বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। যার আলোয় দূর হয়েছিল বাংলার পরাধীনতা ও নিপীড়নের অন্ধকার। এক বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী ছিলেন তিনি। মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের সাথে তার জীবনের তুলনা করলেও মন্দ হয় না। সাঁতার জানতেন না সম্রাট হুমায়ূন,অথচ কতবার যে তাকে নদীর খরস্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে হয়েছে তার কোনো হিসেব কারো কাছে নেই। ঠিক তেমনি ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনটাও। রোগা-দুর্বল স্বাস্থ্যের বঙ্গবন্ধু তরুণ বয়সে অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে মারামারি করেছেন, অনেক বার বিনা অপরাধে জেলের ঘানি টেনেছেন, জীবনের নানা সময় নানা রোগে ভুগেছেন। কিন্তু এতশত প্রতিকূলতা অতিক্রম করেও দেশের মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছেন বলিষ্ঠভাবে। এর জন্য জেলেও যেতে হয়েছে অনেকবার। সব মিলিয়ে তিনি তার জীবনে মোট জেলে ছিলেন প্রায় সাড়ে ১২ বছর। কিন্তু যখনই জেল থেকে বের হয়েছেন, তখনই শুরু হয়েছে পূর্ণোদ্দমে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বদান। মোটেও দমে যাননি তিনি। কোনো প্রকার জেল-জুলুম এমনকি ফাঁসিকেও ভয় করতেন না তিনি। দেশের জন্য লড়াই করেছেন আপোষহীনভাবে। এইসব নানান বৈচিত্র্যময় ঘটনা-দুর্ঘটনা উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু রচিত অমর সৃষ্টি ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে।
একদিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু কারাগারের ছোট কোঠায় বসে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছেন তার রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কথা। কিভাবে তার সাথে পরিচয়, কিভাবে তার সান্নিধ্য লাভ, কিভাবে তিনিই কাজ করতে শেখালেন-ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে ভাবনার জগতে সাঁতার কাটছেন। হঠাৎ তার মনে হলো লিখতে ভালো না পারলেও ঘটনা যতদূর মনে আছে লিখে রাখতে তো আর ক্ষতি নেই। অন্তত এই বন্দি কারাগারে সময়টুকু তো কাটবে। এর কয়েকদিন পর রেণু তাকে কয়েকটা খাতা কিনে জেলগেটে জমা দিয়েছিলেন। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা তাকে দেন। তখন থেকেই তিনি শুরু করেন আত্মজীবনী লিখতে। বস্তুত, বঙ্গবন্ধুর এই আত্মজীবনী লেখার পেছনে বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। জনসাধারণকে নিজের জীবন সম্পর্কে জানাতে হবে বা বিদেশের মানুষের কাছে নিজেকে পরিচিত করতে হবে এমন কোনো উদ্দেশ্যই তার ছিল না। এসব লিখে তিনি শুধুমাত্র একটু সময় কাটাতে চেয়েছিলেন। আত্মজীবনী লিখতে শুরু করার আগে তিনি বলতেন যে, তিনি মোটেও ভালো লেখক ছিলেন না। কিন্তু তার লেখার মধ্যে যে সহজ ও সাবলীল ভাষা ফুটে উঠেছে, সেটিই প্রমাণ করে যে তিনি কেবল একটি জাতির মুক্তির দিশারী অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না বরং একজন উঁচুমানের লেখকও ছিলেন বটে। আর এমনিতেও যে ব্যক্তি জীবনে কখনো লেখেননি, তিনি প্রথমবার কলম ধরেই যখন এত সহজ ভাষায় বিভিন্ন ঘটনা ফুটিয়ে তুলতে পারেন তখন সহজেই অনুমান করা যায় যে তিনি কত বড় প্রতিভা।
বইটিতে বঙ্গবন্ধু তার ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত নিজের জীবনের ঘটনা লিখেছেন। সেখানে তার জীবনে দেখা নানা বিষয় সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। বইটি লেখার প্রেক্ষাপট, তার বংশপরিচয়, জন্ম,শৈশব-কৈশোর, স্কুল-কলেজের শিক্ষাজীবন, রাজনৈতিক জীবন, সে সময়ের সামাজিক অবস্থা, দুর্ভিক্ষ, কলকাতা-বিহারের দাঙ্গা, দেশভাগসহ ইত্যাদি নানা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানা যায় বইটি থেকে। পাশাপাশি তার চীন, ভারত, পশ্চিম পাকিস্তান ভ্রমণও বইটিতে বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। বঙ্গবন্ধুর এই বইটি এমন একটি বই যা যে কোনো পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। বইটিতে