বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাস্বপ্ন

সম্পাদনা/লেখক: Zakir Hossain

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর এই সময়ে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মুহূর্তে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন দেশ উপহার দিয়ে গেছেন বলেই আজ স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা নিজ দেশে বসবাস করার সুযোগ পেয়েছি। সারা পৃথিবীতে আমরা স্বতন্ত্র পরিচয় নিয়ে বিচরণ করি। একই সঙ্গে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে ত্রিশ লাখ মানুষ বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়ে গেছে; তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

যখন পেছনে ফিরে তাকাই অনেক কিছুই স্মৃতিতে ভেসে আসে। স্বাধীন বাংলাদেশ। রাষ্ট্রীয় কোষাগার একেবারে শূন্য। দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে গিয়েছে পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী। সেই জায়গায় বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করলেন। তখন বহু বৈপ্লবিক পরিবর্তন, বহু বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত তিনি নিয়েছিলেন।

এর মধ্যে একটি হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করা। বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবেই মনে করতেন যে, একটা দেশের ভিত রচনা করে তার শিক্ষাব্যবস্থা। সেই সময়ে যখন মানুষের অন্নের অভাব, বস্ত্রের অভাব, বাসস্থানের অভাব, চিকিৎসার অভাব; এই অভাবের মাঝেও তিনি মনে করলেন যে সুশিক্ষার দরকার আছে এবং এর জন্য শুরু করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে। তিনি বাংলাদেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণের আওতায় নিয়ে এলেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হলেও প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সব রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর ন্যস্ত করলেন। একই সঙ্গে তিনি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক করে দিলেন। বাধ্যতামূলক ঘোষণা দিয়ে তিনি বসে থাকলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেটিকে অবৈতনিক করে দিলেন। কারণ তিনি জানেন যে বাংলাদেশে বহু পরিবার আছে যাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানোর মতো আর্থিক সংগতি নেই। অতএব এটাকে অবৈতনিক না করলে বাধ্যতামূলক অর্থপূর্ণ হয় না। অতএব তিনি অবৈতনিক করলেন। একই সঙ্গে আবার তিনি বলে দিলেন, প্রাথমিক শিক্ষা হবে একমুখী। স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী শিক্ষা। বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি সমন্বয়ে যে শিক্ষা কার্যক্রম সেটি চালু করার জন্য তিনি নির্দেশ দিলেন। দেশে একমুখী শিক্ষা দিয়ে তিনি যে দর্শন আমাদের সামনে উপস্থিত করলেন, যেটি বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের দর্শন। সামনের বাংলাদেশ, মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ। সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ। এগুলো আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা। সেই ঘোষণায় স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা আছে যেটি বঙ্গবন্ধুর জীবন দর্শনের মধ্যে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু শিশুদের একই শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। কারণ শিশুদের মনে যেন কোনো বৈষম্যবোধ সৃষ্টি না হয়। যে বিত্তবান পরিবারের ছেলেমেয়েরা এক ধরনের স্কুলে যাচ্ছে। বিত্তহীন পরিবারের ছেলেমেয়েরা আরেক ধরনের স্কুলে যাচ্ছে। এই ধরনের কোনো বৈষম্য থাকবে না। বিত্তবান বিত্তহীন নির্বিশেষে সব শিশু একই পোশাকে একই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেএটি ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন।

শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন তা বোঝা যায় যখন তিনি ড. কুদরত-এ খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। শিক্ষা কমিশনকে তিনি বলেন, আপনারা আমাকে একটি স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষাব্যবস্থা সুপারিশ করেন। ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ১৯৭৪ সালে সম্ভবত ৭ জুন তারিখে বঙ্গবন্ধুর হাতে সেই সুপারিশ হস্তান্তর করে। বঙ্গবন্ধু সেদিন এই খসড়া রিপোর্ট গ্রহণ করে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমি অতি দ্রুত এই শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করব।

