স্মৃতির মণিকোঠায় বঙ্গবন্ধু

সম্পাদনা/লেখক: Zakir Hossain

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে প্রথম জানতে পারি আমার অগ্রজ তফাজ্জল ইমামের মুখ থেকে। তিনি তখন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র। সে সময় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী নেতৃত্বের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়ে ইসলামিয়া কলেজজুড়ে। কলকাতায় ধর্মীয় দাঙ্গা প্রতিরোধে তার সাহসী ভূমিকা আজও মনে গাঁথা। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট মুহাম্মদ আলী জিন্নাহের আহ্বানে সারা ভারতে ‘ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালিত হয়। তারই ফলে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়। সেই দাঙ্গায় আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। ওই সময় শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিয়া কলেজের ছাত্রদের নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করতে এক বিশাল ভূমিকা রাখেন।

দেশভাগের পর ১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধুকে সশরীরে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়। আমি তখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে রাজনৈতিক সফরে তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সে সময় পাবনায় গিয়েছিলেন। আমরা কতিপয় ছাত্রনেতা বিশাল জনসভার আয়োজনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। পরে ১৯৬৫ সালে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ঢাকা হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর খোঁজখবর নেয়ার সুযোগ হয়। এ সময় তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। আমি এবং আমার সহকর্মী ও বন্ধু রফিকুল্লাহ চৌধুরী (বর্তমান জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পিতা) নিয়মিত বঙ্গবন্ধুর খোঁজখবর রাখতাম। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি আজও দেদীপ্যমান। বিজয়ী বীর উন্নতশির বিমানের দরজা দিয়ে হেঁটে এলেন; হাত তুলে বাঙালি জাতিকে জানালেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’। আমি শিহরিত হয়েছিলাম। আনন্দে-গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল।

প্রথম অত্যন্ত কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি সকালবেলা তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বেইলি রোডের বাসায়। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার পরও তার চোখ-মুখ উদ্দীপ্ত। যেমন দীর্ঘদেহী সুপুরুষ, তেমনই সুদর্শন। তার চেয়েও তার ব্যক্তিত্ব আরো বিশাল। প্রথম দেখাতেই কাছে ডেকে নিলেন; জিজ্ঞেস করলেন: ‘কী রে কেমন আছিস?’ মনে হলো কতদিন থেকে চেনেন। দীর্ঘদিন পর সন্তানকে দেখে পিতা যেমন কুশল জিজ্ঞেস করেন, ঠিক তেমনি। বঙ্গবন্ধুকে সেদিন দেখে ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের লাহোর সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আমাদের প্রিয় শিক্ষকের দেয়া সার্থক নেতার সংজ্ঞা মনে পড়ে গেল, ‘তিনিই প্রকৃত নেতা, যাঁর আছে Radiating Permeative Virtue’ এটি চীনের মান্ডারিন শাসকদের দেয়া সংজ্ঞা। ভাবার্থ হলো: সার্থক এবং সফল নেতা তার গুণাবলি আশপাশে সবার মাঝে বিকিরণ ও অভিস্রবণ করেন। সেই গুণ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। উৎসারিত হয়, বিচ্ছুরিত হয়।

বঙ্গবন্ধু ১১ জানুয়ারি তার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে সদস্যদের বিষয় ও সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কে আলোচনা এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু এদিন রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ ১৯৭২ জারি করেন। রাষ্ট্রপতির সাময়িক সংবিধান আদেশ ১৯৭২-এ রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন, মন্ত্রিসভা নিয়োগ, শপথ, হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি স্থান পেয়েছিল। উল্লেখ্য, আমি এ সময় মনে করিয়ে দিয়েছিলাম রাষ্ট্রপতি হিসবে বঙ্গবন্ধুর শপথ নেয়া হয়নি; রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করাও প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে বিচারপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমকে সাময়িক সংবিধান আদেশের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রদান করেন। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার পরিবর্তন করে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে গিয়ে প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি সকালে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথগ্রহণ করে সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার পদত্যাগ ঘোষণা করেন। পদত্যাগ ঘোষণার পর সাময়িক আদেশের ৮ নম্বর ধারাবলে মন্ত্রিপরিষদ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে এবং প্রধান বিচারপতি তার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তারপর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদসহ মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্য পদত্যাগ করেন এবং রাষ্ট্রপতি সাময়িক আদেশের ৭ নম্বর ধারাবলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধু তার ১১ সদস্যবিশিষ্ট নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেন এবং রাষ্ট্রপতির সাময়িক আদেশের ১০ নম্বর ধারাবলে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী ও অন্য মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ করান। ঘটনাবহুল এ দিনগুলোতে শপথ ও কার্যভার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই অতি দ্রুত গেজেট নোটিফিকেশন করা হয়েছিল।