বঙ্গবন্ধুর বংশপরিচয় সম্পর্কে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তির পরিচয় দিয়েছেন। বইটিতে তিনি তার বংশের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে খুব চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। বইটির শুরুতেই তিনি উল্লেখ করেছেন, শেখ বোরহানউদ্দিন এই শেখ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। শুরুর দিকে শেখ বংশ বেশ সম্পদশালী ছিল। এর প্রমাণস্বরূপ বোরহানউদ্দিনের সেই মুঘল আমলে ইটের বেশ সুন্দর কয়েকটি দালান নির্মাণ করার কথা বলেছেন। বঙ্গবন্ধু সেগুলোকে অবশ্য জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় দেখেছেন তাও বলেছেন। ধীরে ধীরে তাদের সম্পত্তির পরিমাণ কমতে থাকে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর জন্মের সময় অতটা বিত্তশালী না হলেও তার পরিবার প্রথম দিকে উচ্চ শ্রেণিরই ছিলেন। বইতে বঙ্গবন্ধু তারই বংশের কয়েকজন এবং তাদের নিয়ে কিছু ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ করেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে তার বিয়ের কথা। মজার ব্যাপার হলো, গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী বঙ্গবন্ধুর সাথে যখন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসার বিয়ে হয় তখন তার বয়স মাত্র বারো-তেরো বছর। আর ফজিলাতুন্নেসার তিন বছর। গ্রন্থের ৭ম পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু মজা করে বলেছেন, “আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে।” এভাবেই অত্যন্ত সহজ ভাষা কিন্তু বিভিন্ন মজার ঘটনার মাধ্যমে নিজের জন্ম ও বংশপরিচয়ের বিস্তারিত বর্ণনা তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু।
রাজনৈতিক জীবনের বিস্তারিত বর্ণনা ফুটিয়ে তুলেছেন অসাধারণভাবে। গ্রন্থে তিনি বর্ণনা করেন, তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু মিশন স্কুলে পড়াকালেই।এসময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভ করেন। হোসেন সোহরাওয়ার্দীর সাথে তার পরিচয় ঘটে যখন সোহরাওয়ার্দী মিশন স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। বইটির প্রায় সবখানেই বঙ্গবন্ধু সোহরাওয়ার্দীর কথা উল্লেখ করেছেন। তার সততা, কর্মদক্ষতা, সুনীতি, উদারতা ও বিচক্ষণতা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করেছিল অনেকাংশে।
যাইহোক, অনেক ইতস্তত করে পুলিশ বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানা পেশ করলে বাবা শেখ লুৎফর রহমান বললেন, “ওকে নিয়ে যান।” দারোগা বাবু নরম স্বরে বললেন, ও বরং খেয়ে-দেয়ে আসুক। সত্যিই,এবারও নিজের সততার প্রমাণ দেন বঙ্গবন্ধু। খেয়ে-দেয়ে হাজিরা দেন তিনি। জেলে মেয়েদের ওয়ার্ডে কোনো মেয়ে আসামি না থাকায় তাকে রাখা হয় মেয়েদের ওয়ার্ডে। সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম জেল, তাও আবার বিনা অপরাধে অন্যায়ভাবে। প্রথম জেলে যাওয়ার সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। জেল থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু আবার রাজনীতিতে যোগ দেন। রাজনৈতিক কর্মী বা রাজনীতিবিদ— উভয় দিক থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ ও ত্যাগী। রাজনৈতিক জীবনের জন্য যে তিনি কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা তার জবানীতেই জানা যায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে। এ নিয়ে তিনি বইটির ২০৯ নং পৃষ্ঠায় একটি ঘটনা উল্লেখ করেন।ঘটনাটি নিম্নরূপ—
অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, বঙ্গবন্ধু প্রথমে পাকিস্তান হবার পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান হবার পর যখন বাংলা ভাষার উপর আঘাত আসল, তখন তিনি এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। মাত্র বছরখানেকের মধ্যেই পাকিস্তান সৃষ্টির স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ ঘটে। তখন থেকেই পাকিস্তানের নানা অন্যায়-অনাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু সোচ্চার হতে থাকেন।
আসলে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসের এমন এক চরিত্র যিনি ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে তার অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থের মতো নিজের জীবনটাকেও অসমাপ্ত রেখে গেছেন। এই অসমাপ্ত জীবন কতই না ঘটনাবহুল। যাইহোক, এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থ থেকে আমরা কী শিখতে পারি? এটি একটি জীবনী গ্রন্থ, এতে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা একজন মানুষের জীবন বদলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সম্পূর্ণ প্রতিফলন এই বইটি।আর এই আদর্শে নিজের জীবন গড়ে তুলতে হবে বর্তমান প্রজন্মের প্রতিটি শিশুকে।
প্রথমত, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার এক অসামান্য পাঠ রয়েছে এই গ্রন্থে। বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদী চেতনার সাথে বইটি আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। আমাদেরও তার মতো প্রতিবাদী হতে হবে, অন্যায়ের সাথে কখনোই আপোষ করা যাবে না। দ্বিতীয়ত, গ্রন্থটিতে বঙ্গবন্ধুকে এক অসাধারণ দেশপ্রেমিক হিসেবে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু দেশের প্রতি অসামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাই দেশকে স্বাধীন করতে পেরেছিলেন— একথাই বইটি তুলে ধরে বলিষ্ঠভাবে। আমাদেরও দেশেকে ভালোবাসতে হবে, দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তবেই না দেশের এবং আমাদের জীবনে সফলতা ধরা দিবে। তৃতীয়ত, গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর সকলের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন, তাই সকলের সম্মান ও শ্রদ্ধা পেতেন। কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িকতা তার মাঝে ঠাঁই পেত না। আমাদেরও সকলকে সমান চোখে দেখতে হবে, কাউকে ছোট বা কাউকে বড় করে দেখা যাবে না। তাহলেই সমাজের সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মান পাব। চতুর্থত, গ্রন্থে নিজের অধিকার আদায়ে অটল থাকার এক দৃঢ় বঙ্গবন্ধুকে পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু সর্বদা নিজের অধিকার আদায়ে অটল থাকতেন। বাঙালির অধিকার আদায় করতে তিনি ছিলেন অদম্য। আমাদেরকেও নিজের অধিকার আদায়ে অটল থাকতে হবে।যতক্ষণ না আমরা সেটা আদায় করতে পারছি ঠিক ততক্ষণ, তবে সেই দাবি অবশ্যই হতে হবে ন্যায্য ও যুক্তিসংগত। মোটকথা, জীবনে সফল হওয়ার জন্য একজন মানুষের যা যা থাকা প্রয়োজন, তার সবকিছুই ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে। আর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থটি আমাদের সেইসব গুণ অর্জন করতে শেখায়।এইসব গুণ অর্জন করতে পারলেই আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে পারব।
অসমাপ্ত আত্মজীবনী সবমিলিয়ে এক সুখপাঠ্য গ্রন্থ। এটি পড়তে শুরু করলে শেষ না করে যেন ভালো লাগছিল না আমার। কারণ ওই সময়ের ঘটনাগুলো নিজের কলমে অত্যন্ত সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় একের পর এক সুন্দর মালা গেঁথেছেন বঙ্গবন্ধু— যা জানার এক ক্ষুধা তৈরি হয়েছিল মনের মধ্যে। বলা যায়, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি গ্রন্থটি। আমি ছোট্ট একজন মানুষ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর মতো এক বিশাল ব্যক্তিত্বের কোনো কিছুর মূল্যায়ন করা আমার জন্য অসম্ভব একটি ব্যাপার। তার পরেও বলতে চাই যে, বঙ্গবন্ধু যেমন একজন বটবৃক্ষের মতো রাজনীতিবিদ ছিলেন ঠিক তেমনি তিনি একজন অনেক বড় মাপের লেখকও ছিলেন— ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তার আত্মপরিচয় জানতে হলে প্রতিটি বাঙালির এই গ্রন্থটি পাঠ করা উচিত।
মো. আদনান কাদির চৌধুরী দীপ: শিক্ষার্থী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ
সূত্র: সারাবাংলা.নেট । লিঙ্ক November 13, 2020
Leave a Comment