আলাউদ্দিন রোডের আবদুর রহমানের স্ত্রী। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে জোহরা খাতুন নিয়মিত যেতেন। তাঁরা একে অন্যকে ‘বু’ সম্বোধন করতেন। তাঁর বড় মেয়ে সুফিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রায় সমবয়সী। আরেক মেয়ে বানিজা বেগম তাঁর দেড় বছরের ছোট। তাঁরা দুই বোন মাঝেমধ্যে শেখ হাসিনা ও শেখ কামালের খেলার সঙ্গী হতেন।
বানিজা বেগম কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁর মা বঙ্গমাতার খুব কাছের জন ছিলেন। নিয়মিত ওই বাড়িতে যেতেন এবং সাংসারিক কাজে তাঁকে সহযোগিতা করতেন। ১৯৭২ সালে তাঁদের নিকটাত্মীয় ও প্রতিবেশী হেদায়েতুল ইসলামের বড় মেয়ে জাহান আরার বিয়েতে এসে বঙ্গমাতা ভিড়ের মধ্যে দূর থেকে দেখেও তাঁর মাকে চিনতে পারেন এবং কাছে ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর মা, স্বামী হাজি ফজলুর রহমান ও তিনি বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার ১৫-২০ দিন আগে একবার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখন বঙ্গমাতা দোতলায় নিয়ে তাঁদের খুব আদর-আপ্যায়ন করেন। আগের মতোই তাঁর মাকে বুকেও জড়িয়ে নেন।
বানিজা বেগম জানান, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একবার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের বাড়িতে এলে তাঁর স্বামী হাজি ফজলুর রহমানের অসুস্থতার খবর পেয়ে তাঁদের বাড়িতেও আসেন।
বঙ্গমাতার ইলিশ ভাজার স্বাদ এখনো ভোলেননি জোবেদা খাতুন : ৭৯ নাজিরাবাজার লেনের বাড়ি লাগোয়া ১০/১ কাজী আলাউদ্দিন রোডের বাড়িতে ১৩ বছর বয়সে ব্যবসায়ী গোলাম রহমানের বউ হয়ে আসেন জোবেদা খাতুন। এলাকায় তিনি ‘মিনুর মা’ নামে পরিচিত। মমতাজ বেগম মিনু তাঁর পালিত মেয়ে। নব্বই ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধা জোবেদা খাতুন কালের কণ্ঠকে জানান, সেই সময়কার মধুর স্মৃতির কথা। তিনি বলেন, ‘জীবনে প্রথমবারের মতো ইলিশ ভাজা খাই বেগম মুজিবের কাছে। সেই ইলিশ ভাজার স্বাদ এখনো ভুলতে পারিনি। আমার বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল খেলাধুলা করত। আর বেগম মুজিব ছিলেন খুব ভালো মানুষ। কাঁচা সুপারি দিয়ে পান খেতেন।’
শেখ হাসিনা ও শেখ কামালকে বঙ্গমাতার কাছে পৌঁছে দিতেন আবদুর রহমান : ১০/১ কাজী আলাউদ্দিন রোডের ঠিক উল্টো বাড়িটি প্রয়াত হেলাল ব্যাপারীর। ওই বাড়ির মেয়ে সায়েরা খাতুনের ছেলে আবদুর রহমানের বয়স বর্তমানে ৮৬ বছর। যুবক বয়সে অনেকটা সময় তাঁর এই বাড়িতেই কেটেছে। আবদুর রহমানের সঙ্গে কথা হয় ১০৫ নাজিরাবাজার লেনের নিজের বাসায়। তিনি ঢাকার সাবেক মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফের মামাশ্বশুর এবং বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর হেদায়েতুল ইসলামের মামাতো ভাই।
বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে কেমন দেখেছেন জানতে চাইলে আবদুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বেগম মুজিব সন্তানদের নিয়ে যখন ৭৯ নাজিরাবাজার লেনের বাসায় ওঠেন, তখন আমি যুবক। দেখতাম শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল বাড়ির বাইরে খেলতে বের হলে বেগম মুজিব খুব চিন্তায় থাকতেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হলে বলতেন, ‘ভাই, একটু দেখো।’ বেগম মুজিবের দুশ্চিন্তার কারণে প্রায়ই আমি দুই ভাই-বোনকে (শেখ হাসিনা ও শেখ কামাল) রাস্তা থেকে ডেকে সঙ্গে করে নিয়ে তাদের বাসায় বেগম মুজিবের কাছে পৌঁছে দিতাম।’