জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টার মৃত্যুর বহু বছর পর এটি প্রকাশিত হয় গ্রন্থাকারে। গ্রন্থটি মূলত ১৯৩৮-৩৯ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত সময়কালের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে লেখা।
১৯৬৭ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বন্দি অবস্থায় সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা ও বন্ধু-বান্ধবদের অনুরোধে নিজের জীবনী লেখা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কারাবন্দি অবস্থায় নিজের জীবনের কথামালা ডায়েরির পাতায় লিখেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিন পর ২০০৪ সালে সেই ডায়েরি আবিষ্কৃত হয়ে আসে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে। সেই ডায়েরির লেখা পাঠোদ্ধার করে প্রকাশ পায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী।
গ্রন্থটিতে আত্মজীবনী লেখার প্রেক্ষাপট, লেখকের বংশপরিচয়, জন্ম, শৈশব, স্কুল ও কলেজের শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দুর্ভিক্ষ, বিহার ও কলকাতার দাঙ্গা, দেশভাগ, কলকাতাকেন্দ্রিক প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতি, দেশবিভাগের পরবর্তী সময়ে থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন, ভাষা আন্দোলন, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন, আদমজীর দাঙ্গা, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসন ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বিস্তৃৃত বিবরণ এবং এসব বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা রয়েছে। ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক মানস-গঠন, নীতি-আদর্শ-নেতৃত্ব সম্পর্কে বিস্তৃত পরিচয়। গ্রন্থটিতে জেল ও জেলের বাইরের জীবন, মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান ও পরিবার-পরিজনের কথাও বলেছেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু অকপটে বলে গেছেন তাঁর জীবনকথা। শুরুতেই দিয়েছেন বংশপরিচয়।
এ গ্রন্থে সবচেয়ে বেশিবার এসেছে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা। বঙ্গবন্ধু তাঁকে শহীদ সাহেব বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি ছিলেন তাঁর রাজনীতির প্রেরণা। যাকে বলে রাজনৈতিক গুরু। গ্রন্থের শুরুতেই রয়েছে সরল-সত্য স্বীকারোক্তি। বঙ্গবন্ধু লেখেন, ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ছোট্ট কোঠায় বসে বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কথা। কেমন করে তাঁর সাথে আমার পরিচয় হলো। কেমন করে তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। কীভাবে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছিলেন এবং কেমন করে তাঁর স্নেহ আমি পেয়েছিলাম।’
১৯৩৮ সালের দিকে (১৮ বছর বয়স) যখন সোহরাওয়ার্দী তাঁদের স্কুল পরিদর্শনে আসেন তখন থেকে। তবে সরাসরি তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন ১৯৪১ সালে তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর থেকে। তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি পুরোপুরি মাঠপর্যায়ের কর্মী হিসেবে নিজেকে নিয়োজিত করেন। বঙ্গবন্ধু জানাচ্ছেন, রাজনীতি করতে গিয়ে পরিবার থেকে কখনোই বাধাপ্রাপ্ত হননি। বরং তাঁর বাবা তাঁকে সব সময় উৎসাহ জোগাতেন এবং স্ত্রীর কাছ থেকেও কখনো পিছুটান পেতে হয়নি। তিনি জানাচ্ছেন, তাঁর বাবা তাঁকে বলেছিলেন, “বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না,
পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, ‘sincerity of purpose and honesty of purpose’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না।”
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কথাও এসেছে বারবার। তৎকালীন সময়ে শেরেবাংলার জনপ্রিয়তা কেমন ছিল সেটা বোঝাতে একটি কথা উল্লেখ করেন তিনি। “এক দিনের কথা মনে আচ্ছে, আব্বা ও আমি রাত দুইটা পর্যন্ত রাজনীতির আলোচনা করি। আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে। একদিন আমার মা-ও আমাকে বলেছিলেন, ‘বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না।’ শেরে বাংলা মিছিমিছিই ‘শেরে বাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালোবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি।”
গ্রন্থটিতে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনীতির আরেক গুরু মওলানা ভাসানীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সময়ের রাজনৈতিক সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর খন্দকার মোশতাক আহমেদের উল্লেখও পাওয়া যায় প্রসঙ্গক্রমে।
