২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির সেই জঘন্যতম কালোদিন

সম্পাদনা/লেখক: Zakir Hossain

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার, সেদিনও প্রতিদিনের মতো খুব সকালে মসজিদ থেকে যখন মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে ভেসে আসছিল নামাজের জন্য, কল্যাণের জন্য আসার আহ্বান; ঠিক তখনই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গর্জে উঠে বিশ্বাসঘাতক নরপিশাচদের পৈশাচিক বুলেট। পাশবিক স্বশস্ত্র ঘাতক সেদিন শিশুপুত্র রাসেলসহ বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করেছিল। স্বদর্পে বিশ্বকে জানিয়ে দেয় তারাই এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। বাঙালির অধিকার ও মুক্তির আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু সারাটি জীবন ত্যাগ স্বীকার করে যে বাঙালিকে স্বাধীনতার বিজয়কেতন দিয়েছিলেন সেই বাঙালির মধ্যে লুকিয়ে থাকা দেশি-বিদেশী কুচক্রী ও স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা সেনাসমর্থিত খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়। খন্দকার মোশতাক ঐদিনই নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা করেন। এরপর ২০ আগস্ট সংবিধান বহাল রেখে সামরিক আইন জারি করা হয়।যার কার্যকারিতা দেয়া হয় ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল থেকে। যাতে মূলত সংবিধানকে সামরিক আইন, অধ্যাদেশ ও বিধির অধীনে আনা হয়। বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের তথাকথিত সরকার ছিল মূলত সেনাসমর্থিত পাকিস্তানপন্থী খুনি সরকার। এখানে উল্লেখ্য ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার মাত্র ৯ দিনের মাথায় ১৯৭৫ সালের ২৪ আগস্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন।

জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী প্রধান থাকা অবস্থায় অঘোষিত/স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সুরক্ষার জন্য ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যাকারীদের বিচার ও জবাবদিহিতা থেকে রক্ষার জন্য পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যাদেশটি জারীর মাধ্যমে এদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করেন সেনাসমর্থিত মোশতাক সরকার। যেকোনো হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য একান্ত জরুরি। সমাজ বা রাষ্ট্র যদি তা করতে ব্যর্থ হয় তবে তার দায়ভার বর্তায় গোটাজাতির উপরে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করে খুনিদের বিচারের পথ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারীর মাধ্যমে রুদ্ধ করে দিয়ে তাদেরকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে (যোগ্যতা না থাকা স্বত্বেও) পুর্নবাসিত করার সময়ে রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী, পেশাজীবী , সুশীল সমাজ ও বিবেকবান মানুষ হিসেবে আমরা কে কি দায়িত্ব পালন করেছিলাম এটি আজ আত্মজিজ্ঞাসা।

অনেক নাটকীয়তার পর ১৯৭৭ সালে বিচারপতি সায়েমকে সরিয়ে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন। এরপর ১৯৭৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সামরিক আইনের আওতায় জারীকৃত সব আদেশ ও ঘোষণাকে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনী বৈধতা প্রদান করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমানই ঐ ৫ম সংশোধনী বিলটি সংসদে পেশ করেছিলেন। যিনি ছিলেন রাজাকারদের অন্যতম সদস্য। তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে জাতিসংঘে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে ভাষণ দিয়েছিলেন। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়।

পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে। কিন্তু স্বপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার মতো জঘন্য হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার না করে তাদেরকে পুরষ্কৃত করা হয়েছে। যাতে তাদের বিচার না হয় সেজন্য ইতিহাসের জঘন্য কালো আইন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী এবং পরবর্তীতে সংসদে ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সেটিকে পূর্ণতা দিয়ে মোশতাক, জিয়া খুনিচক্রের দোসর হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারে হত্যার বিচারের পথেই বন্ধ করেনি, দীর্ঘ ২১ বছরের বিচারহীনতার সুযোগেই বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রই করা হয়েছিল। রাতারাতি বাংলাদেশ বেতার হয়ে যায় রেডিও বাংলাদেশ, জয় বাংলা স্লোগান হয়ে যায় বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। এমনকি রাতারাতি রাজকারী পোশাককে রাষ্ট্রীয় পোশাক হিসাবে প্রচলন করা হয়। স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিচারপতি আব্দুস সাত্তার, এরশাদ এবং ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও তারা কেউই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের উদ্যোগ নেননি। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের প্রক্রিয়া হিসেবে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরনের জন্য সংসদে বিল উপস্থাপন করা হয়। তৎকালীন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরু ইনডেমননিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য ‘দি ইনডেমনিটি রিপিল এ্যাক্ট ১৯৯৬’ নামে বিলটি মহান সংসদে উপস্থাপন করেন। ১২ নভেম্বর সংসদে মানবতা ও সভ্যতা বিরোধী কলংকিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন পাশ হয়। দ্বার উন্মোচিত হয় ২১ বছরের জাতীয় কলংক থেকে মুক্তি পাবার পথ, আর সেই সাথে সুগম হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথও। অস্ত্রধারী খুনিচক্রের সহায়তায় খন্দকার মোশতাক কর্তৃক সম্পূর্ণ অবৈধ ও বেআইনীভাবে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণার মাধ্যমে যে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল তার বাতিল আইনে ( ইনডেমনিটি (বাতিল) আইন ১৯৯৬) এ উল্লেখ করা হয় ‘ এই অধ্যাদেশ রহিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে এইরূপে অকার্যকর, বাতিল ও বিলুপ্ত হয়ে যাবে যেন উক্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের কোনো অস্তিত্ব ছিলনা ও নাই।’

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ শুরু হয় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবরে ধানমন্ডি থানায় একটি ফৌজধারী মামলা দায়েরের মাধ্যমে। ১৯৯৮ সালে যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ৮ নভেম্বর ১৫ জন আসামীকে আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। আসামীপক্ষ উচ্চ আদালতে আপীল দায়ের করলে উচ্চ আদালত ১২ জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রাখে। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি এদের মধ্যে ৫ জনের ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয় এবং ২০২০ সালে পলাতক ক্যাপ্টেন মাজেদ ধরা পরলে তার ফাঁসির রায়ও কার্যকর করা হয়। বিদেশে পলাপক অন্যান্যদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করার প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।

প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি। কিন্তু এদেশের মানুষসহ বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার পরই মানবতাবিরোধী কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কোনো সভ্য দেশে ও সমাজে বিচার বন্ধ করে দেয়ার এ ধরণের জঘন্য অধ্যাদেশ/আইন থাকার কথা চিন্তাও করা যায়না। সেনাসমর্থিত ষড়যন্ত্রকারী অকৃতজ্ঞ খন্দকার মোশতাক সরকার ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। জিয়াউর রহমানসহ বিএনপি সরকার এর দায় এড়াতে পারে না। ১৯৯৬ সালে সংসদে যেদিন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন পাস হয় সেদিন বিএনপি হরতাল ডেকেছিল। তারা বলেছিল প্রতিহিংসা বাস্তবায়নের জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। অথচ সুযোগ থাকা স্বত্বেও কোনো ট্রাইবুন্যাল বা বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা না করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপরিবারে হত্যার বিচার চেয়েছেন দেশের প্রচলিত আইন ও আদালতে। এদেশে একজন সাধারণ নাগরিকের হত্যার বিচার যে পক্রিয়ায় হয় বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যার বিচারও সেই প্রক্রিয়াই হয়েছে।

বাঙালির জাতীয় ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর এক সাহসী অগ্নিপুরুষের নাম। বাঙালি যুগে যুগে লড়াই সংগ্রাম করে আসলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাঙালি জাতি শেষ পর্যন্ত পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে স্বাধীনতা লাভ করে। যিনি বাংলাদেশের মানুষের অধিকার আদায় ও মুক্তির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন, যার নেতৃত্বে এ দেশ স্বাধীন হয়েছে, যিনি আমাদের লাল সবুজের পতাকা দিয়েছেন; সেই মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার বিচারের পথ চিরতরে বন্ধ করে দেয়ার জন্যই ষড়যন্ত্রকারী মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারী করে এবং জিয়াউর রহমান কর্তৃক ৫ম সংশোধনী এনে তা পূর্ণতা দেয়া হয়। যা ছিল ইতিহাসের এক কংলকময় ও জঘন্যতম অধ্যায়, এ ইতিহাস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে এ বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও লজ্জাজনক কালো অধ্যাদেশের কথা জানাতে হবে।

তাই ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫ এর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারীর দিনকে কালো দিবস হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান আজ সময়ের দাবি।

লেখক : মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ, সাবেক সচিব

Source: Kalerkantho Link  ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

আরও পড়ুন