১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু নতুন মন্ত্রিসভার সব সদস্যকে নিয়ে প্রথম বৈঠক করেছিলেন। এ বৈঠকে জাতীয় সংগীত ও মার্চিং সংগীত সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ থেকে শুরু করে প্রথম ১০ লাইন অর্থাৎ ‘আমি নয়নজলে ভাসি’ পর্যন্ত জাতীয় সংগীতের বাণী হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সশস্ত্র বাহিনীর মার্চিং সংগীত হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল্ চল্ চল্, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ গানের বাণী অনুমোদিত হয়।

এর পরই অন্য আরেকটি সমস্যা উদ্ভূত হয়। সেটি জাতীয় সংগীতকে কেন্দ্র করে। কবিগুরুর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাঁশি, অন্যান্য দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ও ব্যাগপাইপে বাজানো গেলেও সামরিক বাহিনীর ব্রাস ব্যান্ডে বাজানো খুব কঠিন ছিল এ কারণে যে তখন পর্যন্ত জাতীয় সংগীতের কোনো আন্তর্জাতিক স্টাফ নোটেশন ছিল না। এ কারণে আমাদের সামরিক ও অন্যান্য বাহিনীর বেশকিছু অসুবিধা হচ্ছিল (যেমন—বিদেশী ভিভিআইপি মেহমান এলে গার্ড অব অনার প্রদান ইত্যাদি)। ১৯৭৩ সালের জুনে ব্রিটিশ সরকারের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ থেকে একটি উচ্চপদস্থ সরকারি দল যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করে (যার মধ্যে আমিও ছিলাম)। আমার ভ্রমণসূচিতে অন্যতম বিষয় ছিল ব্রিটিশ সরকারের ক্যাবিনেট সচিবের সঙ্গে বৈঠক। তাকে আমাদের জাতীয় সংগীতের স্টাফ নোটেশনের বিষয়টি সম্পর্কে জ্ঞাত করলে তিনি বিবিসির সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেন। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বাংলাদেশ থেকে কোনো বিখ্যাত সুরকার ও সংগীত বিশেষজ্ঞকে বিবিসিতে পাঠানো হবে এবং তিনি বিবিসির সংগীত বিভাগের সহযোগিতায় আমাদের জাতীয় সংগীতের আন্তর্জাতিক স্টাফ নোটেশনটি নির্ধারণ করে আনবেন।

দেশে ফিরে বিষয়টি বঙ্গবন্ধুকে জ্ঞাত করলে তিনি বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও সুরস্রষ্টা সমর দাসকে কাজটি করার জন্য নির্বাচন করেন। একই সঙ্গে জাতীয় সংগীতের মূল সুর থেকে যেন কোনো বিচ্যুতি না ঘটে সেজন্য আমরা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দেশে একটি বিশেষজ্ঞ দল গঠন করি এবং বিবিসি থেকে সমর দাস কর্তৃক তৈরি করে আনা স্টাফ নোটেশনটি তাদের বিশেষজ্ঞ মতামতের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়। এ বিশেষজ্ঞ দলে ছিলেন প্রয়াত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কলিম শরাফী, প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী ও সুরকার আবদুল আহাদ ও সন্জীদা খাতুন (ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা)। এদের সহযোগিতা করেন বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের তত্কালীন পরিচালক আমিরুজ্জামান।

বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সদস্যদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দূরদৃষ্টি ছিল প্রখর। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে কেউ কোনো পরামর্শ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন এমন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। বঙ্গবন্ধু অবশ্য ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতা সফরে গিয়েছিলেন এবং তা খুবই ফলপ্রসূ ছিল। এ সফরের সময় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সৌহার্দপূর্ণ ও আন্তরিক আলোচনা হয়েছিল। আলোচনার সূত্র ধরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ১৭ মার্চের আগে বাংলাদেশ ত্যাগ করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফর চূড়ান্তকরণের প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু নিজেই তাকে টেলিফোনে যোগাযোগ করেন। কার্যোপলক্ষে সৌভাগ্যবশত আমি বঙ্গবন্ধুর পাশেই ছিলাম। লক্ষ করেছিলাম বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী; কিন্তু দৃঢ় স্বরে মিসেস গান্ধীকে তার বাংলাদেশ সফরের আগেই ভারতীয় সেনাবাহিনী ফেরত নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। পাশে থেকে মিসেস গান্ধীর সম্মতির কথা শুনলাম। মিসেস গান্ধীকে বলতে শুনেছিলাম, “I am overwhelmed at your outspoken manner and boldness in discussing on this very important issue. Well, it will be done as per your honest wish (আপনার স্পষ্টবাদী আচরণ এবং দৃঢ়তায় অভিভূত হয়েছি। ঠিক আছে, আপনার সদিচ্ছা পূরণ হবে)।’ মিসেস গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের আগেই ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সব সদস্যকে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছিল।

দূরদর্শী বঙ্গবন্ধু এ কথা ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সুবিন্যস্ত আর্থিক নীতিমালা ও ব্যাংক খাতের সুষ্ঠু বিকাশ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তাই ব্যাংক খাতে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ছিল সুদূরপ্রসারী। বিধ্বস্ত অর্থনীতি, মুদ্রা ব্যবস্থার অভাব ও ভগ্ন ব্যাংকিং ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তত্ক্ষণাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনর্গঠন করতে হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার হয়। সেটি ছিল পাকিস্তান আমলের নামগুলো পরিবর্তন করে নতুন বাংলা নাম দেয়া। প্রাক্তন পাকিস্তান আমলের ১২টি ব্যাংককে একত্র করে নতুন নাম দিয়ে মোট ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ প্রসঙ্গে একটি ব্যক্তিগত স্মৃতিকথার উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। বাংলাদেশ সচিবালয়ের পুরনো ক্যাবিনেট রুমে ব্যাংক রাষ্ট্রীয়করণ সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় আলোচনায় এসে যায়। আলোচনার বিষয় ছিল যে নতুন রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর বাংলা নামকরণ কীভাবে হবে? প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করছিলেন। আকস্মিকভাবেই তত্কালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তত্কালীন ক্যাবিনেট সচিব আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনিই কয়েকটি নাম সুপারিশ করুন।’ তাত্ক্ষণিকভাবেই কেন জানি না আমার এ বিষয়ে মনে কিছু প্রতিক্রিয়া হলো। অতি দ্রুত ভাবনায় লে যে প্রাক্তন এ ব্যাংকগুলোর প্রধান কাজ কী ছিল এবং তখন তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কী ছিল সেটি পর্যালোচনা করে নতুন নাম দেয়া গেলে ভালো হয়। পাকিস্তান আমলে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান মূলত পাট রফতানি ব্যবসায় অর্থায়ন করত। সোনালি আঁশরূপে বিশ্বব্যাপী পরিচিত পণ্য পাটের প্রসারের পেছনে ব্যাপক অবদানের জন্য এ ব্যাংকের নতুন নামকরণ ‘সোনালী ব্যাংক’ করার প্রস্তাব রাখলাম। পাকিস্তান আমলের অত্যন্ত ব্যবসা সফল ও আধুনিক ব্যাংক হিসেবে সমাদৃত ছিল হাবিব ব্যাংক। নতুন ব্যাংকও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সে রকমই অগ্রণী ভূমিকা যেন রাখতে পারে সে চিন্তা মাথায় রেখে এর নামকরণের প্রস্তাব করেছিলাম। প্রস্তাব গ্রহণ করে এ ব্যাংকের নাম রাখা হলো ‘অগ্রণী ব্যাংক’। ইউনাইটেড ব্যাংক ব্যাংকিং ব্যবসায় একটি নতুন ধারা প্রচলন করেছিল। মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের ব্যাংক হিসেবে ব্যাংকটি পরিচিত হয়ে উঠেছিল। বিষয়টি ভেবে নতুন ব্যাংকের নাম প্রস্তাব করলাম ‘জনতা ব্যাংক’। এরপর বাংলার সবচেয়ে প্রিয় মাছ ইলিশ যে বর্ণের, সেই নামটি ব্যবহার করে ‘মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক’ এবং অন্য দুটি ব্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত নতুন ব্যাংকের নাম প্রস্তাব করলাম ‘রূপালী ব্যাংক’। তত্কালীন পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানি (বাঙালি) উদ্যোক্তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ‘ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক’-রে নাম স্বভাবতই ‘পূবালী ব্যাংক’ রাখা সংগত হবে বলে মত দিলাম। যেহেতু উত্তরবঙ্গের কোনো ব্যাংক ছিল না এবং ব্যবসা-বাণিজ্যে এ অংশ অনেকটা পিছিয়ে ছিল, তাই এমন চিন্তা মাথায় রেখে ‘ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশন’-রে নাম পরিবর্তন করে ‘উত্তরা ব্যাংক’ রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করলাম।