আত্মজীবনীতে বাঙালির স্বভাব নিয়ে আত্মসমালোচনাও করেছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি লিখেছেন, “আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল ‘আমরা মুসলমান, আরেকটা হল, আমরা বাঙালি।’ পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বাসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধ হয় দুনিয়ার কোন ভাষায়ই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয় তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষায়ই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই, ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। সুজলা, সুফলা বাংলাদেশ সম্পদে ভর্তি। এমন উর্বর জমি দুনিয়ার খুব অল্প দেশেই আছে। তবুও এরা গরিব। কারণ যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদের মুক্তি আসবে না।”
বঙ্গবন্ধু খুব সুন্দর করে তাঁর ভ্রমণ বর্ণনা লিখেছেন। তাজমহলে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভেতরে যে রোমান্টিকতার প্রকাশ পেয়েছে তার সুনিপুণ বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সূর্য যখন অস্ত গেল, সোনালী রঙ আকাশে ছুটে আসছে। মনে হলো, তাজের যেন আর একটা নতুন রূপ। সন্ধ্যার একটু পরেই চাঁদ দেখা দিল। চাঁদ অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে আসছে আর সাথে সাথে তাজ যেন ঘোমটা ফেলে দিয়ে নতুন রূপ ধারণ করেছে। কী অপূর্ব দেখতে! আজও একুশ বৎসর পরে লিখতে বসে তাজের রূপকে আমি ভুলি নাই, আর ভুলতেও পারব না।’
ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই জড়িয়ে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। জেল খেটেছেন সেই আন্দোলনে। বাংলার পক্ষে যৌক্তিক ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন তিনি আত্মজীবনীতে।
‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ যখন প্রতিষ্ঠা হয় তখন বঙ্গবন্ধু জেলে। দল প্রতিষ্ঠার খবর পেয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, এখনো সময় আসে নাই, তাই বাইরে যারা আছেন তারা চিন্তা ভাবনা করেই করেছেন।’ স্মরণযোগ্য যে পরে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে মুসলিম বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হয়েছিল।
গ্রন্থের যে সময়কাল তার প্রায় অর্ধেক সময় বঙ্গবন্ধু জেলে পার করেছেন। বাঙালি জাতির রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে গিয়ে নিজের পরিবারকে যে বঞ্চিত করেছেন তা একটি মর্মস্পর্শী ঘটনার ভেতর দিয়ে ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একদিন সকালে আমি ও রেণু (বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা) বিছানায় বসে গল্প করছিলাম। হাচু (শেখ হাসিনা) ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর আব্বা আব্বা বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে, “হাচু আপা হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।’ আমি আর রেণু দুজনেই শুনলাম। আস্তে আস্তে বিছানা থেকে উঠে যেয়ে ওকে কোলে নিয়ে বললাম, ‘আমি তো তোমারও আব্বা।’ কামাল আমার কাছে আসতে চাইত না। আজ গলা ধরে পড়ে রইল। বুঝতে পারলাম, এখন আর ও সহ্য করতে পারছে না। নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়। আমি যখন জেলে যাই তখন ওর বয়স মাত্র কয়েক মাস।” সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছার কথা এসেছে নানাভাবে। ‘শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে’—এভাবেই ১৩ বছর বয়সে শিশু রেণুকে বিবাহ করার কথা বর্ণনা করেছেন বঙ্গবন্ধু।
১৯৫২ সালে চীনে শান্তি সম্মেলনে যোগ দিলেন বঙ্গবন্ধু। ৩৭৮ জন সদস্য ৩৭টি দেশ থেকে এসেছেন। বিভিন্ন দেশের নেতারা বক্তব্য দিচ্ছেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বঙ্গবন্ধু এবং আতাউর রহমান খান বক্তব্য দিলেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করলেন বাংলায়। আতাউর রহমান খান সেটা ইংরেজি করে দিলেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘ইংরেজি থেকে চীনা, রুশ ও স্প্যানিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে নাই। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ, আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষে লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।’
চীন ভ্রমণ নিয়ে লেখার শেষ পর্যায়ে সমাজতন্ত্রের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের উপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর।’
বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু সমার্থক। হাজার বছর ধরে বাঙালি যে স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখেছে তার সফল রূপায়ণ বঙ্গবন্ধুর হাতে। বাঙালির রাজনৈতিক উত্থান পর্বে জড়িয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও ভাবনার মিশেলে বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে।
২০১২ সালে গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ইউপিএল। গ্রন্থটি এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
২১ আগস্ট, ২০১৯ । সূত্র: জনকণ্ঠ লিঙ্ক