এই রিপোর্টে মূল যে পরিবর্তনের কথাগুলো বলা হয়েছিল সেটি ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষা প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত থাকবে। প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি যে শিক্ষাটি এটি সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একই পাঠ্যক্রমে চলবে। একমুখী শিক্ষা হবে। বঙ্গবন্ধুর যে ইতিপূর্বে ঘোষণা দেওয়া প্রাথমিক শিক্ষা হবে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক ও একমুখী। এই তিনটি বৈশিষ্ট্যই প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কার্যক্রমে থাকতে হবে এই ছিল কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশনের সুপারিশ। নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা। এই নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা এটি সাধারণ শিক্ষার কার্যক্রমে থাকবে। ছেলেমেয়েদের যাদের ইচ্ছা তারা কারিগরি শিক্ষায় যাবে, ধর্মীয় শিক্ষায় যাবে। এইখানে এসে একটি অপশন বা তাদের পছন্দ অনুযায়ী একটি ধারা নির্বাচনের একটি সুযোগ দেওয়া ছিল। পরে মাধ্যমিক পর্যায়ে নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির লেখাপড়া শেষ করে কেউ যদি উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী হয় তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ ছিল। ১৯৭৪ সালেই স্বাধীন বাংলাদেশে যে সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল সেটি আজ উন্নত বিশ্ব যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থা সাজিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে সেইরকম একটি শিক্ষাব্যবস্থার সুপারিশ করেছিল কুদরত-এ-খুদার সেই শিক্ষা কমিশন।

সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটি বুঝা যায় যে, প্রজাতন্ত্রের শিক্ষা খাতে যত বরাদ্দ থাকবে তার ৬৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে। ২০ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এবং ১৫ শতাংশ বরাদ্দ করতে হবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে যদি আমরা পিরামিড চিন্তা করি তাহলে পিরামিডের ফাউন্ডেশন বা ভিত সেটা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। অতএব সেখানে প্রজাতন্ত্রের আর্থিক বরাদ্দের সর্বোচ্চ বরাদ্দ সেই জায়গায় দরকার আছে। কারণ এখানে প্রজাতন্ত্রের সব শিশু বাধ্যতামূলকভাবে যাচ্ছে। অতএব সব শিশুকে মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়াটা এটা প্রজাতন্ত্রের দায়িত্ব এবং বঙ্গবন্ধু সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যাকান্ডের শিকার হলেন। বঙ্গবন্ধু যে কথা বলেছিলেন, শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট আমি অত্যন্ত দ্রুত বাস্তবায়ন করব, সেটি আর বঙ্গবন্ধু বাস্তবায়ন করতে পারলেন না। বঙ্গবন্ধুর পর বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরাই যেহেতু এ দেশ পরিচালনা করছে দশকের পর দশক অতএব কুদরত-এ-খুদার শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি। এটাই হলো বাস্তবতা। পরে আমরা দেখেছি ১৯৭৫ থেকে ২০১০ এই পুরোটা সময় আমাদের দেশে কোনো শিক্ষানীতি ছিল না। অবশেষে ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একটি শিক্ষানীতি চূড়ান্ত করে জাতিকে উপহার দিলেন। এখন আমরা সেই শিক্ষানীতি নিয়ে এগিয়ে চলছি।

আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর কুদরত-এ-খুদা কমিশনের শিক্ষা রিপোর্ট সেই সময়ে বাস্তবায়ন করতে পারতাম দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আজ ২০২১ সালে এসে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় ধরনের উন্নয়ন আমরা লক্ষ করতাম। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে যেমন গুরুত্ব দিতেন সেইভাবে তিনি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের ভালোবাসতেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। তিনি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মাধ্যমে গোটা দেশের শিক্ষা কার্যক্রম নতুন করতে সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে কেরানি বানানোর শিক্ষার যে পদ্ধতি, সেটা আমি থাকতে দেব না। এটা পরিবর্তন করতে হবে। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার যে সম্প্রসারণ ঘটানো, এটার জন্যও বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের দেশে বিএ এমএ পাস বেকার লোকের সংখ্যা অসংখ্য। এটা নিয়েও বঙ্গবন্ধু কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কেরানিগিরির শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার প্রসারে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় তিনি কোনোরকম কেক কেটে বা অনুষ্ঠান করে জন্মদিন উদ্যাপন করতেন না। তিনি শিশুদের নিয়ে জন্মদিনে আনন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের দিনটিই এখন আমাদের জাতীয় শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধু সব সময়ই শিশুবান্ধব একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন।

আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক : শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য। চেয়ারম্যান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং সভাপতি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর।

সূত্র: দৈনিক দেশরূপান্তর | ১৭ মার্চ, ২০২১ লিঙ্ক

আরও পড়ুন