আজ ভাবতে অত্যন্ত গর্ববোধ করি যে সেদিন সম্মানিত মন্ত্রিসভার সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতেই আমার উপরোল্লিখিত সব প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করেন, যার প্রতিফলন ঘটে The Bangladesh Banks (Nationalization) Order, 1972 শিরোনামে প্রণীত রাষ্ট্রপতির আদেশে। জাতীয়করণকৃত ব্যাংকগুলো সেই নামেই বাংলাদেশে সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

এর পরই আরেকটি বিরাট পদক্ষেপ নিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেটি হলো পরিকল্পনা কমিশন স্থাপন। ৩১ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় পরিকল্পনা কমিশন, যার চেয়ারম্যান ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর পরই প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর নূরুল ইসলাম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাত্কারের সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। প্রফেসর ইসলাম খুব সুচিন্তিতভাবেই কাজ করতেন। তিনি পরিকল্পনা কমিশন স্থাপনের জন্য এবং তার গঠন, দায়িত্ব ও কার্যপ্রণালি কীভাবে হবে সেগুলো লিখে নিয়ে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমার হাতে সেটি দিয়ে বললেন, পরে বিবেচনা করে দেখব। প্রফেসর ইসলাম প্রস্তাবিত পরিকল্পনা কমিশন স্থাপন করা হলে এবং যেভাবে ক্ষমতায়ন তিনি চেয়েছিলেন তাতে আরেকটি সমান্তরাল সরকার গঠন করতে হতো। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তখনো আমাদের সরকারের রুলস অব বিজনেস চূড়ান্ত হয়নি এবং আমার একটি অস্থায়ী খসড়া রুলস দ্বারা সরকার পরিচালনা করছিলাম। ব্যাপকভাবে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করায় এবং পূর্ব ঘোষিত আওয়ামী লীগের ইশতেহারের বিভিন্ন বিষয়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন বাংলাদেশ সরকারের অবয়ব ছিল অত্যন্ত আধুনিক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক। এরপর একটি ক্রান্তিকালে যে শ্রম, ধৈর্য ও সময়ে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে ব্যক্তিগতভাবে দিয়েছিলেন এর সাথে আমি সম্পৃক্ত ছিলাম। এটি মনে পড়লে এখনো শিহরিত হই।

১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধু প্রত্যাবর্তনের পর পরই তোফায়েল আহমেদকে তার রাজনৈতিক সচিব (পলিটিক্যাল সেক্রেটারি) নিয়োগ করেন। সেই সঙ্গে তিনি তার অত্যন্ত আস্থাভাজন দুই পুরনো কর্মকর্তাকে নিয়ে আসেন। এদের একজন হলেন মোহাম্মদ হানিফ (যিনি আলফা ইন্স্যুরেন্সে কাজ করতেন), অন্যজন হলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী ও টাইপিস্ট রোজারিও। ১৯৭২-এর জুন-জুলায়ে মশিউর রহমানকে বঙ্গবন্ধু তার একান্ত সচিব নিয়োগ করেন। ওই বছরের শেষ দিকে ফরাসউদ্দিন যোগদান করেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব-২ হিসেবে। প্রথম দিকে নুরুল ইসলাম (অনু) বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেন। অল্প কয়েক দিন পর তার স্থলাভিষিক্ত হন মাহে আলম। ’৭২-রে ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যোগদান করেন মনোয়ারুল ইসলাম (যুগ্ম সচিব)। মনোয়ার সিভিল সার্ভিসের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। জীবনে কখনো দ্বিতীয় হননি; চারিত্রিক দৃঢ়তা অসাধারণ। বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কতগুলো দায়িত্ব তাকে ন্যস্ত করেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আমি সহায়ক শক্তি হিসেবে পাই কাজী হাবিবুল হককে। তিনিও যুগ্ম সচিব পদে যোগদান করেন এবং মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকের বিবরণী লিখতেন।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভার আলোচনা ও সিদ্ধান্তের বিষয়বস্তু প্রথম দিকে আমি নিজ হাতে লিখতাম। কাজী হাবিবুল হক যোগদান করার পর তিনি আমাকে সহায়তা করেন। বৈঠকে যেসব বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হতো সেগুলো আমরা নোট খাতায় টুকে নিতাম। পরে এগুলো যথাযথভাবে টাইপ করা হলে আমি ও হাবিবুল হক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্বাক্ষর করতাম। চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে উপস্থাপন করতাম। বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বাধীন সরকারের ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে তখন আমি যে নোট খাতা সঙ্গে রাখতাম, সেগুলো আজও আমার সংরক্ষণে আছে।

বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন সকালে গণভবনে (প্রাক্তন রাষ্টীয় অতিথি ভবন সুগন্ধা ও বর্তমান ফরেন সার্ভিস ট্রেনিং একাডেমি) আসতেন। আমরা তাকে অভ্যর্থনা জানাতাম এবং তার সঙ্গে গিয়ে বসে দিনের কর্মসূচি আলোচনা করতাম। রফিকুল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর সচিব পদে যোগদান করার পর আমাদের টিমটি আরো শক্তিশালী হয়। গণভবনের দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। কত রকমের সমস্যা নিয়ে অথবা কেবল বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য দলে দলে লোক আসত। বারান্দায় বসতেন বঙ্গবন্ধু। সম্মুখে ঘন সবুজ ঘাসের লন। সেখানেই জমত মানুষের ভিড়। বলা বাহুল্য, ওই সময় সরকারের কর্মকাণ্ড বিপুলভাবে প্রসারিত হওয়ায় এবং সরকারি জনবল বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানের অভাবে দাপ্তরিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হচ্ছিল। সে সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে বড় দুটি পূর্ত কর্ম মন্ত্রণালয়কে দিয়ে শুরু করাই। প্রথমটি হলো সচিবালয়ের ১ নম্বর ভবনের তিনতলার ওপরে আরেকটি স্বয়ংসম্পূর্ণ তলা বা ফ্লোর নির্মাণ, যেখানে বঙ্গবন্ধু অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব কামরা থাকবে এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা বসতে পারবেন। অন্যদিকে কেবিনেট রুম সম্পূর্ণ নতুন করে নির্মিত হবে, যেখানে টেবিল-চেয়ার ও অন্যান্য আসবাব আধুনিক হবে; সঙ্গেই থাকবে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কক্ষ। এখন আমরা যে কাজগুলো দেখতে পাই এবং যে ব্যবস্থাপনা তার পেছনে বঙ্গবন্ধুর প্রেরণা ও আমার শ্রম উল্লেখ করতেই হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালের ২ থেকে ৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিল। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলের সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর উপলক্ষে ওই দেশের দুটি প্রধান সংবাদপত্র ‘প্রাভদা’ ও ‘ইজভেস্তিয়া’ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ঘটনার বিবরণ দিয়ে উল্লেখ করেছিল যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, জোটনিরপেক্ষতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, জাতিবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সুদৃঢ় করা।

সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান ব্রেজনেভ, প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন ও রাষ্ট্রপ্রধান পদগর্নি বঙ্গবন্ধুকে যে সম্মান প্রদর্শন ও অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন তা ছিল অভূতপূর্ব। পৃথিবীর ইতিহাসে এ দৃশ্য এক বিরল ঘটনা। বঙ্গবন্ধুকে বিশ্বনেতারা কতখানি শ্রদ্ধা করতেন তার প্রমাণ মস্কো বিমানবন্দরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট উভয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন, যা তারা এর আগে কখনো করেননি।

বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ও সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি কোসিগিনের মধ্যে দুই দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সোভিয়েতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছিলেন। দুই মহান দেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের বাংলাদেশ-সোভিয়েত যুক্ত ঘোষণায় বলা হয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফর ফলপ্রসূ হয়েছে। সফরের শেষ দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাসখন্দ পরিদর্শনে গেলে সেখানে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের স্মৃতিতে এখনো সেই দৃশ্য অমলিন হয়ে আছে। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়ানো হাজার হাজার ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীর উচ্ছ্বাস-আনন্দ ভাষায় বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আকাশ-বাতাস মুখর করে তারা স্লোগান দিয়েছিল, ‘বাংলাদেশ’, ‘মুজিবুর রকমান’। রুশ ভাষায় রহমানকে ‘রকমান’ বলে উচ্চারণ করা হয়।

