আরশাদ আলী: যার হাত ধরে মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামাল

সম্পাদনা/লেখক: আব্দুল্লাহ আল মামুন

 

কিছুই চাই না, চাওয়া শুধু শেখ কামালকে ভারতে পৌঁছে দেয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনি শেখ হাসিনাকে শোনানো: মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুপুত্রকে গোপালগঞ্জ থেকে ভারতে নিয়ে যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আরশাদ আলী।

আরশাদ আলী, বয়স ৮৩। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হলেও তেজোদীপ্ত তিনি।

১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চ মাসের শেষে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী থানার চাপতা বাজার থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে রাজাকারের চোখ এড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামালকে সঙ্গে করে নিয়ে যান ভারতে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে অনেক জায়গায় যুদ্ধ করে দেশকে করেছেন স্বাধীন।

সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম নারায়ণপুর গ্রামে বেড়ে ওঠা মানুষটির আশা, তিনি শেখ কামালের বোন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিজের মুখে শোনাতে চান উত্তেজনায় ঠাসা সেই কাহিনি।

ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট ওয়ার কোর্স’-এর কমিশন পান শেখ কামাল। তিনি যুদ্ধ চলাকালে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেননি। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তার মুক্তিযুদ্ধের বীরোচিত ভূমিকা স্মরণ করে সনদ তৈরি করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় আরশাদ আলীর বয়স ছিল ৩৪ বছর। অভাব আর অনটনে খুব বেশি দূর এগোয়নি লেখাপড়া। জীবিকা অর্জনে খুলনা থেকে সার এনে বিক্রি করতেন।

আরশাদ আলীই ভারতে পৌঁছে দিয়েছিলেন শেখ কামালকে। ছবি: নিউজবাংলা

 

সে সময় গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার চাপতা গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান মিনার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় তার। যুদ্ধের মধ্যেই বেড়াতে যান ওড়াকান্দি গ্রামের ঠাকুরবাড়িতে।

তখন ঠাকুরবাড়ির লোকজনই শেখ কামালকে নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দিতে বলেন আরশাদ আলীকে। পরদিন ভোরেই শুরু করেন তার বিপজ্জনক যাত্রা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের পর ধানমন্ডি ১৮ নম্বরের বাসায় বন্দি করা হয় তার পরিবারকে। কড়া নজরদারির মধ্যেও শেখ কামাল ও শেখ জামাল পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।

আরশাদ আলী জানান, তাদের যাত্রার শুরুতে পাসকার নদী পার হন। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আর রাজাকারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে নড়াইল জেলার সীমান্ত এলাকা গাজীরহাটে পৌঁছেন।

এই নদী পার হয়ে শেখ কামালকে নিয়ে রওনা হয়েছিলেন ভারত সীমান্তের দিকে। সেটাই দেখাচ্ছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। ছবি: নিউজবাংলা

 

পরদিন আবার যাত্রা শুরু করে পানকার নদী পেরিয়ে চর বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে যশোর, খুলনা ও গোপালগঞ্জের সীমান্ত গাজীরহাটে আসেন।

সে সময় পরিচয় ঘটে একই এলাকার চেয়ারম্যান হামু চেয়ারম্যানের সঙ্গে। তার সহায়তায় তারা রেলগেট থেকে সুশীলগাতি হয়ে দৌলতপুরে আসনে।

সেখান থেকে খুলনার গল্লামারী গণরেডিও সেন্টারের পাশ দিয়ে কৈয়া বাজারের আগের একটি পথ বেয়ে বেলা আড়াইটার দিকে বটিয়াঘাটা এলাকার সরাফপুর পৌঁছেন।

সেখান থেকে তারা নৌকায় খুলনার পাইকগাছার উদ্দেশে রওনা দেন। পথে কাটাখালীতে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। সেখানে পরিচয় গোপন করে টাকা-পয়সা দিয়ে ছাড়া পান।

সাতক্ষীরায় বাড়িতে গেলে এই তিন ভাই মিলেই কড়া নিরাপত্তায় রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু পুত্রকে। ছবি: নিউজবাংলা

 

এর পর শেখ কামালের ঠিকানা হয় সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের পাইকাড়া গ্রামের ঠান্ডাই গাজীর বাড়ি। এক সপ্তাহ সেই বাড়িতে ছিলেন তিনি।

ঠান্ডাই গাজী ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ। বঙ্গবন্ধুর ছেলের নিরাপত্তায় তাকে রক্ষা করতে রাইফেল নিয়ে পালাক্রমে ডিউটি করতেন তার তিন ছেলে।

ঠান্ডাই গাজীর ছোট ছেলে মোকসেদ গাজী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ছেলে আমাদের এখানে আসার পরে আমরা খুব শিহরিত হয়েছিলাম। পাশাপাশি তাকে নিরাপত্তা দিতে দিনে বাড়িতে ও রাতে নির্জন বাগানে রাখতাম।

‘তিনি (শেখ কামাল) খুব রসিক মানুষ ছিলেন। আমাদের কাছে তিনি সাত দিন ছিলেন। আমরা তিন ভাইয়ের যেকোনো একজন তার সঙ্গে বন্দুক নিয়ে থাকতাম।’

এক সপ্তাহ পরে আরশাদ আলী শেখ কামালকে নিয়ে ছোটেন সীমান্তের দিকে। দেবহাটা উপজেলার ছুটিপুর ঘাট দিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার জন্য নাংলা গ্রামে অবস্থান নেন।

সন্ধ্যা নাগাদ তাকে সীমান্ত পার করে ভারতের হাসনাবাদে ৯নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নুরুল হুদার কাছে পৌঁছে দেয়া হয় শেখ কামালকে। দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজ সারেন দেবহাটার নাংলা গ্রামে।

 

কালীগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ও মার্কেটের ভিত্তিপ্রস্তরের একটি ফলক।

 

গৃহবধূ মোমেনা খাতুন পুকুর থেকে ধরা মাছ রান্না করে খাইয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছেলেকে। সঙ্গে ছিল ডিম আর ডাল।

এই বাড়িতে বিশ্রাম শেষে সন্ধ্যার দিকে চলে যান শেখ কামাল।

নাংলা গ্রামের ফজর আলী বলেন, ‘তাকে আমরা চিনতে পারিনি। যখন খাওয়া ও বিশ্রাম শেষে আমরা তাকে ঘাটে নিয়ে যাই, তখন নৌকায় উঠে তিনি পরিচয় দেন, তিনি শেখ কামাল, শেখ মুজিবর রহমানের ছেলে।’

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা উপজেলা কমান্ডের ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল ঠান্ডা গাজীর বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন। তিনি কালীগঞ্জে থেকেছিলেন এবং তাকে সহযোগিতা করতে পেরে কালীগঞ্জবাসী ধন্য।’

শেখ কামালের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল এই মুক্তিযোদ্ধাদেরও। শোনাচ্ছিলেন সে সময়ের অনেক কথা। ছবি: নিউজবাংলা

 

বীর মুক্তিযোদ্ধা আরশাদ মোড়ল নিউজবাংলাকে বলেন, তিনি যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। সম্মানীও পান। ছেলে-মেয়েরাও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এখন চাওয়া শুধু একটাই। শেখ কামালকে ভারতে পৌঁছে দেয়ার সেই গল্পটাই সামনে থেকে শোনাতে চান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে।

 

ফিকুল ইসলাম শাওন , সাতক্ষীরা

৫ মার্চ, ২০২১ ২২:০৯ লিঙ্ক

আরও পড়ুন