একাত্তরের মার্চে ২৫ দিন বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে শেখ মুজিব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শাসন করেন। শত্রুর হাতে বন্দি থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের রাষ্ট্রপতি। বন্দি মুজিবের নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধারা হাসতে হাসতে জীবন দান করেছেন।
একবার একজন বিদেশি সাংবাদিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার গুণ কী?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি।’ সাংবাদিক আবার প্রশ্ন করেন, আপনার খারাপ গুণ কী? বঙ্গবন্ধুর ত্বরিৎ জবাব, ‘আমি তাদেরকে বেশি ভালোবাসি।’
একাত্তরের ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে ৩২ নম্বর বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার জন্মদিনই কী আর মৃত্যুদিনই কী। আমার জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু। আপনারা আমার জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনো মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে।’
বঙ্গবন্ধুর মধ্যে এতসব রাজনৈতিক গুণাবলির সমাহার ছিল, যা আর কোনো নেতার মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন ব্যতিক্রম। যা বা যতটুকু করতে পারবেন, ততটুকুই বলতেন। যেমন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় জনগণকে বলেছেন- ‘আমি তিন বছর কিছু দিবার পারব না।’ যদিও তিনি অনেক কিছুই দিয়েছিলেন। এই যে তিনি বললেন, জনগণই আমার জীবন ও মৃত্যু। এটা বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনে বার বার প্রমাণ করে গেছেন। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক জান্তার হুমকি-ধামকি, কামান-বন্দুক-মেশিনগানের মুখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে স্বাধীনতার উন্মুক্ত ঘোষণা দিয়েছিলেন, তার কি কোনো তুলনা হয়?
বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া তার আত্মজীবনীমূলক ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ৭ মার্চ ভাষণ শেষে রাতে খাবার টেবিলে বঙ্গবন্ধু বলেন- ‘তোমরা এখন থেকে প্রতিদিন দু বেলা আমার সঙ্গে খাবে। যেকোনো সময় ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে।’ ওইদিন ভাষণেও তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা রাস্তাঘাট সবকিছু বন্ধ করে দেবে।’ এমন আশঙ্কাও অনেকের মধ্যে ছিল, ৭ মার্চ ভাষণের আগেই বঙ্গবন্ধুকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়া হবে।
২৫ মার্চ কালরাতে নেতাকর্মীদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনাবলি দিয়ে বঙ্গবন্ধু ৩২ নম্বর বাসভবনেই থেকে গেলেন। আত্মগোপন সম্পর্কে নেতা ও শুভানুধ্যায়ীদের অনুরোধ, আবেদন-নিবেদনের জবাবে তিনি একটি কথাই বলেছেন- আমি আত্মগোপনে গেলে আমার সন্ধান না পেয়ে পাকিস্তানিরা আমার হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করবে। নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু সে রাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
৫২তম জন্মদিনে বঙ্গবন্ধুর আরেকটি কথা ‘জনগণের জন্যই আমার জীবন ও মৃত্যু’। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুজিবের জীবনের মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তিনি এটাও জানতেন, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন একটি অসাধ্য কাজ। প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর কোনো ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবন ছিল না। পৃথিবীতে আর কোনো নেতা ৫২ বছরের জীবনে ১২ বছর কারাবরণ করেছেন কি না সন্দেহ। তিনি কোনোদিন আত্মগোপনে যাননি। জনশ্রুতি আছে, জেল জীবনের জন্য একটি ছোট্ট বেডিং সবসময় তৈরি থাকত।
এর আগে পাকিস্তানিরা যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেয়। কয়েক মাসের মন্ত্রিত্ব শেষে সেগুনবাগিচার দিকে একটি বাসায় উঠেছেন। পুলিশ বাসায় আসে। তিনি তখন বাসায় ছিলেন না। বাসায় ফিরে শোনেন তার খোঁজে পুলিশ এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার পুলিশ কমিশনারকে ফোন করেন, আমি এখন বাসায়। পুলিশ এসে তাকে কারাগারে নিয়ে যায়। সামরিক সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় এবং একাত্তরে স্বাধীনতা ঘোষণার দায়ে লায়ালপুর জেলে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। আপসের পরিবর্তে দুবারই তিনি ফাঁসির মঞ্চকে বেছে নেন। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, সাহস, জনপ্রিয়তা, জনগণের প্রতি ভালোবাসা, দেশপ্রেম, রাজনৈতিক কৌশল, মানবপ্রেম, সততা ইত্যাদি গুণাবলি নিয়ে বহু বই রচনা করা যাবে।
বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৭১ সালে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে তিনি স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেন। একটি সামরিক সরকার বহাল থাকা অবস্থায় একাত্তরের মার্চে ২৫ দিন বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে শেখ মুজিব তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শাসন করেন। শত্রুর হাতে বন্দি থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকারের রাষ্ট্রপতি। বন্দি মুজিবের নামেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধারা হাসতে হাসতে জীবন দান করেছেন।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় দূরদর্শী ও সাহসী নেতৃত্ব এবং অতুলনীয় রাজনৈতিক গুণাবলির জন্য বিবিসির বাংলাভাষী বিশ্বব্যাপী শ্রোতা জরিপে ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর অনন্য গুণাবলি র দিকে একটু আলোকপাত করা যাক।
১৯৭০ সালের পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৬৯টি আসনের মধ্যে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পায়। প্রাদেশিক পরিষদ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন আওয়ামী লীগ পায়। আর কোনো নেতা তার দেশের কোনো নির্বাচনে এত বিপুল সমর্থন পাননি।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ’৭১ অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শুরু হয় শেখ মুজিবের নির্দেশে অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ ’৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবের বক্তৃতা স্মরণকালের বা ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম বক্তৃতা। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চেয়েছিল তিনি যেন ঐদিন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
অপরদিকে সামরিক কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় রেসকোর্সের ময়দানে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে জনসভায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়া হবে। এই পরিস্থিতিতে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু সরাসরি যেমন স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি- আবার স্বাধীনতা ঘোষণার বাকিও রাখেননি।
৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী আলাউদ্দিন আল আজাদ তার লেখা ‘ফেরারী ডায়েরী’ গ্রন্থে লিখেছেন:
“মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দলিল, লিংকনের গৃহযুদ্ধ ভাষণের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এবং শুধু ভাষণ হিসেবেও- এমনি অনবদ্য যে, তা নিঃসন্দেহে বিশ্বের দশটি শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণের অন্যতম। এই ভাষণ শুধু যেন ভাষণ নয়- এক বীজমন্ত্র, যা কোটি কোটি মানুষকে শুধু উদ্দীপ্ত করেনি, এক কঠিন সংগ্রামের দিকে পরিচালিত করেছে। যেন কোনো ব্যক্তি নয়, একটা আলোড়িত জাতির মর্মমূল থেকে এই ভাষণের উৎপত্তি- প্রাকৃতিক ঘটনার মতো।”…
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী বাঙালি জাতির ওপর সশস্ত্র হামলা করলে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১ মার্চ ’৭১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিকশাসন কার্যত অচল হয়ে যায়। এই ২৫ দিন প্রকৃতপক্ষে দেশ পরিচালনা করেছেন শেখ মুজিব। গভর্নর হাউজ নয়, বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাসভবনই ছিল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। পাকিস্তানি নেতা খান মো. ওয়ালী খান বলেছেন-
“শেখ মুজিবের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের চেয়েও শক্তিশালী।”
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকারের জনসংযোগ কর্মকর্তা মেজর সিদ্দিক সালেক তার লেখা ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থে লিখেছেন : ‘অসহযোগ আন্দোলনের সময় মুজিবের শাসন সারা পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করে।’ পাকিস্তানি নেতা আসগর খান ’৭১-এর মার্চে পূর্ব পাকিস্তান সফরের পর বলেছিলেন, ‘ক্যান্টনমেন্ট ও প্রেসিডেন্ট হাউজ ছাড়া কোথাও পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়তে তিনি দেখেননি।’ তখন পূর্ব পাকিস্তানের সকল মানুষ বঙ্গবন্ধুর কথা শুনেছেন। যেমন- ৭ মার্চ, ১৯৭১ টিক্কা খান গভর্নর হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে আসেন। কিন্তু হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি বি.এ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে শপথ গ্রহণ করাননি। আরও একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য, ৭ মার্চ ’৭১ পূর্ব পাকিস্তান বেতার কেন্দ্র থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ সরাসরি প্রচার করতে চেয়েছিল। কিন্তু সামরিক সরকার সেই ভাষণ প্রচার করতে না দেয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতারের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। পরদিন ৮ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করার অনুমতি দেয়ার পর সেই ভাষণ প্রচারের মাধ্যমে বেতার কার্যক্রম শুরু হয়। ’৭১-এর ৫ মার্চ লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় বলা হয়- ‘শেখ মুজিবই হচ্ছেন বিদ্রোহী পূর্ব বাংলার শাসক।’ ১৯৭১ সালের ১২ মার্চ ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় :
“জনগণের আস্থাভাজন শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে হয়। ইতোমধ্যে তার ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রাস্তায় অবস্থিত বাড়িকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থানের অনুকরণে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট বলে উল্লেখ করা হয়েছে।”
আজকের এই বাংলাদেশের স্বাধীন হওয়ার আগে নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান। বাংলাদেশ নামকরণ বঙ্গবন্ধুই করেন। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন যে, ‘আজ হতে এ অঞ্চলের নাম হবে বাংলাদেশ।’
১৯৭১ সালে নয় মাস যুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানে কারাগারে বন্দি। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হয়। কারণ হলো, শত্রুর কারাগারে বন্দী হওয়া সত্ত্বেও সে সময় মুজিবের মতো জনপ্রিয় অন্য কোনো নেতা আওয়ামী লীগে বা বাংলাদেশে ছিলেন না। আওয়ামী লীগবিরোধী বলে পরিচিত বর্তমানে বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তার লেখা গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন-
“নেতৃবৃন্দ জানতেন যে একমাত্র শেখ মুজিবের নামে সংগ্রাম পরিচালনা করলেই জনগণের সমর্থন অর্জন করা সম্ভব। এটা ছিল বাস্তবিক অর্থে বিস্ময়কর যে শেখ মুজিব পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হলেও এবং নিজে গ্রেপ্তার বরণ করলেও তার জনপ্রিয়তা ও ভাবমূর্তি ছিল অটুট। এভাবে এমন একজনের নামে নয় মাসব্যাপী সংগ্রাম পরিচালনা করা হয় যিনি স্বয়ং সংগ্রামে উপস্থিত ছিলেন না এবং কোনোদিন নিজ বাসভূমিতে ফিরে আসবেন এমন নিশ্চয়তা ছিল না। মুজিবের জীবনে এটাই ছিল সর্বোচ্চ সাফল্য।” (শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল)
এ কথা ঠিক একাত্তরে নয় মাস পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নামে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দেশের বিবেক বলে পরিচিত আবুল ফজল লিখেছেন-
“আজ আমরা যে নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতে সাহস পাচ্ছি এও শেখ মুজিবেরই অবদান। তাঁর দুঃসাহসী কণ্ঠই আমাদের কণ্ঠে এ দাবি তুলে দিয়েছে। আমরা আজ বন্ধনমুক্ত। আজ এ কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত যে, এহিয়া-টিক্কা-ভুট্টোর কারাগারে বন্দী শেখ মুজিব মুক্ত শেখ মুজিব থেকে কিছুমাত্র কম শক্তিশালী নয়। দেড় হাজার মাইলের দূরবর্তী জিন্দানখানা থেকে তিনি অর্থাৎ তাঁর নাম, তাঁর আদর্শ আর তাঁর আত্মা-পুরুষই যেন ন’মাস ধরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে জুগিয়েছে মরণ-পণ সংগ্রামের প্রেরণা। যে প্রেরণা অজেয় শক্তি হয়ে আমাদের জন্য ছিনিয়ে নিয়ে এনেছে স্বাধীনতাকে- পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের নির্মম কবল থেকে। অনুপস্থিত সেনাপতির এমন সেনাপতিত্ব সত্যই অভিনব, ইতিহাসে এমন নজির বিরল।” (দুর্দিনের দিনলিপি)
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসম সাহসী নেতা। তাকে হত্যা করতে পারে এটা প্রায় নিশ্চিত জেনেও তিনি আত্মগোপন না করে ’৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতা ঘোষণার পর শত্রুর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, তিনি পালিয়ে থাকলে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী তার খোঁজ করতে গিয়ে ঢাকায় শত শত লোককে হত্যা করত। তাছাড়া ’৭১ সালে পাকিস্তানি কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি আদায় করতে পারেনি। জেলখানায় সেলের সামনে কবর খুঁড়লেও বঙ্গবন্ধু ভীত হননি। তিনি ওদেরকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘আমার লাশটা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার ব্যাপারেও বঙ্গবন্ধু দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান হানাদারবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির উপর সশস্ত্র হামলা চালানোর পর গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এর আগে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন পাওয়া যেত না।
উল্লেখ্য, তৎকালীন মার্কিন ও চীন সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করলেও সঠিক সময়ে স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার কারণে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই মাত্র নয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ নেতৃত্বের জন্য ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’ তাকে ‘রাজনীতির কবি’ বলে উল্লেখ করে। একজন কূটনীতিকের উদ্ধৃতি দিয়ে উক্ত ম্যাগাজিনে লেখা হয় : “একাকী শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলার সময়েও মনে হয় তিনি যেন ৬০ হাজার লোককে সম্বোধন করে বক্তৃতা দিচ্ছেন। উর্দু, বাংলা ও ইংরেজি- পাকিস্তানের তিনটি ভাষায় তার পটুত্ব আছে। নিজেকে মৌলিক চিন্তাবিদ বলে ভান করেন না মুজিব। শেখ মুজিব রাজনীতির কবি-প্রকৌশলী নন, তবে বাঙালিরা যত না প্রায়োগিক, তার চেয়ে শৈল্পিক বেশি। কাজেই, এই অঞ্চলের সকল শ্রেণি ও মতাদর্শকে ঐক্যবদ্ধ করতে যা প্রয়োজন, বঙ্গবন্ধুর রীতিতে হয়তো ঠিক তাই আছে।”
সততার দিক দিয়েও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারো তুলনা হয় না।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন সমগ্র বিশ্বের দু’চার পাঁচজন জনপ্রিয় নেতার অন্যতম। ’৭০-এর নির্বাচনে তৎকালীন পূর্ব বাংলার শতকরা ৯০ জনেরও বেশি মানুষ শেখ মুজিবের নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন-
“শেখ মুজিবুর রহমানের মতো জনপ্রিয় নেতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই অসামান্য জনপ্রিয়তা এমনিতেই আমলকির মতো এসে যায়নি তাঁর হাতের তালুতে। যদি আমরা তাঁর রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব কী করে তিনি নিজেকে ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করে গেছেন। এসব কিছুর পেছনেই ছিল ঐকান্তিক দেশপ্রেম এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসা।”…
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যত নিবন্ধ, প্রবন্ধ, কবিতা, বই, গান লেখা হয়েছে- বিশ্বের আর কোনো নেতাকে নিয়ে এত লেখালেখি হয়েছে কি না সন্দেহ। বাঙালি কবি অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থই বলেছেন :
“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার
শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ রক্তগঙ্গা
অশ্রুগঙ্গা বহমান
তবু নাহি ভয় হবে হবে জয়
জয় মুজিবুর রহমান।”
লেখক নিরঞ্জন মজুমদার তার গ্রন্থে লিখেছেন : “কোনো নেতার জীবনকালে তাঁর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিত্ব গুণের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব নয়। বলেছেন অনেক খ্যাতনামা জীবনীকার। তবু নিজের জীবনকালেই কেউ কেউ অত্যাশ্চর্যভাবে কোনো দেশ বা তার ইতিহাসের মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছেন ভবিষ্যতের সমালোচনা ও মূল্যায়নের পরোয়া না করেই। যেমন ভারতের গান্ধী, মিসরের নাসের, ভিয়েতনামের হো চি মিন, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন, কেনিয়ার জোমো কেনিয়াত্তা, চীনের মাও সেতুং, রাশিয়ার লেনিন এবং আরও কেউ কেউ। আজ বাংলাদেশে মুজিবও তাই।” (বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা, মুক্তধারা, স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ, কলকাতা, ১৯৭১)
বঙ্গবন্ধু মুজিবই যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা একটি বিদেশি পত্রিকার উদ্ধৃতি থেকে সহজেই তা বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরদিন লন্ডনের এক পত্রিকায় লেখা হয় –
“সবকিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন- এ জন্যে যে, তাকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনও বাস্তবে পরিণত হতো না।” (টাইমস, ১৬.৮.১৯৭৫)
নিহত হওয়ার পর গত সাড়ে চার দশক ধরে বাংলাদেশে একটি মুজিবের পক্ষ, অপরটি মুজিবের বিপক্ষ- এই দুই পক্ষই বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। এতেই কি প্রমাণিত হয় না ‘মৃত মুজিব জীবিত মুজিবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী’।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন, বাংলাদেশ সৃষ্টিতে তার অবদান, তার নেতৃত্ব গুণ নিয়ে ইতোমধ্যে অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এখনও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। এ ক্ষুদ্র পরিসরে বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল মাপের মানুষ সম্পর্কে আলোচনা করা একেবারেই সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর সহজ সরল জীবন, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, সততা, অসম সাহসী নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা, সর্বোপরি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাঙালির ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। মুজিব জন্মশতবর্ষে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রাণঢালা শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানিয়ে প্রয়াত বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ হোসেনের একটি উদ্ধৃতি দিয়েই আজকের আলোচনার ইতি টানতে চাই। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু পরিষদ আয়োজিত এক স্মরণসভায় বিচারপতি হোসেন বলেন-
“যতদিন বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, যতদিন বাংলা থাকবে, বাঙালি থাকবে, গঙ্গা, যমুনা, পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র, ধলেশ্বরী, করতোয়া, কীর্তনখোলা নদীর দুই তীরের মানুষ যতদিন বেঁচে থাকবে, যতদিন এদেশের মানুষের হৃদয়ে উত্তাপ থাকবে, ততদিন অন্তরের মণিকোঠায় একটি নাম চির জাগরূক থাকবে- শেখ মুজিবুর রহমান।”
লেখক: মোহাম্মদ শাহজাহান, মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক; জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
নিউজ বানিউজ বাংলাদেশ ২৪, ১৮ মার্চ, ২০২১, লিঙ্ক