সরকারি পর্যায়ে আলোচনা ও মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ও তার সফরসঙ্গীদের সোভিয়েত ভ্রমণ আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর করার জন্য সোভিয়েত সরকার কোনো আয়োজনেরই ত্রুটি রাখেননি। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর মহড়া, বলশয়ে থিয়েটারে অপেরা এবং ক্রেমলিনসহ মস্কো শহরের উল্লেখযোগ্য প্রতিটি স্থাপনা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও জাদুঘর পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। মস্কো নগরীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালের বীর যোদ্ধাদের সমাধি দর্শন একটি বিশেষ আবহ তৈরি করে। মস্কোর পর বঙ্গবন্ধুর সফরের দ্বিতীয় পর্যায় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্পূর্ণ সময় ধরে অবরুদ্ধ থাকা নগরী লেনিনগ্রাদ (বর্তমানের সেন্ট পিটার্সবার্গ)। লেনিনগ্রাদ শহরটি সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করেও জার্মান নািস বাহিনী এ মহানগরীর পতন ঘটাতে পারেনি। যুদ্ধে যেমন অগণিত সোভিয়েত সৈন্য প্রাণ দিয়েছে, তেমনি অবরুদ্ধ নগরীতে খাদ্যাভাবে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারায়। এদের এই মহান ত্যাগ স্মরণীয় করে রাখার জন্য লেনিনগ্রাদে একটি বিশাল স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। এই নগরীর আরেকটি তাত্পর্য হলো এই যে বলশেভিক বিপ্লব এই লেনিনগ্রাদ শহর থেকেই শুরু হয়েছিল। এই স্মৃতিসৌধ এবং এর সংলগ্ন জাদুঘর অত্যন্ত সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে দেখে সে দেশের জনগণ। স্মৃতিসৌধটি এবং যুদ্ধের ভয়াবহতা ফুটিয়ে তোলা বিভিন্ন ভাস্কর্য এবং পাশাপাশি জাদুঘরে রক্ষিত বিভিন্ন নিদর্শন দেখে বঙ্গবন্ধু ভাবাবেগে আপ্লুত হন। তার সফরসঙ্গী আমরা যারা ছিলাম তারাও ব্যাপকভাবে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করি। এই স্মৃতিসৌধ আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। বঙ্গবন্ধু ওই স্মৃতিসৌধের সামনেই আমাকে নির্দেশ দেন এটির একটি নকশা করে রাখতে, যাতে বাংলাদেশেও ৩০ লাখ শহীদের স্মরণে ও সম্মানে আমাদের সরকারও এ রকম একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে পারে।

দেশে ফেরার পর আমার কাঁচা হাতের এই স্কেচ এবং স্মৃতিতে ধরে রাখা ছবিটি তত্কালীন প্রধান স্থপতি আবুল বাশারকে দেখাই এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী ওই রকম একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের ডিজাইন করার জন্য তাকে অনুরোধ করি। তিনি মোটামুটি ওই আদলেই একটি নকশা প্রস্তুত করেন। ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একই সঙ্গে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে আরেকটি ছোট আকারের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ শুরু হয়।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টাই ছিলেন না; তিনি এ দেশটির সার্থক স্থপতি। এ দেশের এমন একটি ভিত্তি তিনি গড়ে গেছেন, যার ফল পরবর্তী সময়ে সবাই ভোগ করেছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের যে অবকাঠামো প্রয়োজন তিনি সেটি স্থাপন করেছিলেন। আধুনিক যুগের একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান যার মাধ্যমে স্বাধীন জাতীয় সংসদ, নির্বাহী বিভাগ এবং পৃথক বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা তিনি করেছিলেন। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রের পরিচয় বহনকারী জাতীয় সংগীত (আন্তর্জাতিক স্টাফ নোটেশনসহ), জাতীয় পতাকা (সেজন্য বিধি) এবং জাতীয় প্রতীক—এগুলো তিনি আমাদের দিয়ে গিয়েছেন। এগুলোর পাশাপাশি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে দেশকে পুনর্গঠন করতে যে ভৌত অবকাঠামো প্রয়োজন সেটিও বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়ে গেছেন। আজকের বাংলাদেশে আমরা যেসব সুযোগ-সুবিধা এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাই, তার সবই বঙ্গবন্ধুর কীর্তি। জাতিসংঘ এবং এর সব সংস্থার সদস্যপদ অর্জন, পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং রাষ্ট্রের জন্য একটি চমত্কার বৈদেশিক নীতি (‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’) প্রণয়নও বঙ্গবন্ধুর অবদান। সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী প্রতিষ্ঠা, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সম্পাদিত ভারতের সঙ্গে ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তি, সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে আইন, যা জাতিসংঘ করেছে আরো অনেক পরে, ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তি, শেল অয়েল কোম্পানি থেকে গ্যাস ফিল্ড ক্রয় করে দেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদের ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার জন্য আইন প্রণয়ন, প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলককরণ, ২৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ—এগুলো অবিস্মরণীয় কীর্তি।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ক্যারিশমা (সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব) এমন উচ্চস্তরের ছিল যে তিনি শুধু সার্থক সরকার পরিচালকই ছিলেন না, একজন বিশ্ববিখ্যাত রাষ্ট্রনায়কও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু এত উঁচু মাপের বিশ্বনেতা ছিলেন যে তাকে স্বয়ং ব্রেজনেভ, কোসিগিন, টিটো, বুমেদিন, ফিদেল কাস্ত্রো, এডওয়ার্ড হিথ, সুকর্ন প্রমুখ নেতারা উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সত্যিই বঙ্গবন্ধুর তুলনা বঙ্গবন্ধু নিজেই। যুগ যুগ ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাকে শ্রদ্ধায় আর ভালোবাসায় স্মরণ করবে। তার জীবনের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা থেকে পাঠ নেবে।

আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন তাহলে ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে আসা বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতো। ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর’ যে ব্রত নিয়ে জাতির পিতা রাজনীতি শুরু করেছিলেন এবং আজীবন বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য তার যে দরদ তার প্রতিফলন ঘটেছিল তিনি দেশে ফিরে আসার পর পরই। তার প্রতিটি বক্তব্য এবং কার্যক্রম ছিল দেশে দারিদ্র্য বিমোচন এবং ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ। এজন্যই তিনি প্রণয়ন করেছিলেন প্রথম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনা। তার পুনর্বাসন পরিকল্পনা এবং দেশ পুনর্গঠনের জন্য যে রোডম্যাপ তিনি প্রণয়ন করেছিলেন, তার মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে যত দ্রুত সম্ভব একটি আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা। তার সে স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করতে পারেননি বটে; কিন্তু তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালের মে মাসে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে প্রথমেই যে লড়াই শুরু করেন তা ছিল বাংলার সাধারণ মানুষের জন্য ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা। পিতার মতোই তিনি বাংলাদেশের সব প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে বেড়িয়েছেন মানুষের বুকে সাহস ফিরিয়ে আনতে এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে তার হারানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে। তার সুযোগ্য নেতৃত্ব, কঠোর পরিশ্রম, প্রজ্ঞা এবং পিতার আদর্শ অচিরেই বাংলাদেশে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং এক সময় তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন। প্রতিক্রিয়াশীল এবং বাংলাদেশ বিরোধীদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে তিনি আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় আসীন করেন ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এ সময়টি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণ যুগ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে এবং চিন্তাভাবনাকে ধারণ করে তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন এক নতুন উচ্চতায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ যে গতিতে এগিয়ে চলেছে তা অনেকের কাছেই ঈর্ষণীয়। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় প্রদান এবং তাদের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা করা ছিল মানবিকতার এক নতুন দৃষ্টান্ত। প্রায় এক বছর ধরে বিশ্বব্যাপী চলমান ভয়াবহ করোনাভাইরাসের মহামারী এক কঠিন সমস্যা। তারও চমত্কার মোকাবেলা বাংলাদেশ করতে পেরেছে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা নিজে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশ তার আদর্শের আলোকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। (সংক্ষেপিত)

[সৌজন্যে: উত্তরণ (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র)]

 এইচ টি ইমামপ্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা

জানুয়ারি ১০, ২০২১ | Source: Banik barta | Link

আরও পড